খ্রিস্টান বিশ্বের প্রধান ধর্মীয় নেতা পোপ লিও চতুর্দশ ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত নিরসনের একমাত্র পথ হিসেবে দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের ওপর জোরালো মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, ‘এই মুহূর্তে ইসরায়েল সেই সমাধান মেনে না নিলেও, এটিই একমাত্র কার্যকর সমাধান যা চলমান সংঘাত নিরসন করতে পারে।’ রবিবার (৩০ নভেম্বর) তুরস্ক থেকে লেবানন যাওয়ার সময় বিমানের মধ্যে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এই মন্তব্য করেন। মধ্যপ্রাচ্যের চরম আঞ্চলিক উত্তেজনার মাঝে তাঁর তুরস্ক ও লেবানন সফর এবং ফিলিস্তিন ইস্যুতে তাঁর স্পষ্ট অবস্থান আন্তর্জাতিক মহলে অত্যন্ত গুরুত্ব পাচ্ছে। পোপের এই বক্তব্য ভ্যাটিকান সিটি ও খ্রিস্টান বিশ্বের পক্ষ থেকে ফিলিস্তিনিদের প্রতি দীর্ঘমেয়াদী সমর্থনের নীতিকেই পুনর্বার নিশ্চিত করল।
দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানই একমাত্র পথ: ভ্যাটিকানের অবস্থান
পোপ লিও চতুর্দশ স্পষ্ট করে দেন যে, ভ্যাটিকান বহু বছর ধরেই ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানকে প্রকাশ্যে সমর্থন করে আসছে। তিনি বলেন, ‘আমরা এটিকে একমাত্র সমাধান হিসেবে দেখি, যা চলমান সংঘাত শেষ করতে পারে।’
এই সমাধান অনুযায়ী, ইসরায়েল রাষ্ট্রের পাশাপাশি একটি স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যেখানে উভয় দেশ শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করবে। পোপ স্বীকার করেছেন যে, এই মুহূর্তে ইসরায়েলের বর্তমান সরকার এই সমাধান মানতে নারাজ। কিন্তু তা সত্ত্বেও, তিনি বিশ্বাস করেন যে এই অঞ্চলে দীর্ঘমেয়াদী শান্তি নিশ্চিত করতে এই রাজনৈতিক কাঠামোটিই অপরিহার্য। তাঁর এই মন্তব্য এমন এক সময়ে এলো, যখন মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাত এবং মানবিক বিপর্যয় বাড়ছে।
তুর্কি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে মতৈক্য ও ফিলিস্তিনের প্রতি সমর্থন
পোপ লিও চতুর্দশ তাঁর তুরস্ক সফরকালে এই সংঘাতপূর্ণ বিষয়টি নিয়ে তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোগানের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। তিনি জানান, ‘এ বিষয়ে প্রেসিডেন্ট এরদোগানের সাথে কথা বলেছি। তিনি আমার সাথে একমত হয়েছেন।’
এর আগে তুরস্ক সফরের সময় ফিলিস্তিনের পক্ষে অবস্থান নেওয়ার জন্য তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোগান পোপের ব্যাপক প্রশংসা করেন। এরদোগান বলেন, ‘ফিলিস্তিন ইস্যুতে পোপের অবস্থান খুবই প্রশংসনীয়। আমরা তাঁর মতামতকে গুরুত্বসহকারে মূল্যায়ন করি।’ মুসলিম বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী নেতা এরদোগান এবং খ্রিস্টান বিশ্বের প্রধান ধর্মীয় নেতার এই মতৈক্য আন্তর্জাতিকভাবে দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের পক্ষে একটি শক্তিশালী কূটনৈতিক ও নৈতিক চাপ সৃষ্টি করবে।
মধ্যপ্রাচ্য সফর ও মানবিকতার বার্তা
পোপ লিও চতুর্দশ চারদিনের তুরস্ক সফর শেষে রোববার লেবাননে পৌঁছান। মধ্যপ্রাচ্যের এই সফর এমন এক সময়ে অনুষ্ঠিত হলো যখন ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত চরম আকার ধারণ করেছে এবং আঞ্চলিক উত্তেজনা বাড়ছে। এই সফরকালে তিনি শান্তি ও মানবিকতার বার্তা দিয়েছেন।
বৈরুতে পৌঁছালে তাঁকে রাষ্ট্রীয় অভ্যর্থনা জানানো হয় এবং সাধারণ জনগণও তাঁকে জাঁকজমকপূর্ণভাবে স্বাগত জানায়। ফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে, ঝুম বৃষ্টির মাঝে বাদ্যের তালে নেচে এবং অভিনব উপায়ে লেবানিজরা পোপ লিওকে বরণ করে নেয়। এই উষ্ণ অভ্যর্থনা মধ্যপ্রাচ্যের জনগণের পক্ষ থেকে তাঁর শান্তির বার্তার প্রতি সমর্থনের প্রতীক।
তুরস্কে পোপের অন্যান্য কার্যক্রম ও ধর্মীয় ঐক্য
তুরস্ক সফরের সময় পোপ লিও চতুর্দশ আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি এবং খ্রিস্টান ঐক্যের ওপর জোর দেন। সফরের অংশ হিসেবে তিনি ইস্তাম্বুলের ঐতিহাসিক নীল মসজিদ (সুলতান আহমেদ মসজিদ) পরিদর্শন করেন, যেখানে তিনি মুসলিম রীতিনীতি মেনে জুতো খুলে প্রবেশ করেন এবং নীরব প্রার্থনা করেন।
এছাড়াও, তিনি ক্যাথলিক ও অর্থডক্স চার্চের সম্মিলিত গণপ্রার্থনায় অংশ নেন। বিশ্ব অর্থোডক্স খ্রিস্টানদের আধ্যাত্মিক নেতা প্যাট্রিয়ার্ক বার্থোলোমিউ-১ এর সঙ্গে এক বৈঠকে তিনি ‘ভ্রাতৃত্বমূলক সম্পর্ক’ এবং ‘ধর্মের নামে হিংসা প্রত্যাখ্যানের’ বিষয়ে যৌথ ঘোষণা স্বাক্ষর করেন। এই কার্যক্রমগুলো ধর্মীয় বিভাজন দূর করে ঐক্যের বার্তা দিয়েছে।
নৈতিক নেতৃত্বের প্রভাব
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, পোপের এই জোরালো অবস্থান কেবল ধর্মীয় নয়, বরং নৈতিক নেতৃত্বের একটি প্রকাশ। ইসরায়েল যখন সামরিক এবং কূটনৈতিকভাবে ফিলিস্তিন ইস্যুতে কঠোর অবস্থান বজায় রেখেছে, তখন পোপের মতো একজন বিশ্বনেতার প্রকাশ্যে দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের পক্ষে কথা বলা আন্তর্জাতিক জনমত গঠনে প্রভাব ফেলবে।
পোপের মন্তব্যটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নীতির প্রতি সমর্থন জানালেও, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ও তাঁর সরকার দীর্ঘদিন ধরে এই সমাধানের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে আসছে। এই পরিস্থিতিতে, পোপের মতো প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বের আহ্বান আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ফিলিস্তিন সংকট সমাধানে আরও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে উৎসাহিত করতে পারে। ফিলিস্তিনিদের জন্য এটি একটি আশার আলো হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
শান্তির পথে এগিয়ে যাওয়া
পোপ লিও চতুর্দশের ‘দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানই একমাত্র পথ’ মন্তব্যটি মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য একটি স্পষ্ট নির্দেশিকা। ইসরায়েল এই মুহূর্তে সমাধান না মানলেও, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক চাপের মুখে এই নীতিই প্রতিষ্ঠিত হবে বলে আন্তর্জাতিক মহল মনে করে। পোপের তুরস্ক ও লেবানন সফর এবং তাঁর মানবিক আবেদন সংঘাতপূর্ণ এই অঞ্চলে শান্তি ও সহাবস্থান ফিরিয়ে আনার জন্য একটি নৈতিক এবং কূটনৈতিক প্রচেষ্টা হিসেবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর এই বার্তা এটাই প্রমাণ করে যে, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতৃত্বকে অবশ্যই সংঘাত নিরসনে একটি সুদূরপ্রসারী ও ন্যায্য সমাধান খুঁজে বের করতে হবে।
এম আর এম – ২৪৪৫,Signalbd.com



