মালয়েশিয়া সরকার আগামী বছর থেকে দেশের ১৬ বছর বয়সের কম সব শিশু-কিশোরের জন্য সামাজিকমাধ্যম ব্যবহার পুরোপুরি নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্তের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য, অনলাইন নিরাপত্তা এবং ডিজিটাল সহিংসতা মোকাবিলার স্বার্থে এই নতুন নীতিমালা তৈরি করা হচ্ছে। মালয়েশিয়ার যোগাযোগমন্ত্রী ফাহমি ফাদজিল রাজধানী কুয়ালালামপুরে এক অনুষ্ঠানে সরকারের এ পরিকল্পনার কথা জানান।
শিশু সুরক্ষা ও অনলাইন হুমকির বিষয়ে যে উদ্বেগ বিশ্বব্যাপী বাড়ছে, মালয়েশিয়ার এ সিদ্ধান্তকে সেই আন্তর্জাতিক চলমান আলোচনার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ হিসেবে দেখা হচ্ছে। বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জাপানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ইতোমধ্যেই নাবালক ব্যবহারকারীদের জন্য সামাজিকমাধ্যম ব্যবহারে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে অথবা নতুন আইন প্রণয়নের কাজ করছে।
শিশুদের অনলাইন নিরাপত্তা: মালয়েশিয়ার প্রধান উদ্বেগ
ফাহমি ফাদজিল বলেন, সরকার বিভিন্ন দেশের মডেল পর্যালোচনা করছে, বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়ার আইনকে নীতিনির্ধারণে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। তিনি জানান, সামাজিকমাধ্যমে সাইবার বুলিং, মিথ্যা তথ্য প্রচার, প্রতারণা, আর্থিক কেলেঙ্কারি, যৌন হয়রানি, শিশু যৌন নির্যাতন এবং উগ্রবাদী মতাদর্শ ছড়ানোর মতো হুমকি বর্তমানে বাড়ছে। এর ফলে শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকি বৃদ্ধি পেয়েছে।
ফাহমি বলেন, “আমরা চাই না আমাদের শিশুরা অল্প বয়সেই ক্ষতিকর কনটেন্টের শিকার হোক। আগামী বছরের মধ্যেই ১৬ বছরের কম বয়সীদের জন্য সামাজিকমাধ্যমে নতুন অ্যাকাউন্ট খোলার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে। বিদ্যমান অ্যাকাউন্টগুলোও নিষ্ক্রিয় করা হবে।”
তিনি আশা প্রকাশ করেন যে বড় প্ল্যাটফর্মগুলো—যেমন মেটা, টিকটক, ইউটিউব, স্ন্যাপচ্যাট এবং এক্স—নতুন সরকারি নির্দেশনা যথাযথভাবে মেনে চলবে।
বিশ্বজুড়ে শিশুদের জন্য সামাজিকমাধ্যম সীমাবদ্ধতার প্রবণতা
শিশুদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ শুধু মালয়েশিয়ার নয়; এটি বর্তমানে বৈশ্বিক ইস্যু। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে টিকটক, গুগল, মেটা এবং স্ন্যাপচ্যাটের বিরুদ্ধে শতাধিক মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে যে এসব প্ল্যাটফর্ম শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য সংকটকে বাড়িয়ে তুলছে। কিশোরদের মধ্যে অবসাদ, উদ্বেগ, শরীর–বিষয়ক অসন্তুষ্টি এবং অনলাইন আসক্তি বাড়াতে এগুলো দায়ী বলে অভিযোগ রয়েছে।
অস্ট্রেলিয়া ২০২৫ সাল থেকেই ১৬ বছরের কম বয়সী ব্যবহারকারীদের বাধ্যতামূলক বয়স যাচাইয়ের অধীনে আনছে, এবং যেসব অ্যাকাউন্ট প্রমাণসহ বয়স নিশ্চিত করতে পারবে না, সেগুলো নিষ্ক্রিয় করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। দেশটি টিকটকসহ একাধিক প্ল্যাটফর্মকে শিশু–কিশোরদের জন্য উচ্চ–ঝুঁকির তালিকায় রেখেছে।
এ ছাড়া জাপান সম্প্রতি নতুন গাইডলাইন তৈরি করেছে, যাতে অভিভাবকদের অনুমতি ছাড়া ১৮ বছরের কম বয়সীদের সামাজিকমাধ্যম ব্যবহার সীমাবদ্ধ করা হয়। ফ্রান্সও একই পথে হাঁটছে।
মালয়েশিয়ায় অনলাইন জুয়া ও ঘৃণ্য কনটেন্ট বেড়ে যাওয়া বড় কারণ
মালয়েশিয়ায় গত কয়েক বছরে অনলাইন জুয়ার প্রবণতা উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। একই সঙ্গে জাতি, ধর্ম এবং রাজপরিবার সম্পর্কিত উসকানিমূলক ও ঘৃণামূলক পোস্টের সংখ্যা বৃদ্ধির কারণে সরকার বড় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোকে কড়া নজরদারিতে রেখেছে।
সরকার জানিয়েছে, বর্তমানে ফেসবুক, টিকটক, ইউটিউব ও এক্স প্ল্যাটফর্মে ঘৃণামূলক বক্তব্য, গুজব, ভুল তথ্য (মিসইনফরমেশন) এবং সাইবার প্রতারণার ঘটনা বাড়ছে। শিশু ও কিশোররা এসব কনটেন্টের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ভোক্তা। তাই এই বয়সী ব্যবহারকারীদের ঝুঁকি কমাতে সরকার বিশেষ উদ্যোগ নিতে বাধ্য হয়েছে।
শিশু মনোবিদদের সমর্থন: অল্প বয়সে স্মার্টফোন–নির্ভরতা বিপজ্জনক
সামাজিকমাধ্যমের অতিরিক্ত ব্যবহার শিশুদের মস্তিষ্কের স্বাভাবিক বিকাশ ব্যাহত করতে পারে বলে দাবি করেন মালয়েশিয়ার একাধিক শিশু মনোবিদ। তাদের মতে, শৈশবে ডিজিটাল ডিভাইসের ওপর নির্ভরতা বাড়লে—
- মনোযোগ কমে যায়
- আবেগ নিয়ন্ত্রণে সমস্যা তৈরি হয়
- বাস্তব–জগতের সামাজিক দক্ষতা কমে যায়
- অনলাইনে লুকানো অপরাধীদের টার্গেটে পরিণত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে
- কনটেন্ট আসক্তি (ডিজিটাল অ্যাডিকশন) গড়ে ওঠে
- শিক্ষাগত উন্নতি পিছিয়ে পড়ে
মালয়েশিয়ান অ্যাসোসিয়েশন অব সাইকোলজি জানিয়েছে, শিশুদের সামাজিকমাধ্যম ব্যবহারের কারণে গত পাঁচ বছরে দেশের মানসিক সমস্যা বৃদ্ধি পেয়েছে ৩০ শতাংশেরও বেশি।
সরকারের পরিকল্পনা: কী থাকতে পারে নতুন আইনে
মালয়েশিয়া সরকার যে নীতিমালা প্রণয়ন করতে যাচ্ছে, তাতে থাকতে পারে—
- ১৬ বছরের নিচে কেউ সামাজিকমাধ্যম অ্যাকাউন্ট খুলতে পারবে না
- বিদ্যমান নাবালক অ্যাকাউন্ট শনাক্ত করে নিষ্ক্রিয় করা হবে
- সকল প্ল্যাটফর্মে বাধ্যতামূলক বয়স যাচাই ব্যবস্থা
- অভিভাবক নিয়ন্ত্রণ এবং পর্যবেক্ষণ সরঞ্জাম বাধ্যতামূলক করা
- ক্ষতিকর কনটেন্ট শনাক্তে প্রযুক্তি কোম্পানির বাড়তি দায়িত্ব
- শিশু সাইবার সুরক্ষা শিক্ষায় জাতীয় কর্মসূচি
- অনলাইন জুয়া ও প্রতারণা রোধে পুলিশ ও সাইবার ইউনিটের বিশেষ টাস্কফোর্স
মালয়েশিয়ার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও নতুন আইনকে সমর্থন জানিয়েছে। তারা বলেছে, শিক্ষার্থীরা অনলাইনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় নষ্ট করছে, যা তাদের পড়াশোনার ক্ষতি করছে।
সামাজিকমাধ্যম কোম্পানিগুলোর প্রতিক্রিয়া
এখনও বড় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেয়নি। তবে শিল্প-বিশ্লেষকদের মতে, মালয়েশিয়ার সিদ্ধান্ত অন্যান্য দেশের ওপরও প্রভাব ফেলতে পারে। যদি এই দেশ সফলভাবে নীতি বাস্তবায়ন করতে পারে, তবে দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশও একই ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
টেক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বয়স যাচাই ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করা সহজ হবে না। তবে সরকার যদি টেলিকম অপারেটর ও জাতীয় পরিচয়পত্র ডাটাবেসের সঙ্গে যুক্ত করে বাধ্যতামূলক পদ্ধতি চাপায়, তাহলে প্ল্যাটফর্মগুলোকে মানতেই হবে।
অভিভাবকদের প্রতিক্রিয়া
মালয়েশিয়ার অনেক অভিভাবক সরকারের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন। বিশেষ করে বড় শহরগুলোতে অভিভাবকরা মনে করেন—
- শিশুরা পড়াশোনায় মনোযোগ হারাচ্ছে
- রাত জেগে গেমস ও সামাজিকমাধ্যম ব্যবহার করছে
- সাইবার বুলিংয়ের শিকার হচ্ছে
- অপরিচিত লোকের সঙ্গে ঝুঁকিপূর্ণ যোগাযোগ করছে
তবে কিছু পরিবারের উদ্বেগ রয়েছে যে, এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা শিশুদের প্রযুক্তিগত দক্ষতা অর্জনের সুযোগ কমাতে পারে। সরকার বলেছে, শিক্ষামূলক ও নিরাপদ প্ল্যাটফর্মে শিশুদের প্রবেশাধিকার আগের মতোই থাকবে।
শিশু সুরক্ষায় বৈশ্বিক উদ্যোগের ভবিষ্যৎ
বিশ্বজুড়ে এখন শিশু–কিশোরদের অনলাইন অভিজ্ঞতা সুরক্ষিত করতে কঠোর আইন প্রণয়ন হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, আগামী পাঁচ বছরে সামাজিকমাধ্যমে শিশুদের উপস্থিতি আরও সীমিত করার প্রবণতা বাড়বে।
মালয়েশিয়ার আইন কার্যকর হলে দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার দুই কোটিরও বেশি শিশু–কিশোর এর আওতায় আসবে। এটি হবে অঞ্চলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ডিজিটাল নিরাপত্তা সংস্কার।
মালয়েশিয়ার এই সিদ্ধান্ত প্রমাণ করে যে বিশ্বব্যাপী সরকারগুলো শিশুদের ডিজিটাল নিরাপত্তাকে এখন গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় নীতি হিসেবে দেখছে। সামাজিকমাধ্যম প্ল্যাটফর্মগুলোকে শুধু লাভ বা ব্যবহারকারী বৃদ্ধির দিকে নয়, শিশু–কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার বিষয়েও আরও দায়িত্বশীল হতে হবে।
আগামী বছর আইন কার্যকর হলে দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ায় নতুন যুগের সূচনা হবে—যেখানে শিশুদের অনলাইন ভবিষ্যৎ আরও নিরাপদ, নিয়ন্ত্রিত ও সুরক্ষিত হবে।
MAH – 13951 I Signalbd.com



