জাপানের সামরিকবাদকে কোনোভাবেই ফিরে আসতে দেওয়া হবে না বলে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে চীন। জাপানের শীর্ষ নেতৃত্বকে লক্ষ্য করে সম্প্রতি কঠোর বার্তা দেওয়ার পর দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক আবারও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। এই হুঁশিয়ারি এমন এক সময়ে এলো, যখন জাপান তার সামরিক নীতিতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনছে এবং প্রতিরক্ষা বাজেট ক্রমাগত বাড়িয়ে চলেছে।
শনিবার (২২ নভেম্বর) দুশানবেতে তাজিক পররাষ্ট্রমন্ত্রী সিরোজিদ্দিন মুহরিদ্দিনের সঙ্গে প্রথম কৌশলগত বৈঠকে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই এই মন্তব্য করেন। তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দেন, চীন এক-চীন নীতির আন্তর্জাতিক ঐক্যমতে শক্ত অবস্থান বজায় রাখতে সব পক্ষের সঙ্গে কাজ করবে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিজয় থেকে প্রাপ্ত অর্জনগুলোকে সুরক্ষা দেবে।
চীনের কঠোর বার্তার মূল কারণ
চীনের এই কঠোর হুঁশিয়ারির পেছনে জাপানের প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্য উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সাম্প্রতিক মন্তব্য এবং জাপানের সামরিক নীতিতে আসা পরিবর্তনগুলো প্রধানত দায়ী।
তাইওয়ান প্রসঙ্গে জাপানের মন্তব্য: জাপানের প্রধানমন্ত্রী সানায়ে তাকাইচি সম্প্রতি মন্তব্য করেন যে, তাইওয়ানে চীনা হামলা হলে তা টোকিওর জন্য ‘অস্তিত্বের হুমকির পরিস্থিতি’ তৈরি করতে পারে। সে ক্ষেত্রে জাপান তার নিরাপত্তা আইনের অধীনে ‘সমষ্টিগত আত্মরক্ষার অধিকার’ প্রয়োগ করতে পারে। তাকাইচির এই বক্তব্যের পরই চীন তীব্র প্রতিক্রিয়া জানায়।
তাইওয়ানে বিদেশি হস্তক্ষেপের বিরোধিতা: চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই বলেন, চীনের তাইওয়ান বিষয়ে কোনো বিদেশি হস্তক্ষেপ তাঁরা মেনে নেবেন না।
ইতিহাসের চাকা উল্টো ঘোরানোর চেষ্টা: তিনি আরও বলেন, ‘জাপানের ডানপন্থি শক্তিগুলোকে আমরা ইতিহাসের চাকা উল্টো ঘোরাতে দেব না এবং জাপানি সামরিকবাদকে আবার মাথাচাড়া দিতেও দেব না।’
জাপানের সামরিক নীতির উদ্বেগজনক পরিবর্তন
চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাও নিং জাপানের সাম্প্রতিক সামরিক উন্নয়ন সম্পর্কে তাঁর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। জাপানের এই পদক্ষেপগুলো এশীয় প্রতিবেশীদের জন্য উদ্বেগের কারণ।
সামরিক কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ: মাও নিং বলেন, উপনিবেশীকরণ ও আগ্রাসনের ইতিহাসের কারণে, জাপানের সামরিক ও নিরাপত্তাসংশ্লিষ্ট কার্যকলাপ সর্বদা তার এশীয় প্রতিবেশীরা ও আন্তর্জাতিক সমাজ ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করে আসছে।
শান্তি সংবিধানের লঙ্ঘন: জাপান পটসডাম ঘোষণাপত্রে অস্ত্র তৈরি থেকে স্পষ্টতই নিষিদ্ধ। এছাড়া জাপানের “শান্তি সংবিধান” কেবল “একচেটিয়াভাবে প্রতিরক্ষামূলক প্রতিরক্ষা” নীতি প্রতিষ্ঠা করেছে।
প্রতিরক্ষা বাজেট বৃদ্ধি: উদ্বেগজনক বিষয় হলো, জাপান সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তার নিরাপত্তা নীতি উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তন করেছে, প্রতিবছর প্রতিরক্ষা বাজেট বৃদ্ধি করে চলেছে এবং আক্রমণাত্মক অস্ত্র তৈরির চেষ্টা করছে। এমনকি তারা “তিনটি অ-পারমাণবিক অস্ত্র নীতি” পরিত্যাগ করার চেষ্টাও করছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিজয় ও আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলা
চীন মনে করে, জাপানের সামরিকবাদের পুনরুত্থানের চেষ্টা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিজয় থেকে প্রাপ্ত অর্জন এবং যুদ্ধোত্তর আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলাকে চ্যালেঞ্জ করছে।
ঐতিহাসিক বিপর্যয়: চীনা মুখপাত্র জোর দিয়ে বলেন, ৮০ বছর আগে, জাপানি সামরিকতন্ত্রের আগ্রাসন এশিয়া ও বিশ্বের জন্য গভীর বিপর্যয় ডেকে এনেছিল।
শৃঙ্খলা রক্ষার অঙ্গীকার: ওয়াং ই বলেন, বেইজিং ‘এক-চীন নীতি বিষয়ে আন্তর্জাতিক ঐক্যমত রক্ষায় সব পক্ষের সঙ্গে কাজ করবে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিজয় থেকে পাওয়া অর্জনগুলোকে একসঙ্গে সুরক্ষা দেবে।’
বিশ্বশান্তি বিঘ্নিত করার অপচেষ্টা: চীন স্পষ্ট করে জানিয়েছে, জাপানি সামরিকবাদের পুনরুত্থান একেবারেই সহ্য করা হবে না এবং বিশ্বের শান্তি ও স্থিতিশীলতাকে নষ্ট করার কোনো অপচেষ্টা সফল হতে দেওয়া হবে না।
জাপানের সামরিক পদে পরিবর্তন ও প্রতীকী অর্থ
জাপানের আত্মরক্ষা বাহিনীর পদমর্যাদা পুনর্বিবেচনা করার পরিকল্পনাও চীনের উদ্বেগের কারণ হয়েছে। এই ধরনের পরিবর্তনকে প্রতীকী অর্থে আগ্রাসনের ইঙ্গিত হিসেবে দেখা হচ্ছে।
পদমর্যাদা পুনরুদ্ধার: সম্প্রতি বেশ কয়েকজন জাপানি কর্মকর্তা বলেছেন, জাপান তার আত্মরক্ষা বাহিনীর পদমর্যাদা পুনর্বিবেচনা করার পরিকল্পনা করছে, যার উদ্দেশ্য “কর্নেল”-এর মতো টার্মগুলি পুনরুদ্ধার করা, যা পুরানো জাপানি সামরিক বাহিনীতে ব্যবহৃত হতো।
ঐতিহাসিক ক্ষতে লবণ: মিডিয়া ভাষ্যকাররা বলছেন, এটি জাপানি আত্মরক্ষা বাহিনীর সামরিক দিকটিকে অবমূল্যায়ন করার দীর্ঘস্থায়ী অনুশীলনকে ভেঙে দেবে এবং জাপানি ঔপনিবেশিক আগ্রাসনের শিকার দেশগুলোর জনগণের জন্য এটি ইতিহাসের ক্ষতগুলোতে লবণ ছিটিয়ে দেওয়ার মতো।
রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিক্রিয়া
জাপানের প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্যের পর চীন তাৎক্ষণিকভাবে শুধু রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া জানায়নি, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও পদক্ষেপ নিয়েছে।
পর্যটক ভ্রমণ বাতিল: তাইওয়ান প্রসঙ্গে তাকাইচির বক্তব্যের পর ইতিমধ্যেই কয়েক লাখ চীনা পর্যটক জাপানে ভ্রমণ বাতিল করেছেন।
সামুদ্রিক খাদ্য আমদানি স্থগিত: টোকিও জানিয়েছে, বেইজিং জাপানি সামুদ্রিক খাদ্য আমদানিও স্থগিত করেছে।
ত্রিপক্ষীয় বৈঠক স্থগিত: এছাড়া জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে সংস্কৃতিমন্ত্রীদের ত্রিপক্ষীয় বৈঠকও স্থগিত করেছে চীন। এই পদক্ষেপগুলো স্পষ্ট করে যে, চীন এই ইস্যুকে শুধুমাত্র কথার যুদ্ধ হিসেবে দেখছে না, বরং বাস্তবিক পদক্ষেপ নিতেও প্রস্তুত।
এশিয়া-প্যাসিফিকে স্থিতিশীলতার ঝুঁকি
চীনের পক্ষ থেকে জাপানের সামরিকবাদকে মাথাচাড়া দিতে না দেওয়ার কঠোর হুঁশিয়ারি ইঙ্গিত দেয় যে, এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা নতুন করে বৃদ্ধি পাচ্ছে। জাপানের সামরিক উন্নয়ন এবং তাইওয়ান নিয়ে তাদের কঠোর অবস্থান চীনের জন্য একটি বড় উদ্বেগের কারণ। দুই দেশের মধ্যে ঐতিহাসিক বিরোধ এবং সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রতিযোগিতা এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। জাপানকে অবশ্যই তার আগ্রাসনের ইতিহাস এবং “শান্তি সংবিধানের” প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। অন্যথায়, এই সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতি কেবল দুই দেশের সম্পর্কই নয়, বরং সমগ্র অঞ্চলের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলতে পারে। আন্তর্জাতিক সমাজের উচিত এই পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা এবং যুদ্ধোত্তর আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য চাপ সৃষ্টি করা।
এম আর এম – ২৩৪৮,Signalbd.com



