বানিজ্য

৯৯ ভাগ শ্রমিক পেয়েছেন বেতন-বোনাস, গা ঢাকা দিলেন ৩ গার্মেন্টস মালিক

Advertisement

ঈদুল আজহা সামনে রেখে দেশের অন্যতম রপ্তানিমুখী খাত তৈরি পোশাক শিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের অধিকাংশই তাদের মে মাসের বেতন ও ঈদ বোনাস পেয়েছেন। তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর তথ্য অনুযায়ী, এ খাতের ৯৯ দশমিক ৯০ শতাংশ শ্রমিক ইতোমধ্যে ঈদ বোনাস পেয়েছেন। পাশাপাশি মে মাসের বেতন পরিশোধ করেছে ৯৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ গার্মেন্টস কারখানা।

তবে আশার এই চিত্রের মাঝেও কিছু ব্যতিক্রম রয়েছে। এখনো ২টি কারখানায় ঈদ বোনাস এবং ৭টি কারখানায় মে মাসের বেতন পরিশোধ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এ ছাড়া অন্তত তিনটি কারখানার মালিক বেতন-বোনাস না দিয়েই কারখানা ফেলে পালিয়ে গেছেন, যা শ্রমিকদের মধ্যে চরম হতাশা ও অনিশ্চয়তার সৃষ্টি করেছে।

বিজিএমইএ’র পরিসংখ্যান কী বলছে?

বিজিএমইএর আওতাধীন ২ হাজার ৯২টি সক্রিয় গার্মেন্টস কারখানার সবকটিই বর্তমানে খোলা রয়েছে। এর মধ্যে ২ হাজার ৮৫টি কারখানা মে মাসের বেতন পরিশোধ করেছে, যা মোট সক্রিয় কারখানার ৯৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ। আর ২ হাজার ৯০টি কারখানা তাদের শ্রমিকদের ঈদ বোনাস দিয়েছে, যা মোটের ৯৯ দশমিক ৯০ শতাংশ।

এমন সাফল্যের পেছনে রয়েছে বিজিএমইএ, শ্রম মন্ত্রণালয়, এবং শিল্প পুলিশের ত্রিপাক্ষিক সমন্বয় ও তদারকি। প্রতিনিয়ত শ্রমিকদের বেতন ও বোনাস প্রদানের অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। এছাড়া, প্রতিটি শিল্পাঞ্চলে মনিটরিং সেল কাজ করছে যাতে কোনো শ্রমিক অধিকারবঞ্চিত না হন।

যেসব কারখানায় এখনও সমস্যা রয়ে গেছে

বিজিএমইএর তথ্যমতে, যেসব গার্মেন্টস কারখানা এখনও বেতন-বোনাস পরিশোধ করেনি বা মালিক পালিয়েছেন, তাদের মধ্যে রয়েছে:

  • বসুন্ধরা গার্মেন্টস লিমিটেড (হেমায়েতপুর, সাভার)
  • সিজনস ড্রেসেস লিমিটেড (টঙ্গী, গাজীপুর)
  • টারাটেক্স ফ্যাশন লিমিটেড (টঙ্গী, গাজীপুর)

এই তিনটি কারখানার মালিকরা শ্রমিকদের প্রাপ্য পরিশোধ না করেই পলাতক রয়েছেন বলে নিশ্চিত করেছে বিজিএমইএ। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, মালিকদের খুঁজে বের করে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে মালিকদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের, শিল্প পুলিশের মাধ্যমে অনুসন্ধান, এবং শ্রম মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপ।

এ ছাড়া, আশুলিয়ার সেইন অ্যাপারেলস লিমিটেড প্রতিষ্ঠানটি লে-অফ ঘোষণা করলেও শ্রমিকরা এখনো লে-অফ সুবিধা পাননি। অন্যদিকে, নারায়ণগঞ্জ ও ময়মনসিংহ অঞ্চলের কয়েকটি গার্মেন্টস বেতন আংশিক পরিশোধ করেছে, যা শ্রমিক অসন্তোষের কারণ হয়ে উঠতে পারে।

শ্রমিকদের ঈদের ছুটি ও বাড়ি ফেরার হালচাল

ঈদ সামনে রেখে শ্রমিকদের মধ্যে ছুটি গ্রহণের প্রবণতা বাড়ছে। বিজিএমইএর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, আজ ৫ জুন (বুধবার) প্রায় ৫১ শতাংশ শ্রমিক ছুটিতে গেছেন। এর আগে ৩ জুন ছুটি নিয়েছেন ৯ শতাংশ শ্রমিক এবং ৪ জুন ছুটি নিয়েছেন ৪২ শতাংশ। মোট শ্রমিকদের মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশই ইতিমধ্যে ঈদের ছুটিতে নিজ নিজ বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছেন।

ঢাকার গাবতলী, মহাখালী, সায়েদাবাদ, গাজীপুর চৌরাস্তা, এবং নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় শ্রমিকদের ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। দীর্ঘ যাত্রার কষ্ট থাকা সত্ত্বেও পরিবার-পরিজনের সঙ্গে ঈদ উদযাপন করতে শ্রমিকরা মুখিয়ে রয়েছেন।

পলাতক মালিকদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে?

বিজিএমইএ এবং শ্রম মন্ত্রণালয় যৌথভাবে পলাতক মালিকদের শনাক্ত ও আইনের আওতায় আনার প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছে। সংগঠনের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, “আমরা চাই না কোনো গার্মেন্টস শ্রমিক বেতন বা বোনাস থেকে বঞ্চিত হোক। যে মালিকরা দায়িত্ব এড়িয়ে যাচ্ছেন, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে।”

এর মধ্যে রয়েছে:

  • শ্রম আদালতে মামলা
  • বিজিএমইএর সদস্যপদ বাতিল
  • ব্যাংক হিসাব জব্দ
  • শিল্প পুলিশের তদন্তে সহায়তা

এই পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়িত হলে ভবিষ্যতে এ ধরনের কর্মকাণ্ডে মালিকরা entitle না হওয়ায় সাহস পাবেন না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

শ্রমিকদের প্রতিক্রিয়া

অনেক শ্রমিক এ বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। টঙ্গীর একটি গার্মেন্টের শ্রমিক রুমা আক্তার বলেন, “মালিকরা বেতন-বোনাস না দিয়ে পালিয়ে যাওয়ায় আমরা বিপাকে পড়েছি। ঈদ সামনে, বাসাভাড়া, বাজার করা—সব কিছুতেই সমস্যা হচ্ছে।”

আরেক শ্রমিক জামাল হোসেন বলেন, “বছরের পর বছর কাজ করছি। কিন্তু যখন ঈদের সময় আসে, তখন এমন ঘটনা আমাদের মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তোলে।”

তবে অধিকাংশ শ্রমিক সময়মতো বেতন-বোনাস পাওয়ায় বিজিএমইএ ও সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। তেজগাঁওয়ের একটি গার্মেন্টের শ্রমিক রুবেল বলেন, “এই ঈদে সময়মতো বেতন পেয়েছি। পরিবার নিয়ে শান্তিতে ঈদ করতে পারব।”

সার্বিক মূল্যায়ন

তৈরি পোশাক খাত বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি। প্রতি বছর ঈদে বেতন ও বোনাস পরিশোধ নিয়ে নানা আলোচনা হলেও এবারের পরিস্থিতি তুলনামূলকভাবে ইতিবাচক। মাত্র হাতে গোনা কয়েকটি কারখানায় সমস্যা থাকলেও বাকি প্রায় ৯৯ শতাংশ প্রতিষ্ঠানে সুষ্ঠুভাবে বেতন ও বোনাস প্রদান সম্পন্ন হয়েছে।

তবে গার্মেন্টস মালিকদের স্বচ্ছতা, শ্রমিক কল্যাণে দায়বদ্ধতা এবং আইনানুগ পদক্ষেপ নিশ্চিত করতেই হবে—এতে কোনো ছাড় দেওয়া যাবে না। শিল্প খাতে এমন অনিয়মের বিরুদ্ধে শক্তিশালী নজরদারি এবং কঠোর পদক্ষেপই পারে একটি স্থিতিশীল ও মানবিক শিল্পপরিবেশ নিশ্চিত করতে।

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button