ফিলিস্তিনের গাজ্জা উপত্যকায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পরও পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হয়নি। বরং বোমা, ড্রোন, শেলিং এবং স্থল হামলার মাত্রা অনেক এলাকাতেই বজায় রেখেছে ইসরাইলি বাহিনী। ফলে যুদ্ধবিরতির নামে যে বিরতি কার্যকর হয়েছে, তা শুধু রাজনৈতিক বিবৃতিতে; বাস্তবে গাজ্জার আকাশে, মাটিতে ও সীমান্তরেখায় এখনো বিরামহীন আগ্রাসনই চলছে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হালনাগাদ তথ্য বলছে—এই ধারাবাহিক হামলায় মৃত্যুর সংখ্যা পার হয়েছে ৭০ হাজারের মর্মান্তিক সীমা। যুদ্ধবিরতির পরও নতুন করে নিহত হচ্ছে নারী, শিশু এবং বৃদ্ধসহ নিরীহ বেসামরিক মানুষ।
মধ্যপ্রাচ্যের সাম্প্রতিক ইতিহাসে এমন নৃশংসতার নজির নেই বললেই চলে।
যুদ্ধবিরতি, কিন্তু কাগজে–কলমে
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া ইসরাইল–হামাস সংঘাত মধ্যপ্রাচ্যকে এক অনিরাপদ অধ্যায়ে ঠেলে দেয়। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ২০২৫ সালের ১০ অক্টোবর থেকে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। কিন্তু এই ‘যুদ্ধবিরতি’ গাজ্জার মানুষের কাছে ছিল কেবল ঘোষণায়।
গাজ্জা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন:
- মোট নিহত: ৭০,১০০ জন
- শুধু যুদ্ধবিরতির পর নিহত: অন্তত ৩৫০ জন
- মোট আহত: ১ লাখ ৭০ হাজারেরও বেশি
এই সংখ্যা প্রতিদিন আরও বাড়ছে।
অধিকাংশ হামলাই হচ্ছে আবাসিক এলাকা, আশ্রয়কেন্দ্র, বাজার, রাস্তাঘাট এবং স্কুলের আশপাশে—যেখানে যুদ্ধবিরতির সময় সবচেয়ে বেশি বেসামরিক মানুষের সমাগম থাকে।
খান ইউনিসে দুই ভাইয়ের মৃত্যু: যুদ্ধবিরতির বাস্তব চিত্র
২৯ নভেম্বর সকালে দেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর খান ইউনিসে, বানি সুফাইলা এলাকায় আল–ফারাবি স্কুলের কাছে বেসামরিকদের ওপর ইসরাইলি ড্রোন হামলা হয়।
এই হামলায় জুমা তামের আবু আসসি এবং ফাদি তামের আবু আসসি—দুই সহোদর ফিলিস্তিনি শিশু নিহত হয়। তারা তখন স্কুলের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল।
দৃশ্যের বর্ণনা (স্থানীয় সূত্রে জানা):
- স্কুল গেটের সামনে বাচ্চাদের ভিড় ছিল
- হঠাৎ ড্রোন থেকে নিক্ষেপিত ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানে
- ঘটনাস্থলেই তারা গুরুতর আহত হয়
- নাসের মেডিকেল কমপ্লেক্সে নেওয়ার পর মৃত্যু হয় দুই ভাইয়ের
শিশুদের রক্তে রক্তাক্ত হয়ে ওঠা সেই রাস্তার ছবি মুহূর্তেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এই হত্যাকাণ্ড যুদ্ধবিরতির কাগুজে বাস্তবতার নির্মম চিত্র হিসেবে বিশ্বব্যাপী আলোচনার জন্ম দেয়।
একদিনে চারটি হামলা: বিভিন্ন শহরে তাণ্ডব
একই দিনে গাজ্জার বিভিন্ন স্থানে একাধিক হামলা চালায় ইসরাইলি বাহিনী।
১. আল–কারারা শহর
গোলাবর্ষণ ও বিমান হামলায় অন্তত তিনজন আহত। তাদের মধ্যে দুজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
২. গাজ্জা সিটির তুফাহ এলাকা
এর আগেও বহুবার হামলার শিকার এই ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাটি আবারও লক্ষ্য করে আঘাত হানে ইসরাইলি ড্রোন। বেসামরিকদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
৩. রাফাহর পূর্বাঞ্চল
যুদ্ধবিরতির পরও রাফাহ ছিল অপেক্ষাকৃত শান্ত, কিন্তু গত কয়েক দিনে এখানেও নতুন করে হামলা হয়েছে। রাফাহ সীমান্ত দিয়েই মানবিক সহায়তা আসে—সেই পথকেও ইসরাইল বারবার লক্ষ্য করছে।
ইয়েলো লাইন-এর বাইরে ড্রোন হামলা: কোনো নিরাপদ অঞ্চল নেই
যুদ্ধবিরতির অংশ হিসেবে কিছু অঞ্চলকে ‘ইয়েলো লাইন’ হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছিল—যা বেসামরিকদের জন্য নিরাপদ হিসেবে বিবেচিত। কিন্তু সেখানেও হামলা থামেনি।
একদিন আগেই নাসের মেডিকেল কমপ্লেক্স নিশ্চিত করে, বানি সুফাইলা এলাকায় এই নির্ধারিত ইয়েলো লাইন–এর বাইরে ইসরাইলি ড্রোন হামলায় একজন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে।
এতে পরিষ্কার—গাজ্জায় কোনো এলাকা নিরাপদ নয়।
ইসরাইলের ৫৩৫ বার যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন
গাজ্জা সরকারের গণমাধ্যম কার্যালয়ের প্রধান ইসমাইল আল–থাওয়াবতা জানান:
- যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর থেকে ইসরাইল কমপক্ষে ৫৩৫ বার এ চুক্তি লঙ্ঘন করেছে
- প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন অঞ্চলে ড্রোন হামলা, গোলাবর্ষণ এবং স্নাইপার শুটিং ঘটছে
- বেসামরিক অবকাঠামো, স্কুল, হাসপাতাল, বাজার এবং আশ্রয়কেন্দ্র—সবই আগ্রাসনের শিকার
ইসমাইল আল–থাওয়াবতা বলেন,
“গাজ্জার মানবিক পরিস্থিতি নজিরবিহীন মাত্রায় অবনতির দিকে যাচ্ছে। অবকাঠামো, চিকিৎসা ব্যবস্থা, জরুরি সেবা—সব কিছু ধ্বংস করে দিয়েছে ইসরাইলি বাহিনী।”
মানবিক বিপর্যয়: গাজ্জা বাসিন্দারা কোথায় দাঁড়িয়ে
১. খাদ্য সংকট মারাত্মক
যুদ্ধবিরতির পরও খাদ্যসহায়তা প্রবেশ করছে সীমিত পরিমাণে। প্রচণ্ড ভিড়, রাস্তায় অবরোধ এবং ধারাবাহিক হামলার কারণে মানুষ খাদ্য সংগ্রহ করতেই পারছে না।
২. চিকিৎসা ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে
- হাসপাতালগুলোর প্রায় সব বেডই পূর্ণ
- ওষুধ নেই
- রক্ত নেই
- অস্ত্রোপচারের সরঞ্জাম নেই
- চিকিৎসকের ঘাটতি ভয়াবহ
নাসের মেডিকেল কমপ্লেক্স, আল–শিফা, আল–কুদস—সব হাসপাতালই ধ্বংস বা আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত।
৩. পানি ও বিদ্যুৎ সংকট
গাজ্জার বেশিরভাগ এলাকায়:
- বিশুদ্ধ পানি নেই
- বিদ্যুৎ ২০ দিনেরও বেশি সময় ধরে নেই
- সোলার প্যানেলও ধ্বংস
মানুষ বৃষ্টির পানি কিংবা লবণাক্ত পানি ফুটিয়ে ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছে।
৪. বাস্তুচ্যুতির সংখ্যা অভূতপূর্ব
গাজ্জার মোট জনসংখ্যার প্রায় ৮০ শতাংশই বাস্তুচ্যুত।
পরিবারগুলো কয়েকবার করে আশ্রয় বদল করছে।
এখনো অনেকেই ধ্বংসস্তূপে বসবাস করছে।
শিশুহত্যার ভয়াবহতা: যুদ্ধের সবচেয়ে করুণ অধ্যায়
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন জানিয়েছে:
- নিহতদের প্রায় ৪০ শতাংশ শিশু ও নারী
- গাজ্জায় জন্ম নেওয়া নবজাতকদের বেশিরভাগই অপুষ্টি ও সংক্রমণে ভুগছে
- ইনকিউবেটরের বিদ্যুৎ না থাকায় বহু শিশুর মৃত্যু হয়েছে
জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) বলেছে,
“গাজ্জা এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় শিশু–সমাধিক্ষেত্র।”
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া: নিন্দা থাকলেও কার্যকর পদক্ষেপ নেই
যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন ও বেসামরিক হত্যাযজ্ঞের কারণে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সমালোচনার ঝড় উঠেছে।
তবে বড় শক্তিগুলোর অবস্থান এখনো বিভাজিত।
জাতিসংঘ:
- মানবিক সহায়তা আরও বাড়ানোর আহ্বান
- যুদ্ধবিরতি কার্যকর করতে ইসরাইলকে সতর্কতা
- তদন্তের দাবি
ইউরোপীয় ইউনিয়ন:
নিন্দা জানালেও অস্ত্র সরবরাহ বা কঠোর নিষেধাজ্ঞার মতো সিদ্ধান্ত নেয়নি।
আরব দেশসমূহ:
বেশিরভাগ দেশ বিবৃতি দিয়েছে, তবে সামরিক বা অর্থনৈতিক চাপ তৈরির মতো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না।
মধ্যপ্রাচ্যের বিশ্লেষকদের মতে,
“গাজ্জায় যা ঘটছে, তা স্পষ্ট মানবাধিকার লঙ্ঘন, কিন্তু আন্তর্জাতিক নীরবতা এই সংকটকে আরও দীর্ঘায়িত করছে।”
ইসরাইলের দাবি বনাম বাস্তবতা
ইসরাইল দাবি করছে তারা কেবল ‘সন্ত্রাসী লক্ষ্যবস্তু’তে হামলা করছে।
কিন্তু বাস্তবতা হলো:
- হামলার ৯০ শতাংশই আবাসিক এলাকায়
- নিহতদের বড় অংশ বেসামরিক
- শত শত শিশু প্রতিদিন হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে
- স্কুল, মসজিদ, বাজার, এমনকি জাতিসংঘ আশ্রয়কেন্দ্রও টার্গেট করা হচ্ছে
এই বাস্তবতা প্রমাণ করে—ইসরাইলের আগ্রাসন সামরিক নয়, বরং মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করার দিকে লক্ষ্য করে চলছে।
আগামীর গাজ্জা: কোন পথে পরিস্থিতি
বর্তমান পরিস্থিতিতে গাজ্জা তিন মহাবিপদের মুখে:
১. মানবিক দুর্ভিক্ষ
খাদ্য নেই, পানি নেই, চিকিৎসা নেই—এই তিন ঘাটতি বড় দুর্ভিক্ষে পরিণত হওয়ার শঙ্কা বাড়ছে।
২. স্বাস্থ্য বিপর্যয়
সংক্রমণ, পানিবাহিত রোগ, ক্ষত–পচন, অপুষ্টি—সব মিলিয়ে একটি বড় মহামারি দেখা দিতে পারে।
৩. রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা
গাজ্জা কার নিয়ন্ত্রণে থাকবে, কোন কাঠামোতে শাসন চলবে—এই প্রশ্ন এখনো জটিল।
যুদ্ধবিরতির পরও গাজ্জায় যে আগ্রাসন চলছে, তা আন্তর্জাতিক নীতিমালা, মানবাধিকার এবং যুদ্ধবিরতি চুক্তির সরাসরি লঙ্ঘন।
৭০ হাজারের বেশি প্রাণহানি, লাখো মানুষের বাস্তুচ্যুতি, শিশুদের মৃত্যু, হাসপাতাল ধ্বংস—এগুলো পৃথিবীর বিবেককে নাড়া দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।
তবুও আগ্রাসন থামছে না।
গাজ্জার মানুষ আজও বেঁচে থাকার লড়াই করছে। তাদের চোখে একমাত্র আশা—বিশ্ব একদিন সত্যিকারের ন্যায় প্রতিষ্ঠা করবে।
MAH – 14049 I Signalbd.com



