ফিলিস্তিনের গাজ্জা উপত্যকা—একসময় প্রাণচঞ্চল, সমুদ্রতীরবর্তী একটি সুন্দর জনপদ। কিন্তু প্রায় দুই বছর ধরে চলমান অব্যাহত হামলা, অবরোধ এবং ধ্বংসযজ্ঞে আজ সেই জনপদ শুধু এক বিশাল ধ্বংসস্তূপ। কোথাও ভাঙা ঘরবাড়ি, কোথাও পোড়া বাজার, কখনো রাস্তার ওপর ধুলো আর ধ্বংসস্তুপ—এ যেন এক মৃতপ্রায় নগরীর প্রতিচ্ছবি।
তবুও বিস্ময়করভাবে থেমে নেই গাজ্জার মানুষের জীবন। প্রতিটি বোমা বিস্ফোরণের পরও তারা আবার দাঁড়িয়েছে, আবার পথ খুঁজেছে, আবার আশার আলো জ্বালিয়েছে। কারণ আশা, ভালোবাসা ও বাঁচার দৃঢ় সংকল্প—এই তিনটিই গাজ্জার মানুষের শক্তি।
এই শক্তিরই বড় উদাহরণ হলো গাজ্জার ধ্বংসস্তূপে আয়োজিত গণবিয়ে।
ধ্বংসস্তূপের ভেতর নতুন জীবনের স্বপ্ন
২০২৫ সালের ২ ডিসেম্বর, মঙ্গলবার। হাজারো কষ্ট আর সীমাহীন অনিশ্চয়তার মাঝেও গাজ্জার একটি খোলা প্রান্তরে আয়োজন করা হয় বিশেষ এক গণবিবাহ অনুষ্ঠান। উদ্দেশ্য—যুদ্ধের ভয়াবহতা কাটিয়ে নতুন করে জীবন সাজানোর সুযোগ করে দেওয়া।
এই অনুষ্ঠানে বিয়ে করেন ৫৪ জন ফিলিস্তিনি দম্পতি।
চারদিকে ভাঙা দেয়াল, পোড়া ঘরবাড়ি, গর্ত হয়ে যাওয়া রাস্তাগুলোকে পাশে রেখে, রঙিন কাপড়ের ছাউনি দিয়ে সাজানো হয়েছিল ছোট্ট এক আয়োজন। গান নেই, আলোকসজ্জার ঝলকানি নেই, নেই উৎসবের চঞ্চলতা—তবুও ছিল আশার আলো, ছিল সামান্য হলেও স্বাভাবিকতার ছোঁয়া।
ইমান এবং হিকমতের প্রেম, যুদ্ধের মাঝেও জয়ী
গণবিয়েতে অংশ নেওয়া ৫৪ দম্পতির অন্যতম ছিলেন ইমান হাসান লাওয়া এবং ২৭ বছর বয়সী হিকমত লাওয়া।
ইমান বলেন—
“যা কিছু ঘটে গেছে—সবই আমরা পেছনে ফেলে দিচ্ছি। আল্লাহর কৃপায় আমরা নতুন জীবন শুরু করছি। আমরা আশা করি, এই নতুন শুরুই যুদ্ধের সমাপ্তির সূচনা হবে।”
তার কণ্ঠে ছিল দৃঢ়তা, চোখে ছিল স্বপ্ন।
তিনি আরও জানান—
“বিশ্বের অন্যান্য জায়গার মানুষের মতো আমরা-ও সুখী হতে চাই। একসময় একটি বাড়ি, একটি চাকরি এবং স্বাভাবিক জীবন ছিল আমার স্বপ্ন। কিন্তু আজ আমার স্বপ্ন খুব ছোট—শুধু বসবাসের জন্য একটি নিরাপদ তাঁবু।”
হিকমতের কথায়ও একই বাস্তবতা—
“জীবন স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে, কিন্তু তা আমাদের প্রত্যাশার মতো নয়। আমাদের চারপাশে শুধু ধ্বংস আর স্মৃতি।”
এই দম্পতি, অন্যান্যদের মতোই, ইসরায়েলি আগ্রাসনের কারণে একাধিকবার বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। নিজেদের ঘর হারিয়েছেন, হারিয়েছেন আত্মীয়স্বজন। তবুও তারা বাঁচার চেষ্টা ছাড়েননি।
ইসরায়েলি আগ্রাসনে বিধ্বস্ত গাজ্জা
গাজ্জায় দুই বছরের বেশি সময় ধরে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর বিমান ও স্থল হামলা চলছে। হাসপাতাল, স্কুল, বাজার, শরণার্থী শিবির—কোনো জায়গাই রেহাই পায়নি। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, গাজ্জার মানুষদের প্রায় ৮০ শতাংশই বাস্তুচ্যুত।
মোট ২০ লাখ ফিলিস্তিনি সামান্য খাবার, বিশুদ্ধ পানি, চিকিৎসা, নিরাপত্তা—সবকিছুর সংকটে দিন কাটাচ্ছেন। তবুও জীবনের স্বপ্ন তারা পরিত্যাগ করেননি।
সেই স্বপ্নই গণবিয়ের অনুষ্ঠানকে একটি মানবিক ও প্রতীকী উদ্যোগে পরিণত করেছে।
গণবিয়ের পেছনের সংগঠন: আশার আলো জ্বালানো উদ্যোগ
গাজ্জার এই গণবিয়ে আয়োজন করেছে আল ফারেস আল শাহিম নামের একটি দাতব্য সংগঠন।
তারা শুধু অনুষ্ঠান আয়োজনই করেনি; বরং নববিবাহিত প্রতিটি দম্পতিকে দিয়েছে—
- একটি করে আর্থিক সহায়তা
- দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম
- নতুন জীবনের শুরুতে প্রয়োজনীয় ঘরোয়া জিনিসপত্র
- খাবার ও জরুরি ত্রাণসামগ্রী
সংগঠনটির প্রধান সমন্বয়কারী বলেন—
“গাজ্জার সাধারণ মানুষ শুধুই বাঁচার চেষ্টা করছে। আমরা চাই, তাদের জীবনে সামান্য হলেও সুখ-আনন্দ যোগ করতে। যুদ্ধ তাদের সবকিছু কেড়ে নিয়েছে; কিন্তু আমরা চাই, তাদের হাসিটুকু যেন টিকে থাকে।”
মানবিক সংকটের মাঝে সামান্য আনন্দও অমূল্য
গাজ্জায় এখন এমন কোনো পরিবার নেই যারা ক্ষতি, কষ্ট কিংবা বেদনা দেখেনি। কেউ সন্তান হারিয়েছেন, কেউ বাবা-মা; কেউ হারিয়েছেন ঘরবাড়ি, কেউ পুরো পরিবার। চিকিৎসা সংকট, খাদ্য সংকট, শিক্ষা সংকট—সব মিলিয়ে পরিস্থিতি অত্যন্ত ভয়াবহ।
এর মধ্যেও এমন একটি আয়োজন মানুষের মনে কিছুটা হলেও স্বস্তি এনে দিয়েছে।
গাজ্জার আরেক নবদম্পতি মাহমুদ বলেন—
“আমাদের চারপাশে ধ্বংসস্তুপ—তবুও আজ আমরা হাসতে পেরেছি। এই হাসি হয়তো প্রতিদিন থাকবে না, কিন্তু আজকের দিনটি আমাদের মনে সাহস জোগাবে।”
গণবিয়ে কেন এত গুরুত্বপূর্ণ ছিল?
গাজ্জার বাস্তবতায় একটি সাধারণ বিয়েও এখন প্রায় অসম্ভব। কারণ—
- পরিবারগুলো আর্থিকভাবে সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে
- নিরাপদ কোনো অনুষ্ঠানস্থল নেই
- খাবার, পানি ও পোশাকের সংকট
- পরিবহন ব্যবস্থা ধ্বংস
- ঘরবাড়ি না থাকায় বর-কনের থাকার জায়গা নেই
এমন পরিস্থিতিতে গণবিয়ের উদ্যোগ শুধুই একটি সামাজিক অনুষ্ঠান নয়; এটি ছিল—
- মানবিক সহায়তা
- সামাজিক পুনর্গঠন
- মানুষের মনোবল ফিরিয়ে আনা
- স্বাভাবিক জীবনের প্রতি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা এই উদ্যোগকে “Hope Restoration Event” হিসেবে উল্লেখ করছেন।
গাজ্জার ভবিষ্যৎ—স্বপ্ন নাকি সংগ্রাম?
বিবাহিত দম্পতিরা নতুন জীবন শুরু করলেও তাদের ভবিষ্যৎ এখনো অনিশ্চিত—
- ঘর নেই
- কাজ নেই
- শিক্ষা নেই
- স্বাস্থ্যসেবা নেই
- চলমান আগ্রাসন থামেনি
তবুও আশার আলো জ্বালিয়ে রেখেছে তাদের ভালোবাসা, পারস্পরিক সহায়তা এবং সামাজিক সংগঠনগুলোর উদ্যোগ।
ফিলিস্তিনি মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন—
“এ ধরনের গণবিবাহ মানুষের মনস্তাত্ত্বিক স্থিতি ফিরিয়ে আনে। যুদ্ধবিধ্বস্ত মানুষের জন্য এমন আয়োজন অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।”
সমগ্র গাজ্জায় প্রতীকী উৎসবের মতো
যদিও অনুষ্ঠানটি ছোট পরিসরে ছিল, কিন্তু পুরো গাজ্জার মানুষ এটি দেখেছে আশা ও সাহসের প্রতীক হিসেবে। কেউ বলেছেন—
“ধ্বংসের মাঝেও জীবন থামে না।”
কেউ বলেছেন—
“যুদ্ধ আমাদের ঘর নিতে পারে, কিন্তু ভালোবাসা নিতে পারে না।”
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন এবং আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম এই ঘটনাকে গভীরভাবে উল্লেখ করেছে। তাদের ভাষ্য—
“যুদ্ধের মাঝেও গাজ্জার মানুষ যে সাহসিকতা ও জীবনের প্রতি ভালোবাসা দেখিয়েছে—তা অভাবনীয়।”
গণবিয়ের আসল বার্তা: মানুষ বাঁচতে চায়, ভালোবাসতে চায়
গাজ্জার এই গণবিয়ে শুধু একটি অনুষ্ঠান নয়; এটি বিশ্ববাসীর কাছে একটি বার্তা—
যুদ্ধ কখনো মানবতার চেয়ে শক্তিশালী নয়।
ভালোবাসা, পরিবার, সম্পর্ক এবং স্বপ্ন—এগুলোই মানুষের সবচেয়ে বড় শক্তি।
ইমান ও হিকমতের মতো আরও বহু দম্পতি আজ নতুন জীবনের স্বপ্ন বুকে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।
ধ্বংসস্তুপের মাঝেও তারা খুঁজে নিচ্ছে জীবনের আলো।
গাজ্জার এই গণবিবাহ অনুষ্ঠান প্রমাণ করেছে—
ধ্বংসযজ্ঞ যত বড়ই হোক, মানুষের ভালোবাসা তার চেয়েও বড়।
যুদ্ধ মানুষের ঘর ভাঙতে পারে, কিন্তু হৃদয় ভাঙতে পারে না।
মানবিক সংকটের এমন কঠিন সময়ে এই আয়োজন কেবল একটি সামাজিক অনুষ্ঠান নয়; বরং এটি গাজ্জার মানুষের প্রাণশক্তি, প্রতিরোধ, সাহস এবং আশার প্রতীক।
MAH – 14117 I Signalbd.com



