বিশ্ব

মামদানিকে চ্যালেঞ্জ, নিউইয়র্ক যাওয়ার ঘোষণা নেতানিয়াহুর

Advertisement

গাজায় সংঘটিত যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) জারি করা পরোয়ানা থাকা সত্ত্বেও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু তাঁর নিউইয়র্ক সফরের ঘোষণা দিয়েছেন। নিউইয়র্ক সিটির নবনির্বাচিত মেয়র জোহরান মামদানি নেতানিয়াহু নিউইয়র্কে এলেই গ্রেফতারের নির্দেশ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এমন কঠোর সতর্কতার মুখেও নেতানিয়াহু পরিকল্পিতভাবে নিউইয়র্কে যাওয়ার ঘোষণা দেওয়ায় এই ঘটনাটি বিশ্বজুড়ে নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। নিউইয়র্ক টাইমসের ডিলবুক ফোরামের এক ভার্চুয়াল সাক্ষাৎকারে নেতানিয়াহু বলেন, ‘হ্যাঁ, আমি নিউইয়র্কে আসব।’ এই ঘোষণার মাধ্যমে নেতানিয়াহু কার্যত মেয়র মামদানির গ্রেফতারের হুমকিকে চ্যালেঞ্জ করলেন।

নিউইয়র্ক সফরের ঘোষণা ও নেতানিয়াহুর শর্ত

স্থানীয় সময় বুধবার (৩ ডিসেম্বর) নিউইয়র্ক টাইমসের ডিলবুক ফোরামে এক ভার্চুয়াল সাক্ষাৎকারে নেতানিয়াহুর নিউইয়র্ক সফরের পরিকল্পনা নিয়ে জানতে চাওয়া হয়। জবাবে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী তাঁর সফরের বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, ‘হ্যাঁ, আমি নিউইয়র্কে আসব।’

নবনির্বাচিত মেয়র জোহরান মামদানির সঙ্গে দেখা করতে চান কিনা—এমন প্রশ্নে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যদি তিনি মত পরিবর্তন করে বলেন যে আমাদের (ইসরায়েলের) রাষ্ট্র হিসেবে বেঁচে থাকার অধিকার আছে, সেক্ষেত্রে আলোচনার ভালো সূচনা হতে পারে।’ এই মন্তব্যের মাধ্যমে নেতানিয়াহু স্পষ্ট করে দিলেন যে, তিনি ইসরায়েলের ‘ইহুদি রাষ্ট্র’ হিসেবে থাকার অধিকারের বিষয়ে মামদানির অবস্থান পরিবর্তন চান। নেতানিয়াহু অবশ্য তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগ অস্বীকার করে বিচারপ্রক্রিয়াকে ‘উইচ-হান্ট’ আখ্যা দিয়েছেন।

মেয়র মামদানির গ্রেফতারের হুমকি

৩৪ বছর বয়সী ডেমোক্র্যাট নেতা জোহরান মামদানি গত নভেম্বরের শুরুতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে সাবেক গভর্নর অ্যান্ড্রু কুমোকে বিশাল ব্যবধানে পরাজিত করে নিউইয়র্ক সিটির ইতিহাসে প্রথম মুসলিম মেয়র নির্বাচিত হন। তিনি দক্ষিণ এশিয়ার বংশোদ্ভূত। মেয়র নির্বাচিত হওয়ার আগে থেকেই তিনি নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন।

মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর মামদানি ঘোষণা দিয়েছেন, আইসিসির পরোয়ানাভুক্ত যেকোনো নেতাকে গ্রেফতারে নিউইয়র্ক পুলিশ বিভাগকে (এনওয়াইপিডি) অনুমতি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি। তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন, আসামি নেতানিয়াহু কিংবা রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন যেই হোক না কেন, পরোয়ানা কার্যকর করা হবে। নিউইয়র্ক টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মামদানি বলেন, ‘নেতানিয়াহু যুদ্ধাপরাধী এবং তিনি গাজায় গণহত্যা চালাচ্ছেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) গ্রেফতারি পরোয়ানাকে সম্মান জানিয়ে তাঁকে বিমানবন্দরেই আটক করার নির্দেশ দেব।’

আইসিসির পরোয়ানা ও যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ

হেগভিত্তিক আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) গত বছর জানিয়েছিল, গাজায় ইসরায়েলের নির্বিচার গণহত্যার দায়ে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। ২০২৪ সালের নভেম্বরে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় সামরিক অভিযানের নির্দেশ এবং ৬০ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি নারী-পুরুষ-শিশুর হত্যার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে নেতানিয়াহুকে দোষী সাব্যস্ত করে আইসিসি গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে, যা এখনও কার্যকর আছে।

তবে ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়াসহ কয়েকটি দেশ আইসিসির সদস্য নয়। এই সদস্য না হওয়ার বিষয়টি নেতানিয়াহুকে গ্রেফতারের আইনি প্রক্রিয়াকে জটিল করে তুলেছে।

ইসরায়েলের অস্তিত্বের অধিকার নিয়ে বিতর্ক

মেয়র জোহরান মামদানি একাধিকবার বলেছেন, তিনি ইসরায়েলের অস্তিত্বের অধিকারের প্রতি তাঁর সমর্থন রয়েছে। তবে কোনো রাষ্ট্রের নাগরিকত্বের কাঠামো ধর্মের ওপর ভিত্তি করে ‘স্তরবিন্যাস’ তৈরি করা উচিত নয়—এই যুক্তিতে তিনি ইসরায়েলের ‘ইহুদি রাষ্ট্র’ হিসেবে থাকার অধিকারের বিষয়ে সরাসরি সমর্থন জানাননি।

নেতানিয়াহু তাঁর মন্তব্যে মামদানির এই অবস্থানের দিকেই ইঙ্গিত করেছেন। নেতানিয়াহু চান, মামদানি ইসরায়েলের অস্তিত্বের অধিকারের পাশাপাশি ‘ইহুদি রাষ্ট্র’ হিসেবে থাকার অধিকারের প্রতিও সমর্থন দিক। এই বিষয়টি মধ্যপ্রাচ্য সংঘাত এবং জাতিগত পরিচয়ের ওপর ভিত্তি করে রাষ্ট্র গঠনের বিতর্কের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত।

আইন বিশেষজ্ঞদের মতামত ও ট্রাম্পের ভূমিকা

আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র আইসিসির সদস্য না হওয়ায় এবং নিউইয়র্ক পুলিশ বিভাগ (এনওয়াইপিডি) ফেডারেল আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়ায়, মেয়র মামদানির পক্ষে নেতানিয়াহুকে গ্রেফতার করা কার্যত অসম্ভব। এ ধরনের গ্রেফতার ফেডারেল আইনের লঙ্ঘন হতে পারে।

এছাড়াও, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সরাসরি নেতানিয়াহুর পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। গত ফেব্রুয়ারিতে ট্রাম্প আইসিসির বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারিসংক্রান্ত একটি নির্বাহী আদেশে সই করেছেন। ফলে, চাইলেও মামদানি নেতানিয়াহুকে গ্রেফতার করতে পারবেন কি না, এ নিয়ে শঙ্কা আছে।

বিশ্বমঞ্চে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত

বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর নিউইয়র্ক সফরের ঘোষণা এবং মেয়র জোহরান মামদানির তাঁকে গ্রেফতারের হুমকি—এই ঘটনা বিশ্বমঞ্চে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতকে আরও একবার সামনে নিয়ে এলো। এটি কেবল আইনি বা রাজনৈতিক বিরোধ নয়, বরং মানবাধিকার, ধর্ম এবং কূটনৈতিক প্রভাবের এক জটিল সংমিশ্রণ। নেতানিয়াহু তাঁর সফরের মাধ্যমে আইসিসির পরোয়ানা এবং আন্তর্জাতিক চাপকে উপেক্ষা করার চেষ্টা করছেন। তবে, নিউইয়র্ক পুলিশ এবং ফেডারেল সরকারের ভূমিকার ওপরই নির্ভর করছে, নেতানিয়াহুকে মামদানি গ্রেফতারের নির্দেশ দিতে পারেন কিনা।

এম আর এম – ২৪৯৬, Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button