অবরুদ্ধ গাজ্জা উপত্যকা আজ বিশ্ব মানবাধিকার লঙ্ঘনের সবচেয়ে ভয়াবহ উদাহরণগুলোর একটি। দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে চলমান ইসরাইলি আগ্রাসনে গাজ্জার ভূগোল, মানুষ ও সমাজ—সবকিছুই প্রায় নিশ্চিহ্ন হচ্ছে। ফিলিস্তিনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্প্রতি জানিয়েছে, শুধুমাত্র নারী ও শিশু মিলিয়ে নিহত হয়েছে কমপক্ষে ৩৩ হাজারের বেশি। সামগ্রিকভাবে নিহতের সংখ্যা ৭০ হাজারেরও বেশি। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে।
আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষে দেওয়া এক বিবৃতিতে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ স্পষ্টভাবে উল্লেখ করে—ইসরাইল নারীদের ওপর পরিকল্পিত ও পদ্ধতিগত নির্যাতন চালাচ্ছে, যা আন্তর্জাতিক আইনে ‘যুদ্ধাপরাধ’ এবং ‘গণহত্যা’র মধ্যে পড়ে।
এই প্রতিবেদনে দুই বছরের বাস্তচিত্র, সরকার–সংগঠন–সংবাদমাধ্যমের সব উপলব্ধ তথ্য এবং আন্তর্জাতিক গবেষণা একত্র করা হলো—SignalBD পাঠকদের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ, বিশ্লেষণধর্মী ও অনুসন্ধানমূলক প্রতিবেদন হিসেবে।
গাজ্জায় দুই বছরে নারী–শিশু হত্যার ভয়াবহ পরিসংখ্যান
ফিলিস্তিনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য
ফিলিস্তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে—
- ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৫ সালের নভেম্বর পর্যন্ত
কেবল এই দুই বছরে- ১২,৫০০ নারী নিহত
- ২০,০০০ শিশু নিহত
এতেই মোট নিহতের সংখ্যা ৩২,৫০০ ছাড়িয়েছে, যদিও বিবৃতিতে বলা হয়েছে ৩৩ হাজারেরও বেশি নারী–শিশু নির্মমভাবে হত্যার শিকার হয়েছে।
গাজ্জা সরকারের মিডিয়া অফিস
গাজ্জা সরকারের হিসাব আরও গভীর সংকট তুলে ধরে। তারা জানায়—
- ইসরাইলি বিমান হামলা
- আর্টিলারি শেলিং
- ট্যাংক হামলা
- ঘরবাড়ি ধস
- অবরোধজনিত মৃত্যু
এই সব মিলিয়ে নারী–শিশুরাই হামলার সবচেয়ে বড় লক্ষ্যবস্তু।
গাজ্জার জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি শিশু। ফলে প্রত্যেকটি হামলা সরাসরি শিশুদের ওপর আঘাত করছে।
ইসরাইলের বিরুদ্ধে পদ্ধতিগত অপরাধের অভিযোগ
ফিলিস্তিনি মন্ত্রণালয়ের বিবৃতি অনুযায়ী ইসরাইল যেসব অপরাধ করছে—
১. গণহত্যা (Genocide)
গাজ্জার গণহত্যা নিয়ে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন আদালতেও আলোচনা চলছে। জাতিসংঘ বলেছে—গাজ্জার পরিস্থিতি “গণহত্যার শঙ্কা বহন করে।”
২. বিচারবহির্ভূত হত্যা
ইসরাইলি বাহিনী যেকোনো লক্ষ্যবস্তুকে “হামাস” অভিযোগে হত্যা করছে, কিন্তু অধিকাংশই সাধারণ মানুষ, নারী ও শিশু।
৩. জোরপূর্বক গুম ও আটক
শত শত নারী–পুরুষকে আটকের পর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।
৪. যৌন সহিংসতা
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার পর্যবেক্ষকরা জানিয়েছেন, আটক ফিলিস্তিনি নারীদের বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ বাড়ছে।
৫. ঘরবাড়ি–স্কুল–হাসপাতাল ধ্বংস
দুই বছরে
- ৩ লাখের বেশি ঘরবাড়ি ধ্বংস
- ২০০–এর বেশি স্কুল ধ্বংস
- হাসপাতালের ৯০% অকার্যকর
৬. খাদ্য ও ওষুধ সংকট সৃষ্টি
অবরোধের কারণে গাজ্জায় মানবিক বিপর্যয় তীব্র হয়েছে। জাতিসংঘ বলছে—
“গাজ্জায় বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ মানবিক দুর্যোগ তৈরি হয়েছে।”
উন্নত প্রযুক্তি দিয়ে নারীদের টার্গেট করছে ইসরাইল?
ফিলিস্তিনি মন্ত্রণালয় বলেছে—
- ইসরাইল উন্নত নজরদারি প্রযুক্তি ব্যবহার করছে।
- ড্রোনভিত্তিক লক্ষ্য নির্ধারণ
- এআই–নির্ভর টার্গেট লিস্ট
- সাইবার গুপ্তচর প্রযুক্তি
মন্ত্রণালয়ের অভিযোগ—
এআই–সফটওয়্যার “লাভা” (LAVA) এবং “গসপেল” (Gospel) সিস্টেম ব্যবহার করে ইসরাইল আবাসিক ভবন, নারীদের অবস্থান ও জনগোষ্ঠীকে টার্গেট করছে।
মানবাধিকার সংগঠন ‘ফোরেনসিক আर्कিটেকচার’ এবং ইসরাইলি মানবাধিকার গ্রুপও জানিয়েছে—এআই–নির্ভর এই টার্গেটিং পুরোপুরি মানবাধিকারবিরোধী।
দ্বিরাষ্ট্র সমাধান ও আন্তর্জাতিক চাপের আহ্বান
ফিলিস্তিনি মন্ত্রণালয় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আহ্বান জানায়—
- ইসরাইলের বেআইনি দখলদারিত্ব বন্ধে কঠোর আন্তর্জাতিক চাপ প্রয়োজন
- গাজ্জায় যুদ্ধবিরতি নিশ্চিত করতে হবে
- দ্বিরাষ্ট্র সমাধান বাস্তবায়ন জরুরি
- ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণ, স্বাধীনতা, নিরাপদে দেশে ফেরা ও ভূখণ্ড পুনরুদ্ধারের অধিকার দিতে হবে
দুই বছরে গাজ্জায় মোট নিহত ৭০ হাজারের বেশি
ফিলিস্তিনি মন্ত্রণালয়ের নতুন ডেটা অনুযায়ী—
- নিহত: প্রায় ৭০,০০০
- আহত: ১,৭১,০০০ এরও বেশি
এই তথ্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর প্রকাশিত ডেটার সঙ্গে মিল রেখে চলেছে।
জার্মান গবেষণা বলছে আরও ভয়াবহ চিত্র
সম্প্রতি জার্মানির একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান জানায়—
“গাজ্জায় প্রকৃত নিহতের সংখ্যা ১ লাখের বেশি হতে পারে।”
কারণ—
- ধ্বংসস্তূপে আরও হাজারো মানুষ চাপা পড়ে আছে
- সঠিক ডেটা সংগ্রহ অসম্ভব
- গাজ্জার হাসপাতাল ও প্রশাসন ভেঙে পড়ায় তথ্য অসম্পূর্ণ
গাজ্জায় দুই বছরে কী কী ধ্বংস হয়েছে — একটি বিস্তারিত চিত্র
১. অবকাঠামো
- ৭৫% ভবন আংশিক বা সম্পূর্ণ ধ্বংস
- ৩০০টির বেশি মসজিদ ক্ষতিগ্রস্ত
- ৩৫টির বেশি চার্চ টার্গেট
- প্রধান সড়কগুলো ধ্বংস হওয়ায় ত্রাণ কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত
২. স্বাস্থ্যব্যবস্থা
- হাসপাতাল ৯০% অকার্যকর
- ডাক্তার–নার্সের অভাব
- অপারেশন থিয়েটারে আলো নেই, জেনারেটর নেই
- ওষুধ–অক্সিজেন সংকট
৩. শিক্ষা ব্যবস্থা
- ইউনিসেফ জানিয়েছে—গাজ্জায় ‘শূন্য স্কুল দিবস’ চলছে
- দুই বছরে কোনো স্কুল খোলা নেই
- ১১ লাখ শিশু শিক্ষার বাইরে
৪. খাদ্য সংকট
- জাতিসংঘ বলছে—গাজ্জা বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ–ঝুঁকি অঞ্চলে পরিণত হয়েছে
- হাজারো শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে
- নিরাপদ পানি সংকট চরমে
৫. বাস্তুচ্যুতি
- ২২ লাখ মানুষের মধ্যে ১৮ লাখ বাস্তুচ্যুত
- বারবার স্থান পরিবর্তন করতে বাধ্য হচ্ছে পরিবারগুলো
- তাঁবু, খোলা আকাশ, ধ্বংসস্তূপ—যেখানেই হোক, মানুষ বাঁচার চেষ্টা করছে
বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া: নিন্দা, উদ্বেগ ও ব্যর্থতা
জাতিসংঘ
জাতিসংঘের একাধিক সংস্থা বলেছে—
- গাজ্জা “বসবাসের অযোগ্য এলাকা” হয়ে গেছে
- নারী–শিশুর বিরুদ্ধে ইসরাইলের হামলা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার লঙ্ঘন
- গণহত্যার আশঙ্কা ক্রমেই দৃঢ়তর হচ্ছে
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম
TRT World, আল–জাজিরা, AP, Reuters, BBC—সবাই গাজ্জার ভয়াবহ পরিস্থিতি বারবার প্রকাশ করেছে।
মানবাধিকার সংগঠন
Human Rights Watch, Amnesty International, Red Crescent, Save the Children সবাই একই বার্তা দিচ্ছে—
“এটি কেবল যুদ্ধ নয়, এটি গণহত্যা।”
গাজ্জার মানুষের জীবন এখন কেমন?
গাজ্জার সাংবাদিক, চিকিৎসক ও বেঁচে থাকা মানুষের বর্ণনা—
“রাত আর দিন নেই—শুধু ধোঁয়া, ধ্বংস আর বোমার শব্দ।”
“শিশুরা ঘুমাতে ভয় পায়, কারণ ঘুমেই মৃত্যু আসে।”
“যে পরিবারগুলো বেঁচে আছে, তারা খাবার ও নিরাপদ পানি ছাড়া প্রতিদিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে।”
“আমরা পৃথিবীর অন্যতম ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের সাক্ষী।”
এই বর্ণনাগুলোর প্রতিটিই গাজ্জার বাস্তবতার অংশ।
যুদ্ধবিরতির দাবি আরও জোরদার হচ্ছে
বিশ্বব্যাপী—
- লাখো মানুষ বিক্ষোভ করছে
- যুদ্ধবিরতির দাবি তুলছে
- নারী–শিশুর ওপর হামলা বন্ধের আহ্বান জানাচ্ছে
- আন্তর্জাতিক আদালত বিভিন্ন প্রতিবেদন গ্রহণ করেছে
কিন্তু যুদ্ধ থামছে না।
দুই বছরের যুদ্ধ গাজ্জাকে শুধু ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেনি, বরং মূলত নারী–শিশুদের সবচেয়ে বড় শিকার বানিয়েছে।
প্রতিটি সংখ্যা একটি জীবন, একটি পরিবার, একটি স্বপ্ন, একটি ভবিষ্যৎ।
ফিলিস্তিনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও আন্তর্জাতিক মহলের ভয়াবহ পরিসংখ্যান স্পষ্ট করে দেখাচ্ছে—গাজ্জায় মানবাধিকার ধ্বংস হয়েছে, ন্যায়বিচার বিলীন হয়েছে, আন্তর্জাতিক আইন অকার্যকর হয়েছে।
বিশ্বব্যাপী এখনই জরুরি—
- যুদ্ধবিরতি
- মানবিক সহায়তা
- দখলদারিত্বের অবসান
- দ্বিরাষ্ট্র সমাধান
- ফিলিস্তিনিদের মৌলিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা
গাজ্জার নারী–শিশুদের জীবন বাঁচাতে মানবতার পক্ষে দাঁড়ানো আজ সময়ের সবচেয়ে বড় দাবি।
MAH – 14009I Signalbd.com



