ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু নিরাপত্তা উদ্বেগের কারণে চলতি বছরের শেষের দিকে পরিকল্পিত তাঁর ভারত সফর বাতিল করেছেন। নয়াদিল্লিতে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার পর ইসরায়েলি নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর মূল্যায়ন শেষে এই সফর স্থগিতের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের জন্য তিনি ভারতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।
মঙ্গলবার (২৫ নভেম্বর) ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম আই ২৪ নিউজের বরাত দিয়ে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি এই তথ্য জানিয়েছে। এটি চলতি বছরে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রীর তৃতীয়বারের মতো ভারত সফরের পরিকল্পনা বাতিল করার ঘটনা। ধারণা করা হচ্ছে, নিরাপত্তা মূল্যায়ন প্রক্রিয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত নেতানিয়াহু আগামী বছরে সফরের জন্য নতুন তারিখ খুঁজবেন। দুই দেশের মধ্যে বাড়তে থাকা কৌশলগত সম্পর্ক এবং নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা তুলে ধরার প্রচেষ্টার জন্য এই সফর খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
নিরাপত্তা উদ্বেগ ও সফর বাতিলের কারণ
সম্প্রতি নয়াদিল্লিতে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা নেতানিয়াহুর সফর বাতিলের প্রধান কারণ হিসেবে কাজ করেছে।
সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী হামলা: দুই সপ্তাহ আগে নয়াদিল্লিতে ঘটে যাওয়া সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা নেতানিয়াহুর নিরাপত্তা নিয়ে গুরুতর উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। যেহেতু ইসরায়েলি নেতাদের ওপর প্রায়ই হামলার ঝুঁকি থাকে, তাই নিরাপত্তা সংস্থাগুলো পরিস্থিতি গভীরভাবে মূল্যায়ন করছে।
নিরাপত্তা মূল্যায়নের প্রয়োজন: ইসরায়েলি সূত্রগুলো জানিয়েছে, হামলা পরবর্তী পরিস্থিতি এবং ভারতের নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর মূল্যায়ন শেষ না হওয়া পর্যন্ত এই সফর স্থগিত থাকবে। নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর সবুজ সংকেত পাওয়ার পরই সফরের নতুন তারিখ নির্ধারণ করা হবে।
তৃতীয়বারের মতো বাতিল: এটি চলতি বছরে নেতানিয়াহুর তৃতীয়বারের মতো ভারত সফরের পরিকল্পনা বাতিল। এর আগে সেপ্টেম্বরে ইসরায়েলে পুনরায় নির্বাচনের ঘোষণা এবং তারও আগে এপ্রিলের নির্বাচনের কারণে সময়সূচিগত জটিলতার কথা উল্লেখ করে তিনি দু’বার সফর স্থগিত করেছিলেন।
মোদি-নেতানিয়াহুর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক
ভারত ও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যেকার ব্যক্তিগত সম্পর্ক দুই দেশের কৌশলগত সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে।
ঐতিহাসিক সফর: নেতানিয়াহু সবশেষ ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে ভারত সফর করেছিলেন। এর আগে ২০১৭ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ইসরায়েলের রাজধানী তেল আবিব সফর করেন, যা ছিল কোনো ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রথম ইসরায়েল সফর।
কৌশলগত অংশীদারিত্ব: দুই দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা, কৃষি, প্রযুক্তি এবং নিরাপত্তা ক্ষেত্রে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা রয়েছে। এই সফর মূলত দ্বিপাক্ষিক অংশীদারিত্বকে আরও জোরদার করার উদ্দেশ্যে পরিকল্পিত ছিল।
ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতা: ভারতীয় ও ইসরায়েলি গণমাধ্যমে দুই নেতার ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতা নিয়ে প্রায়শই আলোচনা হয়। তাদের সম্পর্কের উষ্ণতা দুই দেশের সরকারের মধ্যে সম্পর্ককে প্রভাবিত করেছে।
নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা
নেতানিয়াহুর এই সফরকে ইসরায়েলের রাজনীতিতে তাঁর ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি ও বিশ্বব্যাপী তাঁর গ্রহণযোগ্যতা তুলে ধরার একটি প্রচেষ্টা হিসেবে দেখা হচ্ছিল।
রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা: ইসরায়েলে চলমান রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে নেতানিয়াহুর এই ধরনের আন্তর্জাতিক সফর তাঁর বিশ্বনেতা হিসেবে মর্যাদা তুলে ধরার একটি সুযোগ হিসেবে গণ্য হয়। এটি তাঁর অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অবস্থানকে শক্তিশালী করতে সাহায্য করে।
নির্বাচনী প্রচারণার উপাদান: গত জুলাইয়ে তাঁর রাজনৈতিক দল নির্বাচনী প্রচারণার অংশ হিসেবে এমন ব্যানার টাঙিয়েছিল, যেখানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদির পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে নেতানিয়াহুর ছবি ব্যবহার করা হয়। এর মাধ্যমে তাঁকে ‘ভিন্ন স্তরের’ নেতা হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছিল।
নিরাপত্তার প্রতি গুরুত্ব: তাঁর নির্বাচনী প্রচারণায় বিশ্বনেতাদের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতা এবং ইসরায়েলের নিরাপত্তায় তাঁর ভূমিকা – এসব বিষয় গুরুত্ব দিয়ে উপস্থাপন করা হচ্ছে।
প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া: সফরের বিলম্ব
নেতানিয়াহুর সফর বাতিলের সিদ্ধান্ত ভারত ও ইসরায়েলের কূটনৈতিক ও কৌশলগত সম্পর্কের ওপর কিছুটা হলেও প্রভাব ফেলতে পারে।
কূটনৈতিক বার্তা: যদিও আনুষ্ঠানিক কারণ নিরাপত্তা উদ্বেগ, তবে বারবার সফর বাতিলের ঘটনা দুই দেশের মধ্যে উচ্চ পর্যায়ের কূটনৈতিক আলোচনায় সাময়িক বিলম্ব ঘটাবে।
পরিকল্পনার পুনর্বিন্যাস: এই সফর বাতিল হওয়ায় দুই দেশের মধ্যে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি এবং কৌশলগত আলোচনার তারিখ পুনরায় নির্ধারণ করতে হবে।
ভারতের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা: নয়াদিল্লিতে হামলার ঘটনা ভারতের নিরাপত্তা ব্যবস্থার কার্যকারিতা নিয়েও আন্তর্জাতিক মহলে প্রশ্ন তুলতে পারে। নেতানিয়াহুর এই সিদ্ধান্ত সেই উদ্বেগকেই আরও বাড়িয়ে তুলল।
এনডিটিভি প্রতিবেদন (কোট): “নিরাপত্তা মূল্যায়ন সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত নেতানিয়াহু আগামী বছরে সফরের নতুন তারিখ খুঁজবেন বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে।”
দীর্ঘমেয়াদী সম্পর্কের স্থিতিশীলতা
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ভারত সফরের বারবার বাতিল হওয়া ঘটনাটি নিঃসন্দেহে দুই দেশের কূটনৈতিক ক্যালেন্ডারের জন্য একটি ধাক্কা। তবে এটি মূলত নিরাপত্তা উদ্বেগ এবং ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতির ফল। মোদি ও নেতানিয়াহুর ব্যক্তিগত সম্পর্ক এবং দুই দেশের কৌশলগত অংশীদারিত্বের ভিত্তি খুবই মজবুত। তাই, সাময়িক এই বাতিল বা স্থগিতাদেশ সত্ত্বেও, আশা করা যায় যে নিরাপত্তা ঝুঁকিগুলো দূর হওয়ার পরই আগামী বছরে দুই নেতা পুনরায় সাক্ষাতের সুযোগ পাবেন। কৌশলগত সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে যেতে উভয় দেশই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
এম আর এম – ২৩৭৩,Signalbd.com



