মার্কিন রাজনীতিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ইতিহাস দীর্ঘদিনের। ডেমোক্র্যাট নেতা হিলারি ক্লিনটন ও রিপাবলিকান নেতা ডোনাল্ড ট্রাম্পের রাজনৈতিক লড়াই শুধু নির্বাচনের ময়দানে সীমাবদ্ধ নয়; আদালত, মিডিয়া, জনমত—সব ক্ষেত্রেই তাদের বিরোধ বহুবার প্রকাশ পেয়েছে। সেই ধারাবাহিকতার আরেক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় যুক্ত হলো নতুন এক বিচারিক রায়ে।
হিলারি ক্লিনটনের বিরুদ্ধে করা একটি ‘ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ মামলার কারণে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তার ঘনিষ্ঠ আইনজীবী আলিনা হাবাকে ১০ লাখ ডলার জরিমানা বহাল রেখেছে যুক্তরাষ্ট্রের একটি ফেডারেল আপিল আদালত। দেশটির সংবাদমাধ্যম অ্যাক্সিওসসহ বিভিন্ন শীর্ষস্থানীয় গণমাধ্যম এই তথ্য জানিয়েছে।
এই রায় কেবল একটি মামলার নিষ্পত্তি নয়; বরং যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ও বিচারিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। বিশেষ করে, একজন বর্তমান প্রেসিডেন্ট কীভাবে বারবার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে মামলা করে তা আদালত কীভাবে মূল্যায়ন করছে—এই রায় তারও একটি স্পষ্ট দৃষ্টান্ত।
রায়ের পেছনের পটভূমি: কী ছিল মামলার অভিযোগ?
২০২২ সালের মার্চে ডোনাল্ড ট্রাম্প হিলারি ক্লিনটন, সাবেক এফবিআই পরিচালক জেমস কমি ও আরও কয়েকজন প্রভাবশালী ডেমোক্র্যাট নেতার বিরুদ্ধে একটি মামলা করেন। ট্রাম্পের অভিযোগ ছিল—২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় এসব ব্যক্তি নাকি ষড়যন্ত্র করে রাশিয়ার সঙ্গে তার যোগসাজশ রয়েছে এমন একটি ‘মিথ্যা বয়ান’ তৈরি করেছিলেন।
ট্রাম্প দাবি করেছিলেন, এই ষড়যন্ত্রমূলক প্রচারণা তার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে এবং নির্বাচনের পরিবেশ প্রভাবিত করে। তাঁর ভাষায়, এটি ছিল একটি “রাজনৈতিক চক্রান্ত”।
কিন্তু আদালতের দৃষ্টিতে—এটি ছিল সম্পূর্ণ “অযৌক্তিক, ভিত্তিহীন এবং আইনের অপব্যবহার”।
ফ্লোরিডার ডিস্ট্রিক্ট কোর্টের বিচারক ডোনাল্ড মিডলব্রুকস ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরেই মামলাটি খারিজ করে দেন। তিনি মন্তব্য করেন:
“মামলাটি কখনোই দাখিল করা উচিত ছিল না। এটি দুই শতাধিক পৃষ্ঠার একটি রাজনৈতিক ইশতেহারের বেশি কিছু নয়।”
এরপর বিচারক ট্রাম্প, তার আইনজীবী আলিনা হাবা ও তার আইন প্রতিষ্ঠানকে ৯ লাখ ৩৭ হাজার ডলার জরিমানার আদেশ দেন। আদালতের মতে, ট্রাম্প উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে আদালতকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের চেষ্টা করেছিলেন।
আপিল আদালতের সর্বশেষ সিদ্ধান্ত: আগের রায়ই বহাল
ঘটনা এখানেই শেষ হয়নি। ট্রাম্প ও তার আইনজীবীরা ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন। কিন্তু ২০২৫ সালের ২৬ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল আপিল আদালত তিন বিচারকের একটি বেঞ্চে একযোগে আগের জরিমানা বহাল রাখেন। অর্থাৎ ট্রাম্পকে ১০ লাখ ডলারই দিতে হবে।
তারা স্পষ্ট ভাষায় বলেন—হিলারি ক্লিনটনসহ যাদের বিরুদ্ধে ট্রাম্প মামলা করেছিলেন, তাদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগগুলো ছিল সম্পূর্ণ “ফ্রিভোলাস”—অর্থাৎ আইনি ভাষায় “ভিত্তিহীন, অপ্রাসঙ্গিক ও অযৌক্তিক”।
আদালতের তিন বিচারক—উইলিয়াম প্রাইয়ার জুনিয়র, অ্যান্ড্রু ব্রাশার ও এম্ব্রি কিড—৩৬ পৃষ্ঠার রায়ে উল্লেখ করেন:
“ডিস্ট্রিক্ট কোর্ট কোনো ক্ষমতার অপব্যবহার করেনি। বরং, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও তার আইনজীবী আদালতের প্রক্রিয়াকে নিজেদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে শাস্তি দেওয়ার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন, যা আইনের অপব্যবহার।”
এটি ট্রাম্পের জন্য একই আদালতে টানা দ্বিতীয় বড় পরাজয়। কয়েক দিন আগেও ১১তম সার্কিট আপিল আদালত সিএনএনের বিরুদ্ধে তার করা মানহানি মামলা পুনরুজ্জীবিত করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল।
ট্রাম্পের আইনজীবী দলের প্রতিক্রিয়া
রায়ের পর ট্রাম্পের আইনজীবী দলের একজন মুখপাত্র এক বিবৃতিতে বলেন:
“প্রেসিডেন্ট বিষয়টি ন্যায্য ও সঠিক পরিণতি পর্যন্ত অনুসরণ করবেন।”
তাদের দাবি—মামলাটি রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে, এবং তারা ‘ন্যায়বিচারের স্বার্থে’ আরো আইনি পদক্ষেপ বিবেচনা করবেন।
যদিও আদালতের মন্তব্য অনুযায়ী—এই যুক্তি টেকসই নয়।
আলিনা হাবার ভূমিকা: আরেক বিতর্ক
ট্রাম্পের পূর্ব-নির্বাচনী সময়ের আইনজীবী আলিনা হাবা সম্প্রতি আরেকটি আইনি বিতর্কেও জড়িয়ে পড়েন। ট্রাম্প তাকে নিউ জার্সির ভারপ্রাপ্ত মার্কিন অ্যাটর্নি হিসেবে নিয়োগ করেছিলেন।
কিন্তু চলতি বছরের আগস্টে এক ফেডারেল বিচারক রায় দেন—হাবা বৈধ ক্ষমতা ছাড়া দায়িত্ব পালন করেছেন; তার অন্তর্বর্তী মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছিল। ফলে তিনি কার্যত একজন অননুমোদিত কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন।
এই রায়ের বিরুদ্ধে বিচার বিভাগ চ্যালেঞ্জ করেছে। তবে এই ঘটনাও আদালতে তার বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রভাবিত করেছে।
হিলারি বনাম ট্রাম্প: রাজনীতির লড়াই আদালতে
ট্রাম্প ও হিলারির দ্বন্দ্ব এখনো মার্কিন রাজনীতিতে আলোচনার কেন্দ্রে।
২০১৬ সালের নির্বাচনে হিলারি ক্লিনটন রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে অপ্রত্যাশিতভাবে পরাজিত হন। তখন থেকেই উভয়পক্ষের সমর্থকদের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক, অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ চলছেই।
ট্রাম্প বারবার অভিযোগ করেছেন—হিলারি ও ডেমোক্র্যাট দল তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছে।
অন্যদিকে ডেমোক্র্যাটরা দাবি করেন—ট্রাম্প আদালত ও আইনব্যবস্থাকে রাজনৈতিক শত্রুতা মেটানোর উপায় হিসেবে ব্যবহার করেন।
সর্বশেষ এই রায় তাদের সেই বক্তব্যকেই শক্তিশালী করেছে।
আইন বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন?
বিভিন্ন আইন বিশেষজ্ঞের মতে, রায়টি কয়েকটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ:
১. আদালত স্পষ্ট করেছেন—আইন দিয়ে রাজনৈতিক প্রতিশোধ নেওয়া যাবে না।
যে কোনো রাজনৈতিক নেতা আদালতকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে চাইলে কঠোর শাস্তির মুখোমুখি হবেন।
২. ভবিষ্যতে প্রেসিডেন্ট বা উচ্চপদস্থ রাজনৈতিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা হলে আদালত আরও সতর্কভাবে দেখবে—তা কতটা যৌক্তিক।
৩. যুক্তরাষ্ট্রের বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা আবারও প্রমাণিত হলো।
ট্রাম্প একজন বর্তমান প্রেসিডেন্ট হলেও আদালত তাকে ছাড় দেয়নি।
৪. রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ‘ফ্রিভোলাস মামলা’ কমাতে এই রায় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
আইন বিশেষজ্ঞ স্কট অ্যান্ডারসন বলেন:
“একজন বসমান প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে জরিমানা বহাল রাখা সহজ সিদ্ধান্ত নয়। কিন্তু আদালত এখানে দেখিয়েছে—আইনের সামনে সবাই সমান।”
মার্কিন রাজনীতিতে সম্ভাব্য প্রভাব
এই রায় ট্রাম্প ও রিপাবলিকান শিবিরকে রাজনৈতিকভাবে চাপের মধ্যে ফেলে দিতে পারে।
কারণ—
১. এটি ট্রাম্পের আইনি সুনামকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
তিনি ইতোমধ্যেই একাধিক ফৌজদারি ও দেওয়ানি মামলার মুখোমুখি।
২. নির্বাচনী প্রচারেও বিষয়টি আলোচনায় আসবে।
ডেমোক্র্যাটরা ইতোমধ্যেই শুরু করেছে—“আইনকে অপব্যবহার” করার অভিযোগ।
৩. আন্তর্জাতিক মহলেও এই রায় মার্কিন রাজনৈতিক সংস্কৃতির মানদণ্ড নিয়ে আলোচনা সৃষ্টি করেছে।
রায়টির সাংবিধানিক গুরুত্ব
মার্কিন আদালতে ‘ফ্রিভোলাস মামলা’ দাখিল করলে অভিযুক্তকে জরিমানা করা হয়।
কিন্তু কোনো বর্তমান প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে এত বড় অঙ্কের জরিমানা বহাল রাখা বিরল ঘটনা।
রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলে—
“একজন প্রেসিডেন্ট যদি রাজনৈতিক প্রতিশোধ নিতে আদালতকে ব্যবহার করেন, তবে গণতন্ত্রের ভিত্তিই দুর্বল হয়ে পড়ে।”
এ বক্তব্যের মাধ্যমেই আদালত এক অর্থে রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রতি সতর্কবার্তা দিয়েছে।
হিলারি ক্লিনটনের প্রতিক্রিয়া
হিলারি ক্লিনটনের দপ্তর থেকে সরাসরি কোনো বিবৃতি না এলেও ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক মহল বলছে—
তিনি দীর্ঘদিন ধরে দাবি করে আসছিলেন—ট্রাম্পের অভিযোগগুলো ‘মিথ্যা, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং মনগড়া’।
রায়টি সেই দাবিরই পুনরায় প্রমাণ দিয়েছে।
পরবর্তী পথ কোন দিকে?
এখন প্রশ্ন—ট্রাম্প কি এবার সুপ্রিম কোর্টে যাবেন?
আইনজীবী দল অবশ্য বলেছে—তারা বিষয়টি “সঠিক পরিণতি পর্যন্ত” নিয়ে যাবে।
তবে আইন বিশেষজ্ঞদের মতে—এই ধরনের মামলায় সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার সম্ভাবনা কম। কারণ রায়ে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে—
• মামলা ছিল ভিত্তিহীন
• আইনের অপব্যবহার
• রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত
• কোনো শক্ত আইনি ভিত্তি ছিল না
এসব কারণে উচ্চ আদালতেও রায় বহাল থাকার সম্ভাবনা প্রবল।
যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি দীর্ঘদিন ধরেই বিভাজন, বিতর্ক ও অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগে উত্তপ্ত।
কিন্তু সেই উত্তাপ যতই বাড়ুক—আদালত তাদের স্বাধীনতা এবং ন্যায়সঙ্গত সিদ্ধান্ত দেওয়ার ক্ষেত্রে অবস্থান ধরে রেখেছে।
হিলারি ক্লিনটনের বিরুদ্ধে করা ট্রাম্পের মামলা বাতিল হওয়া এবং জরিমানা বহাল থাকা—এই বার্তাই দেয়:
“রাজনীতি আদালতের ভিতর নয়—আইনের ভিত্তিতেই বিচার হবে।”
মার্কিন গণতন্ত্রের মৌলিক শক্তি এখানেই।
আর এই রায় সেই শক্তিকেই আবারও স্পষ্টভাবে তুলে ধরল।
MAH – 14013 I Signalbd.com



