বাংলাদেশ

বঙ্গোপসাগরে ট্রলারসহ ১৬ জেলে অপহরণ, বাড়ছে আরাকান আর্মি আতঙ্ক

Advertisement

বঙ্গোপসাগরের বাংলাদেশ অংশে মাছ ধরতে গেলে আবারো বন্দী হতে হলো ১৬ জন বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা জেলেকে। তিনটি মাছধরার ট্রলারসহ এই জেলেদের অপহরণ করেছে মিয়ানমারের সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি (AA)। অভিযোগ, জেলেরা নাকি মিয়ানমারের জলসীমায় প্রবেশ করেছিলেন—এমন দাবি তুলে তাদের আটক করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে মংডু উপকূলের দিকে।

এই ঘটনা বাংলাদেশের উপকূলজুড়ে নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। স্থানীয় জেলে–মালিকদের সংগঠনগুলোর দাবি, আরাকান আর্মির এই অপহরণ এখন নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে। শুধু ৯ মাসেই ৩৪০ জনের বেশি জেলেকে অপহরণ করা হয়েছে, নিখোঁজ রয়ে গেছে এখনো প্রায় দেড়শ’ মানুষ।

ঘটনার বিস্তারিত: রাত্রি অভিযান, তিনটি ট্রলার আটক

মঙ্গলবার রাতে ঘটনা নিশ্চিত করেন টেকনাফ পৌরসভার কায়ুকখালী বোট মালিক সমিতির সভাপতি সাজেদ আহমেদ। তিনি বলেন—

“সেন্টমার্টিনের দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরছিল একটি ট্রলার। সেখানে গিয়ে আরাকান আর্মির সশস্ত্র যোদ্ধারা ট্রলারে উঠে ৬ জন রোহিঙ্গা জেলেকে ধরে নিয়ে যায়।”

এই ট্রলারটি টেকনাফ পৌরসভার কলেজপাড়া এলাকার জাকির হোসেনের মালিকানাধীন।

এছাড়া আরও দুটি ট্রলার—যেগুলোও আরাকান আর্মির হেফাজতে রয়েছে—থেকে আরও ১০ জন জেলেকে আটক করা হয়েছে বলে নিশ্চিত করেন তিনি। তবে তাদের নাম-পরিচয় এখনো শনাক্ত হয়নি।

সাজেদ আহমেদের দাবি, গত কয়েক মাস ধরে আরাকান আর্মি যে হারে অপহরণ করছে, তাতে জেলেদের জীবিকা হুমকির মুখে পড়েছে।

৯ মাসে ৩৪৬ জেলে অপহরণ — বাংলাদেশ সীমান্তে বাড়ছে অস্থিরতা

টেকনাফ-সেন্টমার্টিন উপকূলের জেলে সমাজের তথ্য অনুযায়ী:

  • গত ৯ মাসে অন্তত ৩৪৬ জন জেলে অপহৃত হয়েছেন
  • বিজিবির প্রচেষ্টায় ২০০ জনকে উদ্ধার করা হলেও,
  • ১৪৬ জন জেলে এখনো নিখোঁজ, অনেকে বছর ধরে ফিরে আসেননি

এই পরিসংখ্যানে বোঝা যায়, আরাকান আর্মি এখন শুধুমাত্র বিদ্রোহী সংগঠন নয়, বরং সীমান্তে এক ধরনের সশস্ত্র প্রভাবশালী শক্তি হয়ে উঠেছে।

বাংলাদেশি জেলেরা অভিযোগ করছেন—আরাকান আর্মি জেলেদের আটক করার পর মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ দাবি করে। অনেকে অর্থের অভাবে বন্দীই থেকে যান।

মিয়ানমারের গণমাধ্যম যা জানাচ্ছে

মিয়ানমারভিত্তিক গণমাধ্যম গ্লোবাল আরাকান নেটওয়ার্ক দাবি করেছে—

  • বৃহস্পতিবার সকাল ৭টার দিকে
  • মংডু টাউনশিপের থাওয়াইং চাউং গ্রামের পশ্চিম উপকূল থেকে ২.৭ কিলোমিটার দূরে
  • একটি ট্রলার আটক করে ৬ জন বাংলাদেশি জেলেকে ধরে
  • তাদের কাছ থেকে মাছ, জাল ও বাংলাদেশি মুদ্রা জব্দ করা হয়েছে

এছাড়া একইদিন রাথেডং টাউনশিপের উপকূল থেকে আরও ১০ জন জেলেসহ দুটি ট্রলার আটক করা হয়।

তাদের ভাষ্য অনুযায়ী—সবমিলিয়ে তিনটি ট্রলার আরাকান আর্মির হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে মিয়ানমার নিরাপত্তা বাহিনীর কাছে।

এখন মিয়ানমারের স্থানীয় আইন অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলেও দাবি করেছে গণমাধ্যমটি।

সরকারি প্রতিক্রিয়া: তদন্ত চলছে, সতর্ক আইনশৃঙ্খলা বাহিনী

এ বিষয়ে টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শেখ এহসান উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন—

“ট্রলার ও জেলে অপহরণের বিষয়টি আমরা জেনেছি। ঘটনা তদন্ত করা হচ্ছে এবং সীমান্তে নিয়োজিত সংশ্লিষ্ট বাহিনীকে বিষয়টি খতিয়ে দেখতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।”

বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বিজিবি, কোস্টগার্ড ও নৌবাহিনী নিয়মিত টহল বাড়ালেও—বঙ্গোপসাগরের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোর জটিল ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে সংক্ষিপ্ত সময়ে প্রতিক্রিয়া জানানো কঠিন হয়ে পড়ে।

১২ নভেম্বরের একই ধরনের ঘটনা – অপহরণের পর অপহরণ

মাত্র কয়েক দিন আগে, ১২ নভেম্বর, একইভাবে:

  • ২টি মাছধরার ট্রলার
  • ১৩ জন রোহিঙ্গা জেলে

অপহরণ করে নিয়ে যায় আরাকান আর্মি।

জেলে-মালিকদের অভিযোগ, আরাকান আর্মি এখন প্রায় প্রতিদিনই বাংলাদেশের জলসীমার কাছাকাছি অবস্থান করছে। তাদের ট্রলারে মেশিনগান–সজ্জিত সশস্ত্র যোদ্ধারা থাকে, যা দেখে জেলেরা আতঙ্কে পড়ে।

আরাকান আর্মি কেন এভাবে জেলেদের টার্গেট করছে? — বিশ্লেষণ

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আরাকান আর্মি মূলত—

১. অর্থ সংগ্রহ

তাদের যুদ্ধ পরিচালনার অর্থ আসে অপহরণ, চাঁদাবাজি ও অবৈধ বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ থেকে।

২. সীমান্ত নিয়ন্ত্রণে আধিপত্য দেখানো

রাখাইন রাজ্যে চলমান সংঘাতে নিজেদের শক্তি প্রদর্শন করতে সীমান্ত এলাকায় প্রভাব বাড়াচ্ছে।

৩. উন্নত নৌ-সামরিক ক্ষমতা অর্জন

বাংলাদেশি ট্রলারগুলো দখল করে তারা নিজেদের নৌ-শক্তিকে আরও শক্তিশালী করছে।

১৭টি আন্তর্জাতিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০২৩ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে আরাকান আর্মি নৌবাহিনীর মতো সংগঠিত হয়ে উঠেছে।

জেলেদের ভয়—’গেলে ফিরবো কিনা জানি না’

টেকনাফের শামলাপুর এলাকা, সাবরাং ইউনিয়ন, শাহপরীর দ্বীপ—এসব এলাকার জেলেরা বলছেন, প্রতিদিনই তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাগরে যাচ্ছেন।

জেলে ইদ্রিস জানালেন—

“মাছ ধরি না গেলে পরিবার না খেয়ে থাকবে। কিন্তু সাগরে গেলে আরাকান আর্মি ধরে নিয়ে যায়। ফিরে আসতে পারবো কি না জানি না।”

অনেক পরিবার তাদের স্বজনকে হারিয়ে এখনো কান্নায় ভেঙে পড়েন—কারণ নিখোঁজদের অর্ধেকই বহুদিন ধরে কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি।

বাংলাদেশ সরকারের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা

বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গত কিছু মাসে কয়েকবার:

  • মিয়ানমারের দূতাবাসকে ডেকে প্রতিবাদ জানিয়েছে
  • নৌ ও স্থল সীমান্তে নিরাপত্তা বাড়ানোর অনুরোধ করেছে
  • জেলেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছে

তবে মিয়ানমারের অন্তর্দ্বন্দ্বপূর্ণ পরিস্থিতির কারণে তেমন সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না।

বিশেষজ্ঞ মতামত: সমাধান কী হতে পারে?

১. যৌথ সমুদ্র টহল বাড়ানো

বাংলাদেশ–মিয়ানমার যৌথ টহল পুনরায় চালু করা দরকার।

২. স্যাটেলাইট নজরদারি ও রাডার সিস্টেম

মাছ ধরার নৌকার গতিপথ ট্র্যাকিং করলে অপহরণ কমবে।

৩. জেলে এলাকাগুলোতে সচেতনতা বাড়ানো

কোন এলাকা ঝুঁকিপূর্ণ তা আগেই জানাতে হবে।

৪. আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ানো

আরাকান আর্মির কার্যক্রমকে মানবাধিকার লঙ্ঘন হিসেবে আন্তর্জাতিক মঞ্চে তুলে ধরা জরুরি।

মানবিক সংকট: দেড়শ’র বেশি মানুষ নিখোঁজ

বিভিন্ন সূত্র বলছে—

  • এখন পর্যন্ত ১৫০–১৬০ জনের মতো জেলে ও রোহিঙ্গা নাগরিক মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠীর হাতে দীর্ঘদিন ধরে আটক রয়েছে
  • তাদের অবস্থাও স্পষ্ট নয়
  • অনেকেই হয়তো দূরবর্তী পাহাড়ি ঘাঁটিতে আটক আছেন

এ পরিস্থিতিকে বাংলাদেশের দক্ষিণ উপকূলের ‘নতুন মানবিক সংকট’ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।

সেন্টমার্টিন–টেকনাফ উপকূল আবারো অস্থির—জরুরি পদক্ষেপ প্রয়োজন

বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক মৎস্য সম্পদ অত্যন্ত সমৃদ্ধ। এ কারণে হাজার হাজার পরিবার মাছ ধরার ওপরই নির্ভরশীল। কিন্তু—

  • আরাকান আর্মির অপহরণ
  • মিয়ানমারে অভ্যন্তরীণ সংঘাত
  • সীমান্তে অস্ত্রবিরতি ভঙ্গ
  • সমুদ্র নিরাপত্তার অভাব

এসব কারণে দক্ষিণ উপকূলের জেলে সম্প্রদায় এখন সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে।

বাংলাদেশ সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে। তবে স্থানীয় জেলেদের দাবি—

“তারা যতক্ষণ পর্যন্ত নিরাপদে মাছ ধরতে পারবে না, ততক্ষণ এই সংকট কাটবে না।”

আবারো ট্রলারসহ ১৬ জন জেলে অপহরণের ঘটনা দেখিয়ে দিল—বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের জলসীমা এখন বহুমাত্রিক নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে।
আরাকান আর্মি সীমান্তে যে বাড়তি প্রভাব বিস্তার করছে, তার প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশের অর্থনীতি, জেলেদের জীবিকা, এমনকি আন্তর্জাতিক সম্পর্কেও।

নিখোঁজদের পরিবার এখনো অপেক্ষায়—তাদের প্রিয় মানুষেরা কোনোদিন ঘরে ফিরবে কি না।

MAH – 13885 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button