ইয়েমেনের হুথি-নিয়ন্ত্রিত রাজধানী সানা বর্তমানে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নজরকাড়া একটি রায়কে কেন্দ্র করে আলোচনার কেন্দ্রে। আমেরিকা ও ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ১৭ জনকে গুলি করে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার আদেশ দিয়েছে হুথি পরিচালিত স্পেশালাইজড ক্রিমিনাল কোর্ট। একই মামলায় আরও এক পুরুষ ও এক নারীকে ১০ বছরের কারাদণ্ড এবং একজনকে খালাস দেওয়া হয়েছে। এ ঘটনা শুধু ইয়েমেন নয়, পুরো মধ্যপ্রাচ্য ও বৈশ্বিক কূটনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
হুথি সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে—এই ব্যক্তিরা এক বৃহৎ গুপ্তচর নেটওয়ার্কের অংশ হিসেবে কাজ করছিলেন, যাদের মূল লক্ষ্য ছিল ইয়েমেনের সামরিক, নিরাপত্তা ও রাষ্ট্রীয় স্থাপনায় হামলার তথ্য সংগ্রহ এবং সে অনুযায়ী শত্রুপক্ষকে সুবিধা পাইয়ে দেওয়া। অভিযোগ অনুযায়ী, এসব কার্যক্রম ২০২৪ থেকে ২০২৫ সালের বিভিন্ন সময়ে সংঘটিত হয়।
হুথি আদালতের অভিযোগ: মোসাদ ও অন্যান্য বিদেশি সংস্থার হয়ে কাজ
ইয়েমেনের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা সাবা জানায়, আটক ব্যক্তিরা আমেরিকা ও ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা—বিশেষ করে মোসাদ—এর নির্দেশে তথ্য সংগ্রহ, যোগাযোগ স্থাপন, সাধারণ জনগণকে উসকে দেওয়া এবং অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা বাড়ানোর মতো কাজে যুক্ত ছিলেন।
হুথিদের দাবি, এই নেটওয়ার্ক ইয়েমেনের গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘাঁটি, অস্ত্রভাণ্ডার, বিমানবন্দর, যোগাযোগ ব্যবস্থা, এবং বেসামরিক স্থাপনাগুলোর নিরাপত্তা সম্পর্কিত তথ্য বিদেশি গোয়েন্দাদের কাছে সরবরাহ করত। এ সব তথ্যের ওপর ভিত্তি করে একাধিক হামলা হয়েছে, যাতে প্রাণহানি ও বড় ধরনের অবকাঠামোগত ক্ষতি ঘটে।
হুথি নেতৃত্ব আরও জানায় যে, অভিযুক্তদের মাধ্যমে সংগৃহীত তথ্য আমেরিকা ও ইসরাইলের হাতে পৌঁছানোর পর সেগুলো ইয়েমেনে কার্যক্রম পরিচালনা, ড্রোন হামলা এবং গুপ্ত আঘাতের সহায়তা করেছে।
প্রধানমন্ত্রীর হত্যাকাণ্ডের পর অভিযান আরও তীব্র
ইয়েমেনে ইসরাইলি ড্রোন হামলায় প্রধানমন্ত্রী আহমেদ গালেব নাসের আল-রাহাবি নিহত হওয়ার পর থেকেই দেশে সন্দেহভাজন ‘গুপ্তচর’ ধরতে বিশেষ অভিযান শুরু করে হুথি প্রশাসন। এই হত্যাকাণ্ডকে হুথিরা ইয়েমেনের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার ওপর সরাসরি আঘাত বলে মনে করছে। ফলে বড় পরিসরে অভিযান ছড়িয়ে পড়ে সানা, আল-হুদাইদা, সাদাহ, আমরানসহ বিভিন্ন এলাকায়।
হুথিদের অভিযোগ—ইসরাইলের এ হামলা সফল করতে অভ্যন্তরীণ তথ্য ফাঁস করা হয়েছিল। তাই এই নেটওয়ার্ক ভেঙে দেওয়াকে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য অপরিহার্য বলে উল্লেখ করেছে সানা প্রশাসন।
এই ঘটনার পর হুথিরা একাধিক স্থানে অভিযানে অংশ নিয়ে ডজনখানেক সন্দেহভাজনকে আটক করে। তদন্তে উঠে আসে বিভিন্ন যোগাযোগের নথি, বিদেশে পাঠানো তথ্যের ইতিহাস, গোপন কোডযুক্ত বার্তা এবং সন্দেহজনক আর্থিক লেনদেনের তথ্য।
আসামিপক্ষের বক্তব্য ও আপিলের সুযোগ
গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের আইনজীবী আব্দুল বাসিত গাজী জানান, আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে। তাঁর মতে, অনেক অভিযোগই যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই গঠিত হয়েছে এবং আসামিরা ন্যায্য বিচারের সুযোগ পাননি।
তবে হুথি প্রশাসনের দাবি, তারা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের ভিত্তিতেই বিচার পরিচালনা করেছে এবং প্রাপ্ত প্রমাণ এতটাই শক্তিশালী ছিল যে আদালত সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া ছাড়া আর কোনো পথ খোলা ছিল না।
মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে প্রতিক্রিয়া ও ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষণ
এই রায় ঘোষণার পর মধ্যপ্রাচ্যের নানান রাজনৈতিক মহলে প্রতিক্রিয়া চলছে। আমেরিকা বা ইসরাইল এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে এ বিষয়ে মন্তব্য করেনি। তবে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই রায় অঞ্চলটিতে নতুন উত্তেজনা তৈরি করতে পারে।
ইয়েমেন, ইসরাইল, আমেরিকা এবং ইরান—এই চার পক্ষের সম্পর্ক মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরেই উত্তেজনাপূর্ণ। হুথিরা ইরানের সমর্থনপুষ্ট হিসেবে পরিচিত, এবং ইসরাইল-হামাস যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে হুথিরা রেড সি অঞ্চল দিয়ে ইসরাইলগামী কার্গো জাহাজে একাধিক হামলা চালায়। এতে মার্কিন নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক জাহাজ রক্ষা জোট হুথিদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়।
এই প্রেক্ষাপটে ১৭ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া শুধু একটি আইনি রায় নয়—বরং এটি এক ধরনের রাজনৈতিক বার্তা এবং শক্তি প্রদর্শন বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
রেড সি সংকট ও ইয়েমেনের গুরুত্ব
ইয়েমেনের ভৌগোলিক অবস্থান মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম কৌশলগত স্থানে। রেড সি ও বাব-আল-মান্দেব প্রণালী বিশ্ববাণিজ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পথ। এই কারণে মার্কিন ও ইউরোপীয় শক্তিগুলো দীর্ঘদিন ধরে ইয়েমেনের স্থিতিশীলতাকে নিজেদের নিরাপত্তার অংশ হিসেবে দেখে।
হুথিদের নিয়ন্ত্রণ বলয় যত বাড়ছে, ততই পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর নজরও বাড়ছে। ফলে গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়া এবং গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ ওঠা স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ইয়েমেন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন—হুথি প্রশাসনের এ ধরনের পদক্ষেপ দৃশ্যত কঠোর মনে হলেও এটির মাধ্যমে তারা দেখাতে চায় যে দেশের নিরাপত্তা বিষয়ে বিদেশি হস্তক্ষেপকে তারা কোনোভাবেই সহ্য করবে না।
ইয়েমেনে চলমান যুদ্ধে এই রায়ের প্রভাব
২০১৪ সাল থেকে শুরু হওয়া ইয়েমেন যুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি। সৌদি জোটের অবরোধ, আঞ্চলিক শক্তিগুলোর পর্দার আড়ালের সংঘাত, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা—সব মিলিয়ে যুদ্ধটি অনবরত চলছে। হুথিদের এমন রায়ে ভবিষ্যতে নিম্নোক্ত প্রভাব পড়তে পারে:
১. বিদেশি শক্তির সঙ্গে উত্তেজনা আরও বাড়বে
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল এই ঘটনার প্রতিক্রিয়া হিসেবে নতুন কৌশল গ্রহণ করতে পারে।
২. ইয়েমেনের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ব্যবস্থায় পরিবর্তন আসতে পারে
গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক ভাঙার নামে আরও শতাধিক সন্দেহভাজনকে নজরবন্দী করা হতে পারে।
৩. আলোচনার পথ আরও কঠিন হয়ে উঠতে পারে
ইয়েমেন যুদ্ধ বন্ধে জাতিসংঘের মধ্যস্থতা ইতিমধ্যেই ধীরগতিতে এগোচ্ছে। এমন কঠোর দণ্ড সেই প্রক্রিয়াকে আরও জটিল করতে পারে।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর উদ্বেগ
মানবাধিকার পর্যবেক্ষকরা বলছেন—মৃত্যুদণ্ডের রায়টি অত্যন্ত কঠোর, এবং হুথিদের বিচারব্যবস্থা আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করেছে কি না, সে বিষয়ে সন্দেহ রয়েছে। বিশেষ করে একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে স্বচ্ছ বিচার নিশ্চিত করা অত্যন্ত কঠিন।
তবে হুথিদের বক্তব্য হলো—দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা রক্ষার জন্য তারা এ রায় দিতে বাধ্য হয়েছে।
ইয়েমেনি জনগণের প্রতিক্রিয়া
সানা ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় জনমত দুই ভাগে বিভক্ত।
একাংশ মনে করছে, বিদেশি শক্তির গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক ভেঙে দেওয়া দেশের নিরাপত্তার জন্য ইতিবাচক।
অন্যদিকে একাংশ মনে করছে—এই রায় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হতে পারে, এবং কিছু নিরপরাধ ব্যক্তি ফাঁস হতে পারেন।
ভারী নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যে আদালতের বাইরে সমর্থক ও বিরোধী উভয় পক্ষই অবস্থান নেয়। তবে হুথিরা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে—তারা দেশের সার্বভৌমত্ব নিয়ে কোনো আপস করতে প্রস্তুত নয়।
বিশ্ব রাজনীতিতে এর ভবিষ্যৎ প্রভাব
বৈশ্বিক কূটনীতি বিশ্লেষকদের ধারণা, এই ঘটনাটি মধ্যপ্রাচ্যে আরো একটি নতুন উত্তেজনার পর্যায় তৈরি করতে পারে। আমেরিকা ও ইসরাইল কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানাবে, সেটিই এখন দেখার বিষয়।
ইয়েমেন এখনই রেড সি–কেন্দ্রিক আন্তর্জাতিক উত্তেজনার মূল কেন্দ্রগুলোর একটি। হুথিদের দণ্ডাদেশ সেই সংকটকে আরও জটিল করতে পারে এবং নতুন ভূরাজনৈতিক সমীকরণ তৈরি করতে পারে।
ইয়েমেনে আমেরিকা ও ইসরাইলের ১৭ গোয়েন্দার মৃত্যুদণ্ড শুধু দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নয়—পুরো মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষমতার ভারসাম্যকে প্রভাবিত করতে পারে। এই রায়ের ফলে আগামী মাসগুলোতে আঞ্চলিক শক্তিগুলোর নড়াচড়া, নতুন জোট, প্রতিক্রিয়া এবং সম্ভাব্য প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপগুলোর দিকে এখন বিশ্ব তাকিয়ে থাকবে।
সানা আদালতের এই কঠোর রায় কি ইয়েমেনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে, নাকি অঞ্চলটিকে আরও নতুন সংঘাতে ঠেলে দেবে—সময়ই সেই উত্তর দেবে।
MAH – 13950 I Signalbd.com



