আফগান সীমান্তবর্তী খাইবার পাখতুনখোয়া অঞ্চলে পাকিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনী পরপর দুটি বড় অভিযান চালিয়েছে। সেনাবাহিনীর দাবি, তীব্র বন্দুকযুদ্ধের পর মোট ২৩ জন নিহত হয়েছে। সাম্প্রতিক আত্মঘাতী হামলার পর এ পদক্ষেপকে বড়সড় নিরাপত্তা তৎপরতা হিসেবে দেখা হচ্ছে।
আফগানিস্তান সীমান্তবর্তী খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশে পৃথক দুটি সামরিক অভিযানে অন্তত ২৩ জন সন্দেহভাজন হত্যা করার দাবি করেছে পাকিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনী। বুধবার রাত থেকে বৃহস্পতিবার সকালের মধ্যে সংঘটিত এসব অভিযানের ব্যাপারে সেনাবাহিনী বলেছে, তারা দেশের ভেতরে বেড়ে ওঠা সন্ত্রাসী কার্যক্রমের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ মাত্রার পদক্ষেপ নিচ্ছে। সাম্প্রতিক আত্মঘাতী হামলাকে কেন্দ্র করে যে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে, এই অভিযানকে তারই ধারাবাহিকতা বলে মনে করা হচ্ছে।
প্রথম অভিযানের বিবরণ
পাকিস্তানের সেনাবাহিনী জানায়, প্রথম অভিযানটি পরিচালিত হয় খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের কুররম জেলায়। এলাকাটি দীর্ঘদিন ধরে সীমান্তবর্তী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর আস্তানা হিসেবে পরিচিত। নিরাপত্তা বাহিনীর দাবি, বুধবার মধ্যরাতে একটি সন্দেহজনক ঘাঁটি চিহ্নিত করে সেখানে অভিযান চালানো হয়।
অভিযানের সময় সশস্ত্র গোষ্ঠীর সদস্যদের সঙ্গে তীব্র গুলি বিনিময় হয়। প্রায় এক ঘণ্টার বেশি সময় ধরে চলা এই বন্দুকযুদ্ধে কমপক্ষে ১২ জন নিহত হয়। সেনাবাহিনীর দাবি, নিহতরা পাকিস্তান তালেবানের বিভিন্ন শাখার সক্রিয় সদস্য এবং তারা সাম্প্রতিক সময়ে পাকিস্তানের ভেতরে একাধিক হামলার পরিকল্পনায় সম্পৃক্ত ছিল।
অভিযানের সময় কোনো সেনা সদস্য হতাহত হয়নি বলে জানানো হয়েছে। তবে এলাকায় অতিরিক্ত বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে এবং সন্দেহভাজনদের সন্ধানে তল্লাশি চলছে।
দ্বিতীয় অভিযানে আরও ১১ জন নিহত
সেনাবাহিনী জানায়, প্রথম অভিযানের কয়েক ঘণ্টা পর একই জেলার অন্য একটি গ্রামীণ এলাকায় দ্বিতীয় অভিযান চালানো হয়। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে পরিচালিত এই অভিযানে বাহিনী একটি ছোট পাহাড়ি ঘাঁটিকে লক্ষ্য করে।
এখানেও সশস্ত্র প্রতিরোধের মুখে পড়ে সেনারা। তীব্র গুলিবিনিময়ের পর নিরাপত্তা বাহিনী এলাকাটি নিয়ন্ত্রণে নেয়। সেনাবাহিনীর দাবি, দ্বিতীয় অভিযানে আরও ১১ জন জঙ্গি নিহত হয়েছে।
দুই অভিযানে মোট ২৩ জনের মৃত্যু পাকিস্তানের সীমান্ত নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে আবারও আলোচনায় নিয়ে এসেছে। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে আফগান সীমান্ত এলাকায় সহিংসতা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে, এবং এর সঙ্গে জঙ্গি তৎপরতার যোগসূত্র নিয়ে পাকিস্তানের নিরাপত্তা সংস্থাগুলো উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
সম্প্রতি ঘটে যাওয়া আত্মঘাতী হামলা ও উত্তপ্ত পরিস্থিতির প্রেক্ষাপট
গত ১১ নভেম্বর ইসলামাবাদের একটি আদালত চত্বরে আত্মঘাতী বোমা হামলায় অন্তত ১২ জন নিহত হয়। এই হামলার পর থেকেই পাকিস্তান সরকার ও সামরিক বাহিনী কঠোর অবস্থান গ্রহণ করে।
সরকারি বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ওই হামলার পরিকল্পনা সীমান্তের ওপার থেকে পরিচালিত হয়েছিল। পাকিস্তানের দাবি, পাকিস্তান তালেবানের একটি উপগোষ্ঠী হামলার দায় স্বীকার করেছে এবং তাদের বেশ কিছু সদস্য আফগানিস্তানের ভেতরে লুকিয়ে আছে।
এই প্রেক্ষাপটে সীমান্তবর্তী এলাকায় অভিযান জোরদার করে পাকিস্তান। দুই দেশের মধ্যে পূর্ব থেকেই বিদ্যমান উত্তেজনা এ ঘটনার পর আরও বেড়ে যায়। সীমান্তে উভয় দেশের বাহিনীর মধ্যে সাম্প্রতিক সংঘর্ষে ৭০ জনেরও বেশি নিহত হওয়ার খবর রয়েছে।
২৪ বছরের ইতিহাসে তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি) বহুবার দেশটির ভেতরে বড় হামলা পরিচালনা করেছে। ২০২১ সালে আফগানিস্তানে তালেবান ক্ষমতায় ফিরে আসার পর টিটিপির তৎপরতা নতুন মাত্রায় প্রবেশ করে বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।
পাকিস্তানের দাবি, আফগানিস্তানের ভেতরে থাকা টিটিপি সদস্যরা সীমান্ত পেরিয়ে পাকিস্তানের ভেতরে সক্রিয় হয়ে ওঠে। যদিও আফগান সরকার এমন অভিযোগ বারবার অস্বীকার করেছে।
সাম্প্রতিক সময়ে পাকিস্তান ভারতের দিকেও অভিযোগের আঙুল তুলেছে। তারা বলছে, ভারতের সহায়তায় কিছু সশস্ত্র গোষ্ঠী পাকিস্তানের ভেতরে হামলার পরিকল্পনা করছে। তবে ভারত ও আফগানিস্তান উভয় দেশই এসব দাবি নাকচ করেছে।
বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ ও নিরাপত্তা পরিস্থিতির সম্ভাব্য দিক
নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, খাইবার পাখতুনখোয়া অঞ্চলে জঙ্গিবাদ মোকাবেলায় পাকিস্তানের সামরিক অভিযানের দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব গুরুত্বপূর্ণ। সীমান্তের দুই পাশে তৎপর সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো বহু বছর ধরে এই এলাকায় প্রভাব বিস্তার করে আসছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, কেবল সামরিক অভিযান নয়, গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ, সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ এবং রাজনৈতিক সমাধানের দিকেও নজর দিতে হবে। অন্যথায় এই অঞ্চলে সহিংসতা পুনরায় মাথাচাড়া দিতে পারে।
যেখানে প্রতিদিন নতুন হামলার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে, সেখানে পাকিস্তানের জন্য সীমান্ত নিরাপত্তা এখন গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আফগান সীমান্তে পরপর দুটি সামরিক অভিযানে ২৩ জন নিহত হওয়ার ঘটনা পাকিস্তানের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে নতুন করে আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে এসেছে। সাম্প্রতিক আত্মঘাতী হামলার পর নেওয়া পদক্ষেপগুলোর মধ্যে এই অভিযানকে তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে। তবে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা কমবে নাকি আরও বাড়বে, তা নির্ভর করছে পরবর্তী পদক্ষেপ ও আঞ্চলিক পরিস্থিতির ওপর। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সামরিক অভিযান অব্যাহত থাকলেও স্থায়ী সমাধানের জন্য কূটনৈতিক উদ্যোগ জোরদার করা জরুরি।
এম আর এম – ২৩১৯,Signalbd.com



