বিশ্ব

পাকিস্তানের আফগানিস্তানে হামলার পেছনে দুইটি উদ্দেশ্য: মাওলানা মুজাহিদ

Advertisement

আবারও উত্তপ্ত আফগান-পাকিস্তান সীমান্ত

দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি আরও একবার উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে আফগানিস্তানের অভ্যন্তরে পাকিস্তানের সামরিক বিমান হামলাকে কেন্দ্র করে। এই হামলা ঘিরে দুই দেশের সম্পর্ক উত্তেজনার নতুন স্তরে পৌঁছেছে। তালেবান সরকারের মুখপাত্র মাওলানা জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ পাকিস্তানের এ হামলাকে ‘সার্বভৌমত্বের সরাসরি লঙ্ঘন’ বলে উল্লেখ করে কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তাঁর মতে, পাকিস্তানের এই পদক্ষেপের পেছনে রয়েছে দুইটি সুস্পষ্ট কৌশলগত উদ্দেশ্য।

একটি টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন—
“পাকিস্তানের হামলার পিছনে দুটি লক্ষ্য রয়েছে। প্রথমত, তারা একটি বিদেশি প্রক্সি এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে। দ্বিতীয়ত, তারা নিজেদের সেনাবাহিনীর অক্ষমতা ঢাকতে চাইছে।”

এই মন্তব্য প্রকাশের পর আন্তর্জাতিক মহলেও আলোচনার ঝড় উঠেছে—পাকিস্তানের উদ্দেশ্য আসলে কী? দুই দেশের সম্পর্ক কোন পথে যাচ্ছে? এই উত্তেজনা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতায় কী প্রভাব ফেলতে পারে?

Signalbd.com-এর পাঠকদের জন্য নিচে তুলে ধরা হলো পুরো ঘটনা, বিশ্লেষণ এবং সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ প্রেক্ষাপট।

পাকিস্তানের বিমান হামলা: ঘটনার বিবরণ

সাম্প্রতিক সপ্তাহে পাকিস্তানের বিমান বাহিনী আফগানিস্তানের ভেতরের কয়েকটি এলাকাকে লক্ষ্য করে একাধিক হামলা চালায়। পাকিস্তানের দাবি—এই হামলা তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি) বা অন্যান্য সশস্ত্র গোষ্ঠীর ঘাঁটি লক্ষ্য করে পরিচালিত।

আফগানিস্তান সরকার এই দাবি স্পষ্টভাবে প্রত্যাখ্যান করে বলেছে, পাকিস্তান তাদের নিজস্ব ব্যর্থতার দায় অন্যের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে এবং রাজনৈতিকভাবে নিজেদের জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে।

তালেবান মুখপাত্র মুজাহিদ বলেন,
“তারা আমাদের নাগরিক, আমাদের ভূমি, আমাদের সার্বভৌমত্বকে অবমাননা করছে। আমরা এটি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারি না।”

মুজাহিদের অভিযোগ: বিদেশি শক্তির প্রক্সি হিসেবে কাজ করছে পাকিস্তান

তালেবান মুখপাত্র প্রথম যে উদ্দেশ্যের কথা বলেন তা হলো—বিদেশি শক্তির প্রক্সি এজেন্ডা বাস্তবায়ন

১. বিদেশি কৌশলের অংশ পাকিস্তান?

মুজাহিদের মতে, পাকিস্তান নিজের স্বার্থে নয়; বরং আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক শক্তির চাপ, পরামর্শ ও নির্দেশনায় আফগানিস্তানে হামলার মতো পদক্ষেপ নিচ্ছে।
বিশ্লেষকদের মতে, পাকিস্তানের ঐতিহাসিকভাবে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, সৌদি আরবসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রের সঙ্গে নিরাপত্তা ও কৌশলগত সম্পর্ক রয়েছে। পরিবর্তিত বৈশ্বিক ভূরাজনীতির প্রেক্ষাপটে পাকিস্তান হয়তো একাধিক পক্ষের চাপের মুখে রয়েছে।

২. তালেবান সরকারকে দুর্বল করার চেষ্টা

অভ্যন্তরীণ বিশ্লেষণ বলছে, কিছু রাষ্ট্র তালেবান সরকারের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়ার প্রক্রিয়া ধীর করতে চায়। আফগানিস্তানে সামরিক চাপ দিয়ে দেশটিকে অস্থিতিশীল দেখানোর চেষ্টা থাকতে পারে।
মুজাহিদ ইঙ্গিত দিয়েছেন—পাকিস্তান এই খেলায় একটি কৌশলগত ‘টুল’ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

দ্বিতীয় উদ্দেশ্য: পাক সেনাবাহিনীর ব্যর্থতা ঢাকার চেষ্টা

মুজাহিদ যে দ্বিতীয় উদ্দেশ্যের কথা তুলে ধরেছেন, সেটি আরও সরাসরি এবং পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত।

১. পাকিস্তানের ভেতরে বাড়ছে সন্ত্রাসী হামলা

গত কয়েক বছর ধরে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে টিটিপি ও অন্যান্য গোষ্ঠীর হামলা বেড়েছে। কাইবার-পাখতুনখোয়া, বালুচিস্তানসহ সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে প্রায়ই সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে হামলা ঘটে। এতে বহু সেনা সদস্য নিহত হয়।

২. সেনাবাহিনীর উপর জনআস্থার সংকট

পাকিস্তানের সাধারণ জনগণের মধ্যে একটি ধারণা জোরালো হচ্ছে—সেনাবাহিনী নিরাপত্তা পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক দুরবস্থা ও কূটনৈতিক চাপের মধ্যেও এই ব্যর্থতা আরও প্রকট।

৩. ব্যর্থতা ঢাকতে ‘বহিরাগত শত্রু’ তৈরির কৌশল

মুজাহিদের ভাষায়—
“নিজেদের ব্যর্থতা লুকাতে এবং জনগণের মনোযোগ অন্যদিকে সরাতে পাকিস্তান বাহ্যিক শত্রু প্রদর্শনের পন্থা নিয়েছে।”

এ ধরনের কৌশল আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে অচেনা নয়। কোনো রাষ্ট্র অভ্যন্তরীণ সংকটে পড়লে বহিরাগত হুমকির গল্প সামনে আনা অনেক সরকারই ব্যবহার করে থাকে।

কেন বারবার আফগানিস্তানকেই লক্ষ্য করে পাকিস্তান?

পাকিস্তান বহু বছর ধরে আফগান সীমান্তবর্তী এলাকাকে ‘অনিরাপদ অঞ্চল’ হিসেবে বিবেচনা করে আসছে। কেন?

১. টিটিপির কার্যক্রম: পাকিস্তানের দাবি—টিটিপি আফগান ভূখণ্ড ব্যবহার করে পাকিস্তানে হামলা চালায়।
২. দীর্ঘ সীমান্ত: আফগানিস্তান-পাকিস্তান সীমান্ত (ডুরান্ড লাইন) প্রায় ২৬০০ কিলোমিটার, নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন।
৩. গোত্রভিত্তিক এলাকা: সীমান্তের উভয়পাশেই পশতুন সম্প্রদায়ের বাস, যারা ঐতিহাসিকভাবে দুই দেশের মধ্যে যাতায়াত করে।
৪. রাজনৈতিক টানাপোড়েন: তালেবান সরকারের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক বারবার উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে গেছে।

তবে আফগান সরকার শক্ত ভাষায় বলছে—পাকিস্তান বাস্তবে নিজের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতার দায় অন্যের ওপর চাপাতে চাইছে।

আফগানিস্তানের প্রতিক্রিয়া: “সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন, জবাব দেওয়া হবে”

মাওলানা মুজাহিদ স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন—
“আমাদের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘিত হয়েছে। এর জবাব আমরা দেব।”

তবে প্রতিক্রিয়ার ধরন সম্পর্কে তিনি বিস্তারিত কিছু জানাননি। বিশ্লেষকরা বলছেন—

আফগানিস্তানের তিনটি সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া থাকতে পারে:

১. কূটনৈতিক চাপ: আন্তর্জাতিক সংগঠন, বিশেষ করে ওআইসি ও জাতিসংঘে বিষয়টি তুলে ধরা।
২. অর্থনৈতিক চাপ: সীমান্ত বন্ধ করা, বাণিজ্যিক রুট নিয়ন্ত্রণ।
৩. সামরিক বা সীমান্ত নিরাপত্তা জোরদার: সীমান্তে অতিরিক্ত বাহিনী মোতায়েন বা পাল্টা হামলার ইঙ্গিত।

তালেবান সরকার বারবার বলেছে, তারা যুদ্ধ চায় না, তবে সার্বভৌমত্ব রক্ষায় কোনো ছাড় দেবে না।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও ভূরাজনীতির জটিলতা

ঘটনা প্রকাশের পর ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক মহলের নজর এই অঞ্চলে।

১. জাতিসংঘের উদ্বেগ

জাতিসংঘ বলেছে, দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধির ফলে মানবিক পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। আফগানিস্তান ইতিমধ্যেই খাদ্য সংকট ও দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়ছে।

২. চীনের ভূমিকা

চীন পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ মিত্র হলেও আফগানিস্তানে তাদের বিনিয়োগ (বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ, খনিজ—বিশেষত লিথিয়াম প্রকল্প) রক্ষার স্বার্থেও শান্তি চায়। তাই চীনের মধ্যস্থতার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

৩. যুক্তরাষ্ট্র

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক বহুদিন ধরেই ওঠা-নামা করছে। তবে আফগানিস্তানে তালেবান শাসন প্রতিষ্ঠার পর যুক্তরাষ্ট্র এই অঞ্চলে প্রতিটি সংঘাতকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে।

দুই দেশের জনগণের অবস্থান: যুদ্ধ চায় না কেউই

মূলত আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ এই উত্তেজনায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

  • সীমান্ত বাণিজ্য বন্ধ হলে অর্থনীতি সংকটে পড়ে
  • শরণার্থী সমস্যা বাড়ে
  • নিরাপত্তা ঝুঁকি বাড়ে
  • দৈনন্দিন জীবন স্থবির হয়ে পড়ে

পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সাধারণ মানুষ বহু শতাব্দি ধরে একই সংস্কৃতি, ভাষা ও গোত্রের অংশ। তারা কেউই যুদ্ধ বা সংঘাত চায় না। কিন্তু রাজনৈতিক ও সামরিক সিদ্ধান্তে সাধারণ মানুষই ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

টিটিপি—দুই দেশের জন্যই একটি যৌথ সংকট

টিটিপি বা তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তানকে কেন্দ্র করে সবচেয়ে বড় ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি হয়েছে।
আফগানিস্তান বলছে—তারা কোনো গোষ্ঠীকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে দেবে না।
পাকিস্তান বলছে—আফগানিস্তান টিটিপিকে আশ্রয় দিচ্ছে।

এ নিয়ে দুই দেশের মধ্যে গভীর অবিশ্বাস কাজ করছে।
বিশ্লেষকদের মতে, যৌথ সমন্বয় ছাড়া এই সংকট সমাধান অসম্ভব।

কী হতে পারে ভবিষ্যৎ?

এই হামলার ফলে দুই দেশের সম্পর্ক আরও খারাপ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
তবে বড় সংঘাতে জড়িয়ে পড়া উভয় দেশের জন্যই ক্ষতিকর।

সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি:

১. কূটনৈতিক আলোচনায় ফিরে আসা
– আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতায় দুই দেশ সীমান্ত নিরাপত্তা নিয়ে যৌথ কমিটি গঠন করতে পারে।

২. সামরিক উত্তেজনা আরও বাড়া
– সীমান্তে ছোটখাটো সংঘর্ষ, পাল্টা হামলা বা বাণিজ্য স্থগিত হতে পারে।

৩. মানবিক সংকট বৃদ্ধি
– আফগানিস্তানের ভেতরে শরণার্থী প্রবাহ বাড়তে পারে।

৪. আন্তর্জাতিক ভূরাজনৈতিক শক্তি আরও সক্রিয় হওয়া
– চীন, ইরান, তুরস্ক, রাশিয়া—প্রত্যেকে অঞ্চলে নিজেদের প্রভাব বাড়ানোর চেষ্টা করতে পারে।

শান্তির পথেই স্থিতিশীলতা

মাওলানা জাবিহুল্লাহ মুজাহিদের বক্তব্য শুধু পাকিস্তান-বিরোধী নয়, বরং পুরো অঞ্চলের জন্য একটি সতর্কবার্তা। তিনি স্পষ্টই বলেছেন—
“আমরা যুদ্ধ চাই না। তবে সার্বভৌমত্ব রক্ষায় প্রতিটি দেশের অধিকার রয়েছে।”

দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতা, অর্থনীতি, নিরাপত্তা—সবকিছুই নির্ভর করছে দুই দেশের বিচক্ষণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ওপর।
দীর্ঘ লড়াই, চাপ, প্রক্সি যুদ্ধ ও রক্তক্ষয় আর নয়—এটাই সাধারণ মানুষের আকাঙ্ক্ষা।

আঞ্চলিক শান্তি, সীমান্ত নিরাপত্তা ও পারস্পরিক আস্থাই পারে এই সংকটের সমাধান দিতে।

MAH – 14025 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button