আফ্রিকার পশ্চিমাঞ্চলের ক্ষুদ্র উপকূলীয় দেশ গিনি-বিসাউ আবারও রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে ডুবে গেছে। দেশটির সেনাবাহিনী হঠাৎ এক ঘোষণায় রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের ঘোষণা দেয় এবং সামরিক কমান্ড পুরো দেশ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে। বুধবার স্থানীয় সময় রাতে দেশটির রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে প্রচারিত এক ঘোষণায় সেনাবাহিনী নিজেদের “রাষ্ট্রের শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার বিষয়ক উচ্চ সামরিক কমান্ড” হিসেবে পরিচয় দেয় এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়া স্থগিত, সীমান্ত বন্ধ, রাতভর কারফিউ, এমনকি ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণের নির্দেশ দেয়।
দেশটির রাজনৈতিক ইতিহাসে এ ধরনের সামরিক হস্তক্ষেপ নতুন নয়, তবে এ বছরের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পরপরই এমন পরিস্থিতি আবারও দেশটিকে অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দিয়েছে।
নির্বাচনে বিজয়ী ঘোষণার একদিন পরেই সেনা অভ্যুত্থান
আল জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সম্ভাব্য বিজয়ী হিসেবে উমারো সিসোকো এম্বালো–এর নাম ঘোষণা হওয়ার মাত্র একদিন পরেই সামরিক বাহিনীর একটি অংশ ক্ষমতা দখলের ঘোষণা দেয়। সামরিক কমান্ড টেলিভিশনে জানায়—
“রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, সার্বভৌমত্ব ও স্থিতিশীলতা রক্ষার স্বার্থে আমরা দেশের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেছি।”
এই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই নির্বাচন কমিশনের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। রবিবার অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ফল প্রকাশ হওয়ার কথা ছিল বৃহস্পতিবার। এই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছিলেন বর্তমান রাষ্ট্রপতি উমারো সিসোকো এম্বালো এবং প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ফার্নান্দো ডায়াস।
কিন্তু ফল ঘোষণার আগেই দেশজুড়ে সশস্ত্র সংঘর্ষ, গুলিবর্ষণ এবং ক্ষমতা দখলের ঘটনা ঘটে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।
রাজধানীতে গুলির শব্দ, দফতর ঘেরাও—তারপরই সেনাবাহিনীর ঘোষণা
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, ভোটের পরদিন থেকেই গিনি-বিসাউয়ের রাজধানী বিসাউয়ের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় উত্তেজনা বাড়তে থাকে। নির্বাচন কমিশনের কার্যালয়, রাষ্ট্রপতি প্রাসাদ এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আশপাশে রাতভর ভারী অস্ত্রের গুলির শব্দ শোনা যায়।
এই সংঘর্ষের মধ্যেই সামরিক কর্মকর্তাদের একটি দল রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের নিয়ন্ত্রণ নেয় এবং সেনা শাসনের ঘোষণা দেয়।
রাষ্ট্রপতি এম্বালো আটক—বিরোধীদলীয় নেতাও গ্রেপ্তার
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম নিশ্চিত করেছে যে, বর্তমান রাষ্ট্রপতি উমারো সিসোকো এম্বালোকে সেনাবাহিনী গ্রেপ্তার করেছে। সেনেগাল থেকে আল জাজিরার প্রতিনিধি নিকোলাস হক জানান—
“আমাদের সূত্র নিশ্চিত করেছে যে, রাষ্ট্রপতি এখন সেনাবাহিনীর হেফাজতে। একই সঙ্গে প্রধান বিরোধীদল পিএআইজিসি–র নেতা ডোমিঙ্গোস সিমোয়েস পেরেইরাকেও আটক করা হয়েছে।”
নিকোলাস হক আরও জানান, সেনাবাহিনী দেশজুড়ে ইন্টারনেট বন্ধের চেষ্টা করছে এবং জনগণকে ঘরে থাকার নির্দেশ দিয়েছে।
অভ্যুত্থানের নেতৃত্বে ছিলেন প্রেসিডেন্টের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা প্রধান
এই সামরিক অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিয়েছেন এমন এক সেনা কর্মকর্তা যার ওপরই রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তার দায়িত্ব ছিল। তার নাম ডেনিস এন’কানহা। তিনি জাতীয় রক্ষীবাহিনীর প্রধান এবং রাষ্ট্রপতির ঘনিষ্ঠ নিরাপত্তা কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, রাষ্ট্রপতির এতই ঘনিষ্ঠ একজন অফিসারের নেতৃত্বে অভ্যুত্থান হওয়া বিষয়টিকে আরও জটিল করেছে। দেশটির নিরাপত্তা কাঠামো ভেতর থেকেই বিভক্ত হয়ে পড়েছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে।
গিনি-বিসাউ: অভ্যুত্থানের দীর্ঘ ইতিহাস
গিনি-বিসাউ আফ্রিকার পশ্চিম উপকূলের ছোট কিন্তু ভূ-রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি দেশ। দেশটি ১৯৭৪ সালে পর্তুগালের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জন করে। কিন্তু স্বাধীনতার পরপরই শুরু হয় রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সামরিক অভ্যুত্থানের ধারা।
গবেষণা অনুযায়ী—
- ১৯৮০ সাল থেকে আজ পর্যন্ত দেশটিতে একাধিক সামরিক অভ্যুত্থান ঘটেছে।
- ১৯৯৮–১৯৯৯ সালে গৃহযুদ্ধের সময় দেশটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
- ২০১২ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের মধ্যেই সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করে।
- ২০২২ সালেও এম্বালো সরকারের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের চেষ্টা হয়েছিল, তবে তা ব্যর্থ হয়।
অত্যন্ত দুর্বল নিরাপত্তা কাঠামো, দলীয় দ্বন্দ্ব, মাদকপাচারের প্রভাব এবং দুর্নীতি—এসব কারণে দেশটি সবসময় থেকেই রাজনৈতিকভাবে নাজুক অবস্থায় ছিল।
নির্বাচনকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা: কেন ভেঙে পড়ল রাজনৈতিক স্থিতি?
২০২৫ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ—
- এম্বালো সরকার নানা দুর্নীতির অভিযোগে বিদ্ধ ছিল।
- বিরোধী দল পিএআইজিসি সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলেছিল।
- জনগণের একটি বড় অংশ পরিবর্তন চেয়েছিল।
এই পরিস্থিতিতে নির্বাচনে উত্তেজনা চরমে পৌঁছে। ফল ঘোষণার আগেই সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের জন্যও ছিল অপ্রত্যাশিত। অনেকে মনে করেন, সেনাবাহিনী আগেই রাজনৈতিক বিভাজনের সুযোগ নিয়ে ক্ষমতা দখলের পরিকল্পনা করেছিল।
সীমান্ত বন্ধ, দেশজুড়ে কারফিউ—জনজীবনে অস্থিরতা
সেনাবাহিনী ক্ষমতা নেওয়ার পর থেকে গিনি-বিসাউয়ের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা প্রায় থমকে গেছে। সামরিক কমান্ড ঘোষণা করেছে—
- স্থল, আকাশ, সমুদ্র—সব সীমান্ত বন্ধ
- রাতভর কারফিউ
- রাজধানীতে ভারী টহল
- গণমাধ্যম ও ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণ
- রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেপ্তার
- সরকারি অফিস নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনী
এতে সাধারণ মানুষের মধ্যে তীব্র আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া: আফ্রিকায় আবারও সেনা শাসনের উত্থান উদ্বেগজনক
আন্তর্জাতিক মহল ঘটনাটিকে উদ্বেগজনক হিসেবে দেখছে। পশ্চিম আফ্রিকার আঞ্চলিক সংস্থা ইকোয়াস (ECOWAS) এবং আফ্রিকান ইউনিয়ন দ্রুত পরিস্থিতি ‘স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরানোর’ আহ্বান জানিয়েছে।
২০২০–২০২৫ সময়কালে শুধু পশ্চিম আফ্রিকাতেই কমপক্ষে ৭টি দেশে সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছে—
- মালি
- গিনি
- নাইজার
- বুর্কিনা ফাসো
- গ্যাবন
- চাদ
- এবং এবার গিনি-বিসাউ
বিশ্লেষকদের মতে, এই ধারাবাহিক সামরিক অভ্যুত্থান আফ্রিকার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য হুমকি তৈরি করছে।
গিনি-বিসাউ: ভূগোল, অর্থনীতি ও কৌশলগত গুরুত্ব
- পশ্চিম আফ্রিকার উপকূলীয় দেশ
- উত্তরে সেনেগাল
- পূর্ব–দক্ষিণে গিনি
- পশ্চিমে আটলান্টিক মহাসাগর
- সমুদ্রে প্রায় ৬০টির বেশি দ্বীপ রয়েছে
- এর মধ্যে বিসাগোস দ্বীপপুঞ্জ অন্যতম—যা ইউনেস্কো স্বীকৃত সংরক্ষিত অঞ্চল
অর্থনৈতিকভাবে দেশটি খুবই দুর্বল। প্রধান অর্থনৈতিক উৎস—
- কাজুবাদাম
- মৎস্যসম্পদ
- চাষাবাদ
- বিদেশি সাহায্য
রাষ্ট্রের দুর্বল অর্থনীতি ও নিরাপত্তাহীনতা দেশটিকে আন্তর্জাতিক অপরাধচক্র, বিশেষ করে মাদক পাচারের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ রুটে পরিণত করেছে। অনেকে মনে করেন, এ কারণেও সেনাবাহিনীর ভেতরে বিভিন্ন গোষ্ঠীর স্বার্থ জড়িত।
পরবর্তী পরিস্থিতি: দেশ কোন পথে যাচ্ছে?
গিনি-বিসাউ বর্তমানে তিনটি সম্ভাব্য পথে যেতে পারে—
১. সামরিক শাসন দীর্ঘমেয়াদে স্থায়ী হবে
দেশটির ইতিহাসে আগের বহু অভ্যুত্থানে এমনটাই হয়েছে। সেনাবাহিনী রাজনৈতিক কাঠামোর ওপর নিজের প্রভাব বাড়াতে পারে।
২. আন্তর্জাতিক চাপের মুখে দ্রুত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া পুনরায় শুরু হবে
ইকোয়াস, জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের চাপ সরকারকে বেসামরিক প্রশাসনে ক্ষমতা হস্তান্তরে বাধ্য করতে পারে।
৩. গৃহযুদ্ধ বা দীর্ঘমেয়াদি অস্থিরতা দেখা দিতে পারে
যদি ক্ষমতা দখল নিয়ে সেনাবাহিনীর ভেতরেও বিভক্তি তৈরি হয়, তবে দেশ আরও অস্থিতিশীল হয়ে পড়তে পারে।
গিনি-বিসাউবাসীর উদ্বেগ: ভবিষ্যৎ কি নিরাপদ?
রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা, সীমান্ত বন্ধ, গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ, গ্রেপ্তার—সব মিলিয়ে জনগণ এখন কঠিন পরিস্থিতিতে রয়েছে। অর্থনৈতিক দুরবস্থা আরও প্রকট হতে পারে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের আশঙ্কাও বাড়ছে।
বিশ্লেষকদের মতে, গিনি-বিসাউকে স্থিতিশীল করতে স্থানীয় নেতৃত্বের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সহায়তা অত্যন্ত জরুরি।
সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখল গিনি-বিসাউকে নতুন করে অস্থিরতার মুখে ফেলেছে। নির্বাচন প্রক্রিয়া স্থগিত, রাষ্ট্রপতি ও বিরোধী নেতাদের গ্রেপ্তার, সীমান্ত বন্ধসহ নানা সিদ্ধান্ত পুরো দেশকে অচল করে দিয়েছে। আফ্রিকার পশ্চিমাঞ্চলে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার ধারায় এটি নতুন সংযোজন।
এই পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেবে—তা নির্ভর করবে সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরীণ সিদ্ধান্ত, আন্তর্জাতিক চাপ এবং জনগণের প্রতিক্রিয়ার ওপর। তবে আপাতত দেশটি নতুন এক অনিশ্চিত অধ্যায়ে প্রবেশ করেছে—যার শেষ কোথায়, তা কেউ নিশ্চিতভাবে বলতে পারছে না।
MAH – 14023 I Signalbd.com



