বিশ্ব

স্বাধীন ইসলামী সেনাবাহিনী গড়ে তুলেছে আফগানিস্তান, দাবি মোল্লাপুত্রের

Advertisement

আফগানিস্তানের বর্তমান ক্ষমতাসীন তালেবান সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী মোল্লা মোহাম্মদ ইয়াকুব, কিংবদন্তি তালেবান প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা ওমরের পুত্র, একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা দিয়েছেন। তাঁর দাবি—আফগানিস্তান আজ একটি “সম্পূর্ণ স্বাধীন ও ইসলামী নীতিভিত্তিক আধুনিক সেনাবাহিনী” গড়ে তুলেছে। দীর্ঘ দুই দশকের সংঘাত, বিদেশি বাহিনীর উপস্থিতি এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার পর আফগান সামরিক কাঠামো পুনর্গঠনের এই দাবি আন্তর্জাতিক মহলে নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে।

এই প্রতিবেদনে তুলে ধরা হলো—ইয়াকুবের বক্তব্য, তালেবান সরকারের সামরিক পুনর্গঠন পরিকল্পনা, অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ সক্ষমতা, নিরাপত্তা পরিস্থিতি, আঞ্চলিক প্রতিক্রিয়া এবং ভবিষ্যৎ ভূরাজনৈতিক প্রভাব।

মোল্লা ইয়াকুবের ঐতিহাসিক ঘোষণা

কাবুলে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক অনুষ্ঠানে ইয়াকুব বলেন—

“আলহামদুলিল্লাহ, আজ আমরা এমন এক স্বাধীন ইসলামী সেনাবাহিনী গড়ে তুলেছি, যারা কেবল আফগানিস্তানের সার্বভৌমত্বই রক্ষা করবে না—বরং পুরো অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠার ভূমিকা রাখবে। বিদেশি শক্তির ওপর আমাদের আর কোনো নির্ভরতা নেই।”

তিনি আরও দাবি করেন, আফগান সেনাবাহিনী এখন আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি শৃঙ্খলাবদ্ধ, প্রশিক্ষিত এবং ঐক্যবদ্ধ।

ইয়াকুবের বক্তব্যের কয়েকটি মূল পয়েন্ট—

  • সেনাবাহিনী এখন সম্পূর্ণভাবে আফগানদের দ্বারা পরিচালিত
  • অস্ত্রশস্ত্র ও যানবাহনের বড় অংশ পূর্বতন আফগান সরকারের আমলে সংগ্রহ করা হলেও তা নতুনভাবে সাজানো ও রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়েছে
  • সীমান্ত নিরাপত্তায় বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে
  • দেশীয় সামরিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র সম্প্রসারণ করা হচ্ছে
  • বিদেশি কোনো শক্তির সামরিক ঘাঁটি এখন আফগানিস্তানে নেই

ক্ষমতায় ফিরে আসার পর তালেবানের সামরিক পুনর্গঠন

২০২১ সালের আগস্টে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর দীর্ঘ ২০ বছরের উপস্থিতি শেষ হয়। কাবুলের পতনের পর তালেবান আবার ক্ষমতায় ফিরলে তাদের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল—

  • বিচ্ছিন্ন সামরিক কাঠামো পুনর্গঠন
  • বিভিন্ন গোষ্ঠীর যোদ্ধাদের এক ছাতার নিচে আনা
  • আধুনিক সেনা ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠা
  • সীমান্ত ও আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিয়ন্ত্রণ

তালেবান সরকার এরপর থেকে তিন বছর ধরে ধাপে ধাপে একটি নতুন সামরিক কাঠামো গড়ে তুলতে থাকে।

১. মুজাহিদ যোদ্ধাদের পেশাদার সেনায় রূপান্তর

আগে তালেবানরা ছিল মূলত গেরিলা যোদ্ধা। ক্ষমতায় ফেরার পর তাদের নিয়মিত সেনাবাহিনীতে রূপান্তরই ছিল সবচেয়ে বড় পরিবর্তন।
ইয়াকুবের নেতৃত্বে—

  • ইউনিফর্ম
  • বেতন কাঠামো
  • সামরিক পদমর্যাদা
  • প্রশিক্ষণ কেন্দ্র
  • সামরিক কোড অব কন্ডাক্ট

এসব প্রতিষ্ঠা করা হয়।

২. তালেবানের তিন শাখায় বিভাজন

তালেবান সরকার তাদের সামরিক বাহিনীকে তিন ভাগে ভাগ করেছে—

  1. আর্মি (Army)
  2. এয়ার ফোর্স (Air Force)
  3. স্পেশাল ফোর্স ‘বদর’ ও ‘আল-ফাতাহ’ ইউনিট

এগুলোই এখন তাদের মূল প্রতিরক্ষা কাঠামো।

অস্ত্রশস্ত্র ও সামরিক সক্ষমতা: কতটা শক্তিশালী আফগান বাহিনী?

যুক্তরাষ্ট্রের রেখে যাওয়া বিপুল অস্ত্রসম্ভার

২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান ছাড়ার সময় কিছু অস্ত্র ধ্বংস করলেও অনেক সামরিক যান, অস্ত্র ও সরঞ্জাম অক্ষত অবস্থায় থেকে যায়।
এর মধ্যে ছিল—

  • Humvee সাঁজোয়া যান
  • M1117 Armored Vehicle
  • Black Hawk হেলিকপ্টার
  • Mi-17 হেলিকপ্টার
  • সশস্ত্র ড্রোন
  • লক্ষাধিক ছোট অস্ত্র
  • নাইট ভিশন ও ট্যাকটিক্যাল ডিভাইস

তালেবান এগুলো নিজেদের মতো করে মেরামত ও ব্যবহার শুরু করে।

এয়ার ফোর্স পুনর্গঠন

দুই বছর প্রচেষ্টার পর তালেবান এখন দাবি করছে—

  • ৪০+ হেলিকপ্টার সচল
  • পুরোনো Mi–17 হেলিকপ্টারগুলো রাশিয়ান প্রযুক্তিবিদদের সহায়তায় রক্ষণাবেক্ষণ
  • নতুন পাইলটদের প্রশিক্ষণ চলমান

দেশীয় অস্ত্র কারখানা চালু

কাবুল ও কন্দহারের কাছে ‘ইসলামিক এমিরেট আর্মস ফ্যাক্টরি’ নামে নতুন কারখানা চালু হয়েছে যেখানে—

  • রাইফেল
  • গুলি
  • হালকা অস্ত্র
  • সামরিক বুট ও পোশাক
  • ট্যাকটিক্যাল সরঞ্জাম

প্রস্তুত করা হচ্ছে।

তালেবান বলছে, তারা ধীরে ধীরে ১০০% দেশীয় উৎপাদন সক্ষমতার দিকে যাচ্ছে।

সীমান্তে উত্তেজনা: পাকিস্তান–আফগানিস্তান দ্বন্দ্ব

ইয়াকুবের বক্তব্যের সময় একটি প্রেক্ষাপটও ছিল—
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পাক–আফগান সীমান্তে উত্তেজনা বেড়েছে, বিশেষ করে তোরখাম ও স্পিন বোলদাকে।

পাকিস্তান প্রায়ই অভিযোগ তোলে—

  • তালেবান সরকারের নজরদারির দুর্বলতার কারণে তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (TTP) শক্তিশালী হচ্ছে
  • সীমান্ত পেরিয়ে হামলা হচ্ছে

তালেবান এসব অভিযোগ অস্বীকার করে। বরং তারা বলছে—পাকিস্তান নিজের অভ্যন্তরীণ সমস্যা আফগানিস্তানের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে।

সীমান্তে তালেবানের নতুন সামরিক মোতায়েন

২০২৩–২৫ সালের মধ্যে তালেবান সীমান্তে যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে—

  • নতুন কমান্ডো ইউনিট মোতায়েন
  • সীমান্তে নজরদারি টাওয়ার নির্মাণ
  • ড্রোন দিয়ে নজরদারি
  • সীমান্ত গোয়েন্দা ইউনিট শক্তিশালীকরণ

এগুলোই তাদের সেনাবাহিনীকে আরও প্রস্তুত করছে।

আঞ্চলিক ভূরাজনীতি: কাদের সমর্থন পাচ্ছে তালেবান সরকার?

১. চীন

চীন ইতিমধ্যে তালেবানের রাষ্ট্রদূত স্বীকৃতি দিয়েছে।
বদলে চীন পাচ্ছে—

  • আফগানিস্তানের বিরল খনিজ সম্পদে প্রবেশাধিকার
  • সন্ত্রাস দমনে সহযোগিতা
  • বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (BRI) সম্প্রসারণের সুযোগ

চীন ইতিমধ্যে আফগান সেনাদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে।

২. রাশিয়া

রাশিয়া তালেবান সরকারের সঙ্গে শর্তসাপেক্ষে সম্পর্ক রাখছে।
ভাড়াটে কোম্পানি ও প্রযুক্তিবিদদের মাধ্যমে আফগান হেলিকপ্টার রক্ষণাবেক্ষণে সহযোগিতা করছে মস্কো।

৩. ইরান

ইরান ও তালেবানের সীমান্তে অতীতে সংঘর্ষ হলেও এখন দুই দেশ সহযোগিতায় বেশি আগ্রহী।
ইরানের সঙ্গে—

  • পানি
  • বাণিজ্য
  • নিরাপত্তা

এই তিন বিষয়ে চুক্তির আলোচনা চলছে।

দেশের অভ্যন্তরে কী পরিবর্তন?

নতুন সেনাবাহিনীর প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা

তালেবান দাবি করে—

  • ডাকাতি
  • অপহরণ
  • সন্ত্রাস
  • দুর্নীতি

আগের সরকারের তুলনায় কমেছে।

অনেক নাগরিক বলছেন—অন্তত বড় ধরনের যুদ্ধ বা বোমা হামলার ভয় এখন নেই।
তবে নারী অধিকার, নাগরিক স্বাধীনতা এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির অভাব এখনো বড় চ্যালেঞ্জ।

নারী অধিকার ও সামরিক বাহিনী: আন্তর্জাতিক সমালোচনা

বিশ্ববাসীর সবচেয়ে বড় উদ্বেগ—নারীদের শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা।
অনেক দেশ বলছে, এসব নিষেধাজ্ঞা তুলে না নেওয়া পর্যন্ত তারা তালেবান সরকারকে পূর্ণ স্বীকৃতি দেবে না।
সামরিক শক্তি বাড়ানো নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে সন্দেহ রয়েছে—
এটি কি কেবল অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তায় ব্যবহৃত হবে, নাকি চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলোকে সুবিধা দেবে?

তালেবান অবশ্য দাবি করছে—

“আমরা কোনো দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে চাই না। আমাদের সেনাবাহিনী শুধুই প্রতিরক্ষামূলক।”

মোল্লা ওমরের উত্তরাধিকার: ইয়াকুব কেন এত প্রভাবশালী?

মোল্লা ওমর ছিলেন তালেবানের প্রতিষ্ঠাতা, যাকে আফগান ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র মনে করা হয়।
তাঁর ছেলে মোল্লা ইয়াকুব এখন—

  • প্রতিরক্ষা মন্ত্রী
  • তালেবানের উচ্চ পরিষদের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য
  • বিভিন্ন গোত্র ও গোষ্ঠীর কাছে গ্রহণযোগ্য নেতা

ইয়াকুবকে অনেকেই তালেবানের ‘মডারেট’ বা তুলনামূলক নরমপন্থী নেতা হিসেবে দেখে।
তাঁর নেতৃত্বেই বর্তমান আফগান সেনাবাহিনী পেশাদার রূপ পাচ্ছে বলে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন।

আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ: সামরিক শক্তি কি শান্তি নাকি নতুন উত্তেজনা আনবে?

সম্ভাবনা

  • সীমান্ত নিরাপত্তা আরও শক্তিশালী হবে
  • দেশে স্থিতিশীলতা বাড়বে
  • আঞ্চলিক বাণিজ্য ও সংযোগ উন্নত হতে পারে
  • আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়ার সম্ভাবনা বাড়বে

চ্যালেঞ্জ

  • নারী অধিকার সংকট
  • অর্থনৈতিক দুরবস্থা
  • আঞ্চলিক শক্তিগুলোর চাপ
  • চরমপন্থী গোষ্ঠীর সম্ভাব্য ব্যবহার
  • মানবাধিকার নীতি নিয়ে বৈশ্বিক সমালোচনা

বিশ্লেষকদের মতামত

আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের মতে—

  • আফগান সেনাবাহিনী সামরিকভাবে শক্তিশালী হয়েছে,
  • কিন্তু প্রশাসনিক ও কূটনৈতিক সক্ষমতা এখনো দুর্বল
  • দেশীয় অর্থনীতির উন্নতি ছাড়া যুদ্ধ-পরবর্তী পুনর্গঠন ধীর হবে

কিছু গবেষকের মতে, তালেবান সরকারের নতুন সেনাবাহিনী দক্ষিণ এশিয়া ও মধ্য এশিয়ার নিরাপত্তা কাঠামোকে পরিবর্তন করে দিতে পারে।

আফগানিস্তান কি সত্যিই একটি স্বাধীন ইসলামী সেনাবাহিনী গড়েছে?

মোল্লা ইয়াকুবের দাবি নিঃসন্দেহে আফগানিস্তানের নতুন অধ্যায়ের প্রতীক। দীর্ঘ যুদ্ধ ও দখলদারিত্বের পর দেশটি এখন নিজেদের সামরিক কাঠামো নিজেরাই পরিচালনা করছে।
তবে—

  • আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি
  • মানবাধিকার
  • অর্থনৈতিক পুনর্গঠন

এই তিন ক্ষেত্রের উন্নতি ছাড়া তাদের সামরিক সাফল্য পূর্ণতা পাবে না।

তবুও আফগানিস্তানের দীর্ঘ ইতিহাসে এটিই প্রথমবার—
দেশটি সম্পূর্ণ নিজস্ব রাজনৈতিক ও সামরিক ব্যবস্থার ওপর দাঁড়িয়ে এক নতুন ভবিষ্যতের দিকে এগোতে চাইছে।

MAH – 14154 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button