ভারতের ইসলামবিদ্বেষ নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সচেতন হওয়ার আহ্বান পাকিস্তানের
সহনশীলতার সংকটে দক্ষিণ এশিয়া, বাবরি মসজিদ–রাম মন্দির ইস্যুতে নতুন উত্তেজনা**
দক্ষিণ এশিয়ায় ধর্মীয় সহাবস্থান ও সামাজিক শান্তি দীর্ঘদিন ধরে নানান চ্যালেঞ্জের মুখে। বিশেষত ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হিন্দুত্ববাদী উন্মাদনার উত্থান ও মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতি বৈরী নীতির অভিযোগ আন্তর্জাতিক মহলেও আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে ভারতের বাড়তে থাকা ইসলামবিদ্বেষ, ঘৃণামূলক ভাষণ এবং ধর্মীয় উপাসনালয়কে কেন্দ্র করে উত্তেজনার বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আরও সতর্ক হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে পাকিস্তান।
মঙ্গলবার পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানায়, ভারতীয় সমাজে সংখ্যালঘু বিশেষ করে মুসলিম জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যে ধারাবাহিক বিদ্বেষ ও সহিংসতার পরিবেশ তৈরি করা হচ্ছে, তা শুধু ভারতের জন্য নয়—পুরো দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতার জন্যই হুমকি হয়ে উঠছে।
রাম মন্দিরে পতাকা উত্তোলন প্রসঙ্গে গভীর উদ্বেগ
সম্প্রতি ভারতের অযোধ্যায় বাবরি মসজিদের স্থানে নির্মিত রাম মন্দিরে পতাকা উত্তোলনকে ঘিরে পাকিস্তান গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। পাকিস্তানের মন্তব্য অনুযায়ী, এটি এমন একটি পদক্ষেপ যা বহু শতাব্দীর ঐতিহ্য, ইতিহাস ও ধর্মীয় বৈচিত্র্যকে আঘাত করে এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের মনে নতুন করে ক্ষোভ ও বেদনার সঞ্চার করে।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র তাহির হুসাইন আন্দ্রাবি বলেন, “এই ধরনের প্রদর্শনী সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। একই সঙ্গে ভারতের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিমণ্ডলে হিন্দুত্ববাদী মতাদর্শ কতটা প্রভাব বিস্তার করেছে, তারও বাস্তব চিত্র ফুটে ওঠে।”
ইসলামোফোবিয়া বৃদ্ধির অভিযোগ
আন্দ্রাবি বলেন, “পাকিস্তান আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ভারতের বাড়তে থাকা ইসলামোফোবিয়া, ঘৃণামূলক বক্তব্য এবং ঘৃণাপ্রসূত সহিংস ঘটনার বিষয়ে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানায়। বহু ঐতিহাসিক মসজিদ অপবিত্র করা হচ্ছে, ভাঙার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মুসলিমরা সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে প্রান্তিকায়িত হওয়ার শিকার হচ্ছেন।”
তিনি আরও দাবি করেন, ভারতের বড় শহর থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে মুসলিমদের ওপর হামলা, lynching, সামাজিক বয়কট, স্থানীয় প্রশাসনের নির্লিপ্ততা—সব মিলিয়ে একটি সুসংগঠিত বৈরী পরিবেশ তৈরি হয়েছে।
জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে পদক্ষেপ নিতে আহ্বান
পাকিস্তান মনে করে, শুধু বিবৃতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে দায়িত্ব শেষ করা যাবে না। বরং জাতিসংঘ, ওআইসি, মানবাধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠানগুলোর গঠনমূলক ও কার্যকর ভূমিকা প্রয়োজন।
আন্দ্রাবি বলেন, “মুসলিম স্থাপনা ও ঐতিহাসিক নিদর্শন সুরক্ষায় এবং সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক মহলকে সোচ্চার হতে হবে। ভারতের ধর্মীয় সহনশীলতার দুরবস্থা এখন আর অভ্যন্তরীণ কোনো বিষয় নয়; এর প্রভাব আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার ওপর পড়ছে।”
ভারত সরকারকে নিরাপত্তা নিশ্চিতের আহ্বান
পাকিস্তানের বিবৃতিতে ভারত সরকারকে স্মরণ করানো হয় যে, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার চুক্তি ও দৃষ্টান্ত অনুযায়ী যে কোনো রাষ্ট্রের দায়িত্ব তার সকল নাগরিকের ধর্মীয় স্বাধীনতা সুরক্ষিত রাখা। কিন্তু ভারতের বর্তমান পরিস্থিতিতে মুসলিমদের নিরাপত্তা, উপাসনালয়ের নিরাপত্তা এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা নিয়ে বিস্তর প্রশ্ন উঠছে।
বিবৃতিতে বলা হয়, “ভারত সরকারকে সকল ধর্মীয় সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। মুসলিমদের মসজিদ, দরগাহ, মাদ্রাসা, ঐতিহাসিক স্থাপনা—সব ধরনের উপাসনালয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।”
বাবরি মসজিদ ধ্বংস: তিন দশকেও ক্ষত সারেনি
বাবরি মসজিদ দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসে এক বেদনাদায়ক অধ্যায়। প্রায় ৫০০ বছরেরও বেশি প্রাচীন এই স্থাপনা ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর চরমপন্থী উগ্রবাদী জনতার হাতে ধ্বংস হয়। সেই ঘটনার পর থেকেই ভারতের ধর্মীয় রাজনীতির মোড় ঘুরে যায়।
বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর দেশে ব্যাপক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারায়। পরবর্তী বিচারিক প্রক্রিয়ায় অভিযুক্তদের খালাস দেওয়া হয়, যা নিয়ে দেশজুড়ে বিতর্ক এখনও থামেনি। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই খালাসের ঘটনা ভারতীয় বিচারব্যবস্থা এবং রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর পক্ষপাতমূলক অবস্থানের স্পষ্ট উদাহরণ।
পরবর্তী সময়ে বাবরি মসজিদের স্থানে রাম মন্দির নির্মাণের অনুমতি দেওয়া হয়, যা মুসলিম সম্প্রদায়ের কাছে গভীর বেদনার। পাকিস্তানের দাবি, এই সিদ্ধান্ত দেখায় যে ভারতের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো সংখ্যালঘুদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করছে।
ইতিহাস ও সংস্কৃতির ওপর চাপ—বিশ্লেষকদের মতামত
দক্ষিণ এশিয়ার বিশ্লেষকরা মনে করেন, ভারতের ধর্মীয় রাজনীতি গত ১০–১৫ বছরে উল্লেখযোগ্যভাবে বদলে গেছে। বিদ্বেষমূলক বক্তব্য, উপাসনালয়ে হামলা, খাদ্যাভ্যাস বা পোশাক নিয়ে মুসলিমদের ওপর নির্যাতন—এই প্রবণতা শুধু সামাজিক অসহিষ্ণুতাই নয়, বরং ভয়াবহ রাষ্ট্রীয় নীরবতার প্রতীক।
বহু আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা নিয়মিত প্রতিবেদন প্রকাশ করছে যেখানে বলা হচ্ছে:
— মুসলিমদের ওপর গণহত্যার আহ্বান পর্যন্ত দেওয়া হচ্ছে খোলামেলা সমাবেশে
— ধর্মীয় মিছিলের নামে মুসলিম পাড়ায় হামলা ও উস্কানি বাড়ছে
— গরু সংক্রান্ত অভিযোগ তুলে লিঞ্চিং নিয়মিত ঘটছে
— মুসলিম ব্যবসাকে লক্ষ্য করে বয়কটের আহ্বান চলছে
— মসজিদের মাইক বন্ধ করা, হিজাব নিষিদ্ধ করা, নামাজের স্থানে বাধা দেওয়া—এসব সমস্যা বাড়ছে
এই পরিস্থিতি দীর্ঘমেয়াদে ভারতীয় সমাজে একটি গভীর বিভাজন সৃষ্টি করবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
দক্ষিণ এশিয়ার শান্তি ও স্থিতিশীলতা ঝুঁকিতে
ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক সবসময়ই নানান ইস্যুতে টানাপড়েনে থাকে। কিন্তু ধর্মীয় ইস্যু বা উপাসনালয়কে কেন্দ্র করে উত্তেজনা যখন বাড়ে, তখন তা দুই দেশের সম্পর্কের ওপর আরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। বিশেষজ্ঞদের মতে, মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে বড় দেশগুলোর অন্যতম পাকিস্তান। ফলে ভারতের অভ্যন্তরীণ মুসলিম নির্যাতন পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন অবিশ্বাস তৈরি করছে।
এছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশ—বাংলাদেশ, নেপাল এবং শ্রীলঙ্কাও ভারতের রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রভাব অনুভব করে। মানবাধিকার পরিস্থিতি খারাপ হলে অঞ্চলজুড়ে এক ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হওয়া অস্বাভাবিক নয়।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকা—এখনই প্রয়োজন
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ভারত একটি বৃহৎ গণতন্ত্র, অর্থনৈতিক শক্তি এবং দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতায় গুরুত্বপূর্ণ দেশ। তাই মানবাধিকার ও ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করা শুধু ভারতের অভ্যন্তরীণ দায়িত্ব নয়—আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়েরও যৌথ দায়িত্ব।
জাতিসংঘ যদি সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিষয়ে কার্যকর পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা তৈরি করে, ওআইসি যদি রাজনৈতিক কূটনৈতিক নজরদারি বাড়ায়, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র যদি দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় মানবাধিকারকে গুরুত্ব দেয়—তাহলেই হয়তো পরিস্থিতি বদলাতে পারে।
MAH – 14008I Signalbd.com



