পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়া (কেপি) প্রদেশের দেরা ইসমাইল খান জেলায় রাস্তার পাশে পুঁতে রাখা বোমা বিস্ফোরণে (আইইডি) তিন পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন। বুধবার (৩ ডিসেম্বর) এই সন্ত্রাসী হামলায় পুলিশ ভ্যানের চালকসহ আরও দুজন কনস্টেবল ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান। আঞ্চলিক পুলিশ কর্মকর্তার (আরপিও) মুখপাত্র ইয়াকুব জুলকারনাইন পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যমকে এই হতাহতের ঘটনা নিশ্চিত করেছেন। কেপি প্রদেশে ধারাবাহিক সন্ত্রাসী হামলার মধ্যে এই ঘটনাটি নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান (টিটিপি)-এর ক্রমবর্ধমান চাপকেই তুলে ধরল। এই ঘটনার পর পুরো এলাকায় ব্যাপক অনুসন্ধান অভিযান শুরু হয়েছে।
বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ও হতাহতের বিবরণ
ঘটনাটি ঘটেছে দেরা ইসমাইল খান জেলার পানিয়ালার শাহীদ নবাব খান থানা এলাকায়। পুলিশ ভ্যানটি রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় রাস্তার পাশে পুঁতে রাখা আইইডি (Improvised Explosive Device) বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে। বিস্ফোরণের তীব্রতা এতটাই ছিল যে, পুলিশ ভ্যানটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
পুলিশ মুখপাত্র ইয়াকুব জুলকারনাইন নিশ্চিত করেছেন যে, হামলায় তিনজন ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান। নিহতরা হলেন:
- এএসআই গুল আলম
- কনস্টেবল রফিক
- পুলিশ ভ্যানের চালক সাখি জান
এই হামলায় তাঁদের সঙ্গী আরেক কনস্টেবল আজাদ শাহ অক্ষত আছেন। দুর্ঘটনার পরপরই পুরো এলাকা নিরাপত্তা বাহিনী দ্বারা ঘিরে ফেলা হয়েছে এবং সেখানে ব্যাপক অনুসন্ধান অভিযান শুরু হয়েছে। পুলিশ হামলাকারীদের খুঁজে বের করতে এবং ঘটনার সকল দিক বিবেচনায় নিয়ে তদন্ত করছে।
ধারাবাহিক হামলা: কেপি প্রদেশ এখন সন্ত্রাসের কেন্দ্র
খাইবার পাখতুনখোয়া (কেপি) প্রদেশটি গত কয়েক মাস ধরে টিটিপি-এর ধারাবাহিক সন্ত্রাসী হামলার কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়েছে। এই ঘটনাটি সাম্প্রতিক হামলারই একটি অংশ:
- ২ ডিসেম্বর (মঙ্গলবার): বান্নু জেলায় মিরানশাহের সহকারী কমিশনার শাহ ওয়ালির গাড়ি লক্ষ্য করে সন্ত্রাসী হামলা হয়। এতে দুই পুলিশ সদস্যসহ তিনজন প্রাণ হারান।
- পূর্ববর্তী হামলা: এর আগেও লাক্কি মারওয়াত এবং বান্নু জেলায় আত্মঘাতী বোমা হামলা এবং বন্দুক হামলায় দুই পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছিলেন।
এই ধারাবাহিক হামলা প্রমাণ করে যে, টিটিপি খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশে পুলিশ ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের লক্ষ্যবস্তু বানিয়েছে। তাদের লক্ষ্য এই অঞ্চলে ভীতি সৃষ্টি করা এবং সরকারের প্রশাসনিক ও নিরাপত্তা কাঠামোকে দুর্বল করে দেওয়া।
টিটিপি’র যুদ্ধবিরতি বাতিল ও প্রতিশোধের প্রতিশ্রুতি
পাকিস্তানে সন্ত্রাসী হামলার এই বৃদ্ধি ২০২২ সালের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। ওই বছর নিষিদ্ধ তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান (টিটিপি) দেশটির সরকারের সঙ্গে স্বাক্ষরিত যুদ্ধবিরতি বাতিল করার ঘোষণা দেয়।
যুদ্ধবিরতি বাতিলের পর টিটিপি প্রতিশ্রুতি দেয় যে, তারা পাকিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনী, পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ওপর নতুন করে হামলা চালাবে। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে খাইবার পাখতুনখোয়া ও বেলুচিস্তান প্রদেশে এই হামলার মাত্রা সবচেয়ে বেশি। এই বোমা বিস্ফোরণ টিটিপি’র সেই বাড়তি সন্ত্রাসী তৎপরতারই অংশ বলে মনে করা হচ্ছে, যেখানে তারা সহজ লক্ষ্যবস্তু হিসেবে পুঁতে রাখা বোমা বা আইইডি ব্যবহার করছে।
দেরা ইসমাইল খানের কৌশলগত গুরুত্ব
দেরা ইসমাইল খান জেলাটি খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত এবং এটি আফগানিস্তানের সীমান্তবর্তী অঞ্চলের কাছে হওয়ায় কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই অঞ্চলটি দীর্ঘদিন ধরে সন্ত্রাসবাদ এবং উপজাতীয় সংঘাতের কেন্দ্র ছিল।
টিটিপি এই অঞ্চলে হামলা চালিয়ে মূলত আফগান সীমান্ত থেকে তাদের অনুপ্রবেশ ও প্রভাব বাড়ানোর চেষ্টা করছে। এই ধরনের আইইডি বিস্ফোরণগুলো প্রমাণ করে যে, সন্ত্রাসীরা প্রত্যন্ত অঞ্চলে পুলিশের টহলকে লক্ষ্য করে হামলা চালাচ্ছে, যা এই অঞ্চলের সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের উদ্বেগ ও করণীয়
নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করেন, টিটিপি-এর এই ধরনের ধারাবাহিক এবং সফল হামলা প্রমাণ করে যে, পাকিস্তানের অভ্যন্তরে তাদের গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক এবং অস্ত্রের সরবরাহ এখনও অক্ষুণ্ণ রয়েছে। কেপি প্রদেশের সরকারকে সন্ত্রাস দমনে আরও কঠোর হতে হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, কেবল অভিযান চালালেই হবে না, বরং গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ এবং সন্ত্রাসীদের আর্থিক নেটওয়ার্ক ভেঙে দেওয়া জরুরি। এছাড়াও, নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের জন্য আধুনিক সরঞ্জাম ও প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা উচিত, যাতে তারা আইইডি-এর মতো হামলা থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারে। এই ধরনের হামলার পুনরাবৃত্তি রোধে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় এবং প্রাদেশিক সরকারকে সমন্বিত কৌশল গ্রহণ করতে হবে।
সন্ত্রাস দমনে সরকারের অগ্নিপরীক্ষা
দেরা ইসমাইল খান জেলায় পুঁতে রাখা বোমা বিস্ফোরণে তিন পুলিশ সদস্যের নিহত হওয়ার ঘটনাটি পাকিস্তানের নিরাপত্তা ব্যবস্থার ওপর একটি বড় আঘাত। টিটিপি’র ধারাবাহিক হামলার মুখে খাইবার পাখতুনখোয়ার নিরাপত্তা পরিস্থিতি এখন সরকারের জন্য একটি অগ্নিপরীক্ষা। নিহতদের পরিবারকে ন্যায়বিচার এবং আহতদের উন্নত চিকিৎসা নিশ্চিত করার পাশাপাশি,
এম আর এম – ২৪৭৯, Signalbd.com



