ইরানে ধর্ষণের দায়ে দোষী সাব্যস্ত এক ব্যক্তির ওপর প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। দেশটির উত্তরাঞ্চলের সেমনান প্রদেশে সুপ্রিম কোর্টের রায় বহাল থাকার পর স্থানীয়ভাবে এই শাস্তি কার্যকর করে কর্তৃপক্ষ। ইরানের বিচারবিভাগীয় গণমাধ্যম মিজান অনলাইন এই তথ্য নিশ্চিত করেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইরানে বিভিন্ন গুরুতর অপরাধে প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ডের ঘটনা ঘটলেও, যৌন সহিংসতার মামলায় এমন প্রকাশ্য শাস্তি তুলনামূলকভাবে কম। ফলে ঘটনাটি দেশজুড়ে বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
ঘটনার বিস্তারিত
ইরানি বিচার বিভাগের তথ্যানুযায়ী, দোষী ব্যক্তি দুই নারীর সঙ্গে প্রতারণা, ভয়ভীতি প্রদর্শন এবং ধর্ষণের মতো গুরুতর অপরাধ করেছেন। শুধু জোরপূর্বক যৌন সহিংসতাই নয়, ভুক্তভোগীদের সম্মানহানির হুমকিও দিয়েছেন তিনি। তদন্ত, প্রমাণ উপস্থাপন এবং আদালতের ধারাবাহিক শুনানির পর তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। পরবর্তীতে মামলাটি সুপ্রিম কোর্টে গেলে শীর্ষ আদালতও নিচের আদালতের রায় বহাল রাখে।
মিজান অনলাইনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সুপ্রিম কোর্টের পর্যালোচনার পর বাসতাম শহরে প্রকাশ্যে শাস্তি কার্যকর করা হয়। তবে নিরাপত্তাজনিত কারণে অভিযুক্ত ব্যক্তির পরিচয় প্রকাশ করা হয়নি। ইরানের বিচারব্যবস্থায় অভিযুক্তের পরিচয় গোপন রাখার এমন নজির আগেও রয়েছে, বিশেষ করে যৌন সহিংসতার মামলাগুলোতে।
ইরানের আইনব্যবস্থায় প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ড
ইরান মূলত কারাগারের ভেতরেই মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে থাকে। তবে কিছু বিশেষ অপরাধ—যেমন ধর্ষণ, হত্যা, রাষ্ট্রদ্রোহ, সন্ত্রাসবাদ কিংবা সমাজে ব্যাপক হুমকি সৃষ্টিকারী অপরাধের ক্ষেত্রে প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। এর মূল উদ্দেশ্য দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করা এবং অপরাধ দমনে কড়া বার্তা দেওয়া।
ধর্ষণের মতো অপরাধ ইরানে সর্বোচ্চ শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়। দেশের দণ্ডবিধিতে এই অপরাধে দ্রুত বিচার প্রক্রিয়া, কঠোর তদন্ত ব্যবস্থা এবং সর্বোচ্চ শাস্তি কার্যকরের সুযোগ রয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, ইরান সরকার সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অপরাধ দমনে কঠোর নীতি অবলম্বন করছে। বিভিন্ন প্রদেশে মাদক ব্যবসা, যৌন নিপীড়ন, সন্ত্রাসবাদ বা গ্যাং–সংগঠিত অপরাধের বিরুদ্ধে আইন–শৃঙ্খলা বাহিনী সক্রিয়ভাবে অভিযান পরিচালনা করছে।
মানবাধিকার সংস্থাগুলোর উদ্বেগ
যদিও ইরান জানায়, সমাজে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ ও নারীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতেই এমন কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে, তবে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ডকে বরাবরই সমালোচনা করে আসছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা দাবি করে, প্রকাশ্যে শাস্তি মানবাধিকারের পরিপন্থী এবং এটি সমাজে ভয় ও আতঙ্ক বাড়াতে পারে।
আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলোর মতে, প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হলে তা মনস্তাত্ত্বিকভাবে জনগণের ওপর প্রভাব ফেলে এবং কখনও কখনও সামাজিক সহিংসতার পরিবেশ সৃষ্টি করে। আবার ইরান সরকার ও দেশটির অনেক নাগরিক বিশ্বাস করেন, এ ধরনের কঠোর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিই অপরাধ দমনে কার্যকর ভূমিকা রাখে।
ইরানে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের পরিসংখ্যান
বিশ্বের যেসব দেশে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়, ইরান তাদের মধ্যে অন্যতম। সাম্প্রতিক আন্তর্জাতিক প্রতিবেদনগুলো বলছে—
- গত কয়েক বছরে দেশটিতে বার্ষিক হাজারেরও বেশি মানুষের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়।
- বিশেষ করে ধর্ষণ, মাদক চোরাচালান, সন্ত্রাসবাদ ও হত্যার মতো গুরুতর অপরাধে এই সংখ্যা বেশি।
- তবে যৌন অপরাধে প্রকাশ্যে শাস্তি কার্যকরের ঘটনা তুলনামূলক কম এবং ঘটনাটি সমাজে তীব্র আলোচনার সৃষ্টি করে।
একই সঙ্গে ইরানের বিচারবিভাগীয় কর্তৃপক্ষ মনে করে, দ্রুত বিচার এবং কড়াকড়ি অপরাধ দমনমূলক ব্যবস্থা সমাজে অপরাধপ্রবণতা কমাতে সাহায্য করবে।
স্থানীয় জনমত: ভুক্তভোগীদের নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনা
এই ঘটনার পর সেমনান প্রদেশসহ ইরানের বিভিন্ন জায়গায় নারী অধিকার, নিরাপত্তা এবং বিচারব্যবস্থার কার্যকারিতা নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। অনেকেই মনে করেন—
- যৌন অপরাধ যেমন ভয়াবহ,
- এর শাস্তি ততটাই কঠোর হওয়া প্রয়োজন,
- যাতে সম্ভাব্য অপরাধীরা ভয় পায় এবং সমাজ নিরাপদ থাকে।
অন্যদিকে, কিছু পর্যবেক্ষক মনে করেন যে কেবল শাস্তি কঠোর করলেই যৌন অপরাধ কমে না; বরং সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারি ও ভুক্তভোগীদের সাহসী হয়ে অভিযোগ জানানোর পরিবেশ তৈরি করতে হবে।
ইরানের সামাজিক বাস্তবতা ও যৌন অপরাধ দমন
ইরান এমন একটি দেশ যেখানে সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ অত্যন্ত দৃঢ়। এই কারণে যৌন অপরাধকে দেশটিতে ভয়াবহ অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
তদন্তে দেখা গেছে—
- ধর্ষণের শিকার নারীরা অনেক সময় সামাজিক লজ্জা, ভয়ভীতি ও চাপের কারণে অভিযোগ করেন না।
- তাই সরকার কঠোর শাস্তির পাশাপাশি আইনি সুরক্ষা, নারীদের নিরাপত্তা ও সচেতনতা বৃদ্ধির দিকটিও নজরে রাখছে।
রাষ্ট্রের তথ্য অনুযায়ী, যৌন সহিংসতার বহু মামলা এখন আগের তুলনায় দ্রুত বিচার পাচ্ছে। বিশেষ নারী–ও শিশু–নির্যাতন আদালত গঠনের ফলে তদন্ত ও বিচার কার্যক্রম আরও গতিশীল হয়েছে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশগুলোও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যৌন অপরাধের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রণয়ন করেছে। সৌদি আরব, ইরাক ও আফগানিস্তানেও ধর্ষণের শাস্তি অত্যন্ত কঠোর। তবে প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার ঘটনা তুলনামূলকভাবে ইরানেই বেশি দেখা যায়।
আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের মতে—
- মধ্যপ্রাচ্যের সামাজিক কাঠামো,
- ধর্মীয় মূল্যবোধ,
- এবং আইনব্যবস্থার কঠোরতা
এই ধরনের শাস্তি কার্যকরের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে।
সমাজে বার্তা এবং ভবিষ্যৎ প্রভাব
প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার মাধ্যমে ইরান সরকার অপরাধীদের কাছে একটি শক্ত বার্তা পাঠাতে চায়—
যে ধর্ষণ বা নারীর সম্মানহানির মতো অপরাধ কোনোভাবেই সহ্য করা হবে না।
বিশ্লেষকদের মতে, এই ধরনের শাস্তি অপরাধীদের মাঝে ভয় তৈরি করতে পারে। তবে দীর্ঘমেয়াদে যৌন অপরাধ কমানোর জন্য—
- সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি,
- ভুক্তভোগীদের পাশে দাঁড়ানো,
- আইনি প্রক্রিয়া সহজ করা
এসব উদ্যোগও সমান গুরুত্বপূর্ণ।
MAH – 13987 I Signalbd.com



