যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক সিটির রাজনীতিতে বাংলাদেশিদের দীর্ঘ সংগ্রাম, পরিশ্রম ও রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার ইতিহাসে নতুন অধ্যায় রচিত হলো। নবনির্বাচিত মেয়র জোহরান মামদানি ২০২৫ সালের নভেম্বর মাসে তার বিশাল ট্রানজিশন টিম ঘোষণা করেছেন, যেখানে ১০ জন বাংলাদেশের বংশোদ্ভূত পেশাজীবী, মানবাধিকারকর্মী ও কমিউনিটি নেতাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
এই অন্তর্ভুক্তি শুধু ব্যক্তিগত সাফল্য নয়, বরং নিউইয়র্কে প্রবাসী বাংলাদেশি কমিউনিটির ক্রমবর্ধমান শক্তি ও অবস্থানের প্রতীক। দক্ষিণ এশীয় কমিউনিটির মধ্যে এবার বাংলাদেশিদের উপস্থিতিই সবচেয়ে শক্তিশালী।
সমতলী হকের অন্তর্ভুক্তি: আলোচনা ও গুরুত্ব
তালিকায় সবচেয়ে আলোচিত নাম—সমতলী হক, বাংলাদেশের কবি, লেখক ও চিন্তক ফরহাদ মজহারের কন্যা। সমতলী বর্তমানে সিটি ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্কে (CUNY) শিক্ষকতা করেন এবং মানবাধিকার, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন, অভিবাসী অধিকার নিয়ে সক্রিয়ভাবে কাজ করছেন।
অধ্যাপনার আগেও তিনি লেবার অ্যাটর্নি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে কর্মরত ছিলেন, যেখানে শ্রম অধিকার, বৈষম্যবিরোধী আইনি সহায়তা ও মানবিক সুরক্ষা বিষয়ক কাজের জন্য তিনি স্থানীয় কমিউনিটিতে পরিচিতি লাভ করেছেন।
জোহরান মামদানির নির্বাচনী প্রচারণার শুরু থেকেই তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তার পরিবার নিউইয়র্কেই বসবাস করে। স্বামী পুয়ের্তো রিকো বংশোদ্ভূত এবং তাদের দুই সন্তান রয়েছে।
সমতলীর রাজনৈতিক ও সামাজিক সম্পৃক্ততা তাকে মামদানির ঘনিষ্ঠ আলোচকের তালিকায় স্থান দিয়েছে, যা তাকে ট্রানজিশন টিমে যুক্ত হতে সাহায্য করেছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মত।
ট্রানজিশন টিমে অন্তর্ভুক্ত অন্য ৯ বাংলাদেশি
নিউইয়র্ক সিটির ভবিষ্যৎ প্রশাসন গঠনে যে বড় টিমটি কাজ করবে তাতে যেসব বাংলাদেশিরা অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন, তাঁদের পরিচয় উল্লেখযোগ্য—কারণ তারা প্রত্যেকেই প্রবাসী সমাজে দীর্ঘদিনের কর্মযজ্ঞ, দক্ষতা ও অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ মনোনীত।
নীচে ৯ বাংলাদেশির বিস্তারিত পরিচয়:
১. কাজী ফৌজিয়া — নাগরিক আন্দোলনের নেত্রী
বাংলাদেশি নারী নেতৃত্বের উজ্জ্বল নাম কাজী ফৌজিয়া। দীর্ঘদিন ধরে তিনি নারীর অধিকার, অভিবাসী অধিকার এবং বর্ণবৈষম্যবিরোধী সামাজিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। নিউইয়র্কের রাস্তাঘাটে, সমাবেশে এবং সামাজিক দ্বন্দ্বমোচনে তার ভূমিকা সুপরিচিত। তিনি অনেক বাংলাদেশির আইনি সহায়তা ও কমিউনিটি গঠনে ব্যাপক অবদান রেখেছেন।
২. আব্দুল আজিজ ভূঁইয়া — জনসংগঠক
নিউইয়র্কে বাংলাদেশিদের প্রায় সব রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক কার্যক্রমেই আজিজ ভূঁইয়ার উপস্থিতি দেখা যায়। তিনি বিভিন্ন কমিউনিটি প্রোগ্রামের পরিকল্পনা, সংগঠক হিসেবে তৃণমূল পর্যায়ে কাজ করে আসছেন।
৩. শামসুল হক — সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা
যুক্তরাষ্ট্রে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থায় কাজ করার অভিজ্ঞতা এবং বাংলাদেশ কমিউনিটির নিরাপত্তা ও আইনি সচেতনতা বৃদ্ধিতে তার ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। তিনি বাংলাদেশি তরুণদের আইনশৃঙ্খলা বিষয়ক প্রশিক্ষণ দিতে নানা উদ্যোগ নিয়েছেন।
৪. মোহাম্মদ করিম চৌধুরী — শ্রম অধিকার সংগঠক
নিউইয়র্কের দোকান, রেস্তোরাঁ, ডেলিভারি শ্রমিক, উবার–লিফট শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে তিনি স্বতন্ত্র ভূমিকা রেখেছেন। দক্ষিণ এশীয় শ্রমিকদের অধিকার আদায়ে তার প্রচেষ্টা প্রশংসিত।
৫. ফারিহাহ আখতার — অভিবাসন অধিকার কর্মী
যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধ ও অর্ধ-বৈধ অভিবাসীদের জন্য ফারিহাহ আখতার দীর্ঘদিন ধরে লড়ছেন। বিশেষ করে বাংলাদেশি, নেপালি এবং দ. এশীয় অভিবাসীদের জন্য আইনি সহায়তা, সচেতনতা, মানবাধিকার বিষয়ক ক্যাম্পেইন পরিচালনা করেন।
৬. আরমান চৌধুরী — ক্ষুদ্র ব্যবসা খাতের প্রতিনিধি ও মুসলিম কমিউনিটির নেতা
নিউইয়র্কে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বাংলাদেশিদের বড় একটি অংশকে নেতৃত্ব দেন তিনি। ব্যবসা-বাণিজ্য, করব্যবস্থা, ব্যবসায়িক অধিকার—এসব বিষয়ে তিনি দীর্ঘদিন ধরে পরামর্শ, সহায়তা এবং কমিউনিটি প্রতিনিধিত্ব করে আসছেন।
৭. শাহরিয়ার রহমান — সামাজিক সংগঠন ভালো ও ম্যাসভোটের সংগঠক
তিনি যুক্তরাষ্ট্রে সামাজিক ন্যায়বিচার, ভোটাধিকার এবং রাজনৈতিক সচেতনতা বাড়াতে কাজ করছেন। বিভিন্ন অভিবাসী পরিবারকে শহর সরকারের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনে তার কাজ প্রশংসিত।
৮. তাজিন আজাদ — শিক্ষা ও যুব খাতের সংগঠক
শিক্ষা নীতি, শিক্ষার্থীদের সুযোগ-সুবিধা, বৃত্তি, যুব উন্নয়ন—এসব ক্ষেত্রে তাজিন আজাদের অবদান রয়েছে। বহু বাংলাদেশি শিক্ষার্থী শিক্ষা সহায়তা ও উৎসাহ পেয়েছেন তার মাধ্যমে।
৯. ইমরান পাশা — আইন ও ন্যায়বিষয়ক প্রতিনিধি
তিনি স্ট্যাটেন আইল্যান্ড ইসলামিক সেন্টারের একজন গুরুত্বপূর্ণ সংগঠক এবং আইনবিষয়ক কমিউনিটি সহায়তায় কাজ করছেন। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান পরিচালনা, সামাজিক শান্তি, আইনি সংকট মোকাবিলায় তার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
দক্ষিণ এশীয় প্রতিনিধিত্ব: তুলনায় বাংলাদেশির অবস্থান শক্তিশালী
মেয়র জোহরান মামদানি তার ট্রানজিশন টিমে ৪০০ জনের বেশি বিশেষজ্ঞ, কমিউনিটি নেতা, কর্মী ও পরামর্শক যুক্ত করেছেন।
তালিকা বিশ্লেষণে দেখা যায়:
- বাংলাদেশি: ১০ জন
- ভারতীয়: ১৬ জন
- পাকিস্তানি: ১১ জন
- নেপালি, শ্রীলঙ্কান, ভুটানিসহ অন্যান্য দক্ষিণ এশীয়: কয়েকজন
বাংলাদেশিদের এত বড় উপস্থিতি নিউইয়র্ক সিটির ইতিহাসে এই প্রথম।
প্রবাসী নেতাদের মতে, এই প্রতিনিধিত্ব বাংলাদেশিদের ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে আরও শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করবে।
জোহরান মামদানি কে?
জোহরান মামদানি একজন প্রগ্রেসিভ (উদারপন্থী) রাজনৈতিক নেতা, যিনি নিউইয়র্কে অভিবাসী, শ্রমিক, নিম্নবিত্ত ও বর্ণবৈষম্যের শিকার মানুষের পক্ষে কাজ করার জন্য পরিচিত।
তিনি আফ্রিকান ও দক্ষিণ এশীয় বংশোদ্ভূত। নিউইয়র্কে জনপ্রিয় হওয়ার আরেক বড় কারণ—তিনি সাধারণ মানুষের সমস্যা নিজের সমস্যা হিসেবে দেখেন।
তার নির্বাচনী মিশন ছিল—
- সাশ্রয়ী আবাসন
- পরিবহন সহজীকরণ
- অভিবাসীদের অধিকার
- পুলিশি জবাবদিহিতা
- তরুণদের সুযোগ বৃদ্ধি
এই লক্ষ্য বাস্তবায়নে তিনি অভিজ্ঞ ও বহুসাংস্কৃতিক প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি শক্তিশালী প্রশাসনিক দল তৈরি করছেন।
কেন ট্রানজিশন টিম গুরুত্বপূর্ণ?
ট্রানজিশন টিম মূলত নতুন প্রশাসনের নীতিমালা, আর্থিক পরিকল্পনা, শিক্ষা, নিরাপত্তা, শহর পরিচালনা এবং সরকারি সুবিধাসমূহ পুনর্বিন্যাসে পরামর্শ দেয়।
এই টিমের সদস্যদের সুপারিশের ভিত্তিতে পরবর্তী ৪ বছরের বাস্তব কাজ নির্ধারিত হয়।
অর্থাৎ—
নিউইয়র্ক সিটির ভবিষ্যৎ উন্নয়ন পরিকল্পনার একটি বড় অংশ এখন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত নেতাদের হাতেও।
বাংলাদেশি কমিউনিটির প্রতিক্রিয়া
ট্রানজিশন টিম ঘোষণার পর বাংলাদেশি অধ্যুষিত জ্যামাইকা, জ্যাকসন হাইটস, ব্রঙ্কস, ব্রুকলিনসহ নানা এলাকায় ব্যাপক উৎসাহ দেখা গেছে।
প্রবাসীদের মত—
- এটি নিউইয়র্কে বাংলাদেশের পরিচিতি আরও বাড়াবে
- ভবিষ্যতে আরো বাংলাদেশি রাজনীতিতে যুক্ত হতে উৎসাহ পাবে
- বাংলাদেশি শিক্ষার্থী ও তরুণদের সুযোগ বাড়বে
- শহর সরকারের বিভিন্ন সুবিধা পেতে বাংলাদেশিরা সরাসরি যোগাযোগ করতে পারবে
বহু বাংলাদেশি সংগঠন এই সাফল্যকে ‘ঐতিহাসিক’ বলে আখ্যা দিয়েছেন।
ট্রানজিশন টিমে বাংলাদেশিদের অন্তর্ভুক্তি শুধু একটি প্রশাসনিক ব্যাপার নয়। এটি বহু দশক ধরে নিউইয়র্কে বাংলাদেশিদের সংগ্রাম, কষ্ট, পরিশ্রম, কমিউনিটি গঠন ও রাজনৈতিক অংশগ্রহণের একটি পরিণতি।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন—
- বাংলাদেশি যুব সমাজ আরও সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে অংশ নেবে
- বাংলাদেশি ব্যবসায়ী ও শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠা শক্তিশালী হবে
- কমিউনিটির সমস্যাগুলো শহর প্রশাসনের কাছে সহজে পৌঁছাবে
- দক্ষিণ এশীয় রাজনীতিতে বাংলাদেশিদের নেতৃত্ব আরও দৃঢ় হবে
মেয়র জোহরান মামদানি নিউইয়র্ক সিটি পরিচালনার নতুন অধ্যায় শুরু করছেন। সেই যাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে ১০ বাংলাদেশির অন্তর্ভুক্তি প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য এক বিশাল মর্যাদা ও অনুপ্রেরণা।
বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী শহর নিউইয়র্কে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব এখন আরও শক্তিশালী, আরও দৃশ্যমান।
MAH – 13991 I Signalbd.com



