মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিয়ে সৌদি আরবকে ন্যাটোর বাইরে যুক্তরাষ্ট্রের ‘প্রধান মিত্র’ হিসেবে ঘোষণা করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ওয়াশিংটনে সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের (এমবিএস) সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে এই ঘোষণা আসে, যার মাধ্যমে দুই দেশের সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় পৌঁছাল বলে বিশ্লেষকদের মত।
টিআরটি ওয়ার্ল্ডসহ আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের বরাতে জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্র–সৌদি নতুন কৌশলগত প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষরের পরই এই ঘোষণা দেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। হোয়াইট হাউসে আয়োজিত এক ডিনার বৈঠকের সময় তিনি বলেন—
“আমরা সামরিক সহযোগিতাকে আরও উচ্চ পর্যায়ে উন্নীত করছি। সৌদি আরবকে আনুষ্ঠানিকভাবে ন্যাটোর বাইরে আমাদের প্রধান মিত্র হিসেবে ঘোষণা করা হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতার জন্য এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”
সৌদি সংবাদমাধ্যমগুলো এই ঘোষণাকে দুই দেশের দীর্ঘমেয়াদি প্রতিরক্ষা সম্পর্ককে শক্তিশালী করার ঐতিহাসিক পদক্ষেপ হিসেবে উল্লেখ করেছে।
‘প্রধান নন-ন্যাটো মিত্র’—এর অর্থ কী? কেন এটি এত গুরুত্বপূর্ণ?
যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বে মোট কয়েকটি দেশকে বিশেষ সম্মানসূচক মর্যাদায় Major Non-NATO Ally (MNNA) ঘোষণা করেছে।
এই তালিকায় রয়েছে—জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ইসরায়েল, কুয়েত, কাতার, অস্ট্রেলিয়া, আর্জেন্টিনা, পাকিস্তান, বাহরাইনসহ মোট একাধিক কৌশলগত দেশ।
এই মর্যাদা পাওয়া দেশের সুবিধা—
- উন্নত মার্কিন অস্ত্র পেতে অগ্রাধিকার
- প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি হস্তান্তর সহজ হয়
- যৌথ সামরিক মহড়ায় বিশেষ সুবিধা
- গোয়েন্দা তথ্য বিনিময় বাড়ানো
- বৈশ্বিক নিরাপত্তা ইস্যুতে প্রভাব বিস্তারের সুযোগ
সৌদির ক্ষেত্রে এটি আরও গুরুত্বপূর্ণ, কারণ মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, ইরান–ইসরায়েল উত্তেজনা এবং লোহিত সাগর ও উপসাগরীয় অঞ্চলের নিরাপত্তার জন্য সৌদি যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান কৌশলগত সহযোগী।
ট্রাম্প–এমবিএস বৈঠক: স্বাক্ষর হলো বহু-মূল্যের প্রতিরক্ষা ও পারমাণবিক চুক্তি
হোয়াইট হাউসের বিবৃতিতে বলা হয়, সৌদি ক্রাউন প্রিন্সের এই উচ্চপর্যায় সফরে দুই দেশ—
- বেসামরিক পারমাণবিক শক্তি
- সাইবার নিরাপত্তা
- আধুনিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা
- বাণিজ্য ও প্রযুক্তি সহযোগিতা
এতসব ক্ষেত্রেই একাধিক চুক্তি স্বাক্ষর করেছে।
বেসামরিক পারমাণবিক শক্তিতে ‘যৌথ ঘোষণা’
ওয়াশিংটনের মতে, এই যৌথ ঘোষণা আগামী কয়েক দশকে বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ ও সহযোগিতার ভিত্তি তৈরি করবে। সৌদি আরব দীর্ঘদিন ধরেই শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক শক্তি ব্যবহারের দিকে আগ্রহী, বিশেষ করে—
- বিদ্যুৎ উৎপাদন
- বিশুদ্ধ পানি উৎপাদন (ডেস্যালিনেশন)
- শিল্পায়ন
এই চুক্তির ফলে সৌদি এখন ওয়াশিংটনের প্রযুক্তি ও জ্বালানি সহযোগিতা পেতে যাচ্ছে।
এফ–৩৫ যুদ্ধবিমান পাচ্ছে সৌদি—ট্রাম্পের সবুজ সংকেত
মধ্যপ্রাচ্যের শক্তির ভারসাম্যে আরেকটি বড় পরিবর্তন আনতে পারে এফ–৩৫ যুদ্ধবিমানের নতুন বিক্রয় চুক্তি, যার অনুমোদনও দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প।
এই স্টেলথ জেটের মালিকানা বর্তমানে—
- যুক্তরাষ্ট্র
- ইসরায়েল
- জাপান
- দক্ষিণ কোরিয়া
- অস্ট্রেলিয়া
এদের মতো মিত্র দেশগুলোর হাতে রয়েছে।
সৌদি আরব এই বিমানের জন্য বহু বছর ধরে আবেদন করে আসছিল। ইসরায়েলি উদ্বেগ, মানবাধিকার বিতর্ক ও মধ্যপ্রাচ্যের ভারসাম্য রক্ষার কারণে পূর্ববর্তী প্রশাসন চুক্তিটি অনুমোদন করেনি। কিন্তু এবার ট্রাম্প সরাসরি সবুজ সংকেত দিলেন, যা সৌদি বিমানবাহিনীর সক্ষমতায় বড় পরিবর্তন আনবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
কেন সৌদি এখন যুক্তরাষ্ট্রের ‘প্রধান মিত্র’ মর্যাদা পেল?
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের পর্যবেক্ষণ—
১. চীনের প্রভাবকে ভারসাম্য করতে
সৌদি আরব সাম্প্রতিক বছরগুলোতে—
- চীনের সঙ্গে তেল বাণিজ্য
- হুয়াওয়ের ৫জি নেটওয়ার্ক
- ব্রিকস+ জোট
- সামরিক ড্রোন সহযোগিতা
এসব ক্ষেত্রে চীনের দিকে ঝুঁকছিল।
যুক্তরাষ্ট্র চাইছে এই প্রভাব কমাতে নতুন কৌশলগত সম্পর্ক জোরদার করতে।
২. ইরান–সৌদি সম্পর্কের নতুন বাস্তবতায় যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতি
ইরান–সৌদি সম্পর্ক চীনের মধ্যস্থতায় কিছুটা স্বাভাবিক হলেও যুক্তরাষ্ট্র মনে করছে, আঞ্চলিক নিরাপত্তা রক্ষায় সৌদি এখন আরও গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত সহযোগী।
৩. ইসরায়েল–আরব স্বাভাবিকীকরণ প্রক্রিয়া
গোপনে হলেও সৌদি–ইসরায়েল আলোচনার অগ্রগতি যুক্তরাষ্ট্রের বড় কূটনৈতিক লক্ষ্যগুলোর একটি। এই সম্পর্ক জোরদারে সৌদিকে পাশে পেতে চায় ওয়াশিংটন।
৪. তেল-বাজারে সৌদির প্রভাব
বিশ্বের সবচেয়ে বড় তেলরপ্তানিকারক দেশ হিসেবে সৌদির অর্থনৈতিক প্রভাব যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত পরিকল্পনায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে নতুন সমীকরণ তৈরি করবে এই ঘোষণা
ট্রাম্পের ঘোষণার পর মধ্যপ্রাচ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য নতুন দিকে মোড় নিতে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের মত।
ইরানের উদ্বেগ বেড়ে যেতে পারে
সৌদি যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে উন্নত প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি পেলে ইরান মনে করতে পারে, এটি তার বিরুদ্ধে একটি যৌথ নিরাপত্তা জোটের ইঙ্গিত।
ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া
ইসরায়েল সবসময় চায়, মধ্যপ্রাচ্যে তাদেরই সামরিক শক্তি সর্বোচ্চ থাকুক। তাই এফ–৩৫ বিক্রয় নিয়ে সেখানে কিছু উদ্বেগ থাকলেও যুক্তরাষ্ট্র আশ্বস্ত করেছে যে ইসরায়েলের নিরাপত্তা ব্যাহত হবে না।
চীন ও রাশিয়ার পর্যবেক্ষণ
চীন সৌদির সঙ্গে বহু বড় চুক্তির অংশীদার। যুক্তরাষ্ট্রের নতুন জোট ঘোষণা বেইজিংকে কৌশলগতভাবে সতর্ক করতে পারে।
রাশিয়া, বিশেষত সিরিয়া যুদ্ধের পর, মধ্যপ্রাচ্যে তার প্রভাব বাড়ানোর চেষ্টা করছে। সেক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র–সৌদি এই নতুন ঘনিষ্ঠতা মস্কোর জন্যও গুরুত্বপূর্ণ সিগন্যাল।
সৌদির অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও ভিশন ২০৩০: কেন এই চুক্তি গুরুত্বপূর্ণ?
ক্রাউন প্রিন্স এমবিএস দেশের অর্থনৈতিক রূপান্তরের যে স্বপ্ন ভিশন ২০৩০ বাস্তবায়ন করছেন, সেখানে—
- আধুনিক প্রযুক্তি
- নিরাপত্তা স্থিতিশীলতা
- বিদেশি বিনিয়োগ
- পারমাণবিক শক্তি
- প্রতিরক্ষা আধুনিকীকরণ
এসবই গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি প্রতিরক্ষা ও জ্বালানি সহযোগিতা সেই ভিশন বাস্তবায়নকে আরও শক্তিশালী করবে।
বিশ্বজুড়ে প্রতিক্রিয়া: বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের মন্তব্য—
- এটি মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ফিরে আসার ঘোষণা।
- চীনের বাড়তি প্রভাব ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র কৌশল বদলেছে।
- সৌদি এককভাবে বিশ্ব জ্বালানি বাজারে শক্ত অবস্থান নিতে চাইছে।
- এফ–৩৫ বিক্রয়ের অনুমোদন অঞ্চলটিতে শক্তির নতুন ভারসাম্য তৈরি করবে।
যুক্তরাষ্ট্র–সৌদি সম্পর্কের অতীত: ওঠানামার এক দীর্ঘ ইতিহাস
দুই দেশের সম্পর্ক নতুন নয়। ১৯৪৫ সালে ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট ও কিং আবদুল আজিজের ঐতিহাসিক বৈঠকের পর থেকে—
- তেল
- নিরাপত্তা
- বাণিজ্য
- আঞ্চলিক রাজনীতি
এসব ক্ষেত্রে দুই দেশ একে অপরের নির্ভরযোগ্য অংশীদার।
তবে মানবাধিকার, সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যাকাণ্ড, ইয়েমেন যুদ্ধ ইত্যাদি ইস্যুতে আগে কিছুটা টানাপোড়েন থাকলেও কৌশলগত বাস্তবতায় সম্পর্ক আবারও উষ্ণ হয়েছে।
পাশাপাশি যে প্রশ্নগুলো এখন সবচেয়ে আলোচনায়
- যুক্তরাষ্ট্র কি মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক উপস্থিতি আরও বাড়াবে?
- সৌদির হাতে এফ–৩৫ আসলে ইরান কী প্রতিক্রিয়া দেখাবে?
- চীন–সৌদি সম্পর্ক কি যুক্তরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্তে প্রভাবিত হবে?
- ন্যাটোর বাইরের মিত্র মর্যাদা পেয়ে সৌদি আরব কি নতুন নিরাপত্তা জোটের নেতৃত্বে আসছে?
যুক্তরাষ্ট্র–সৌদি সম্পর্কের নতুন যুগের সূচনা
ট্রাম্প প্রশাসনের নতুন ঘোষণা বিশ্বের ভূ-রাজনীতিতে বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
সৌদিকে ন্যাটোর বাইরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মিত্র ঘোষণা,
পারমাণবিক শক্তিতে সহযোগিতা,
এফ–৩৫ বিক্রয়ের অনুমোদন,
এগুলোর মাধ্যমে দুই দেশের কৌশলগত সম্পর্ক আরও দৃঢ় হচ্ছে।
মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতা, ইরানকে ঘিরে উত্তেজনা, বিশ্ব জ্বালানি বাজার, এবং যুক্তরাষ্ট্র–চীন প্রতিদ্বন্দ্বিতা—সব কিছুর ওপরই এই সিদ্ধান্ত প্রভাব ফেলবে।
সব মিলিয়ে বলা যায়—
২০২৫ সালের এই ঘোষণা মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক ভূচিত্রে নতুন যুগের সূচনা করেছে।
MAH – 13871 I Signalbd.com



