যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যের বিগ সুর এলাকার গারাপাতা স্টেট বিচে এক হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটেছে। মাত্র পাঁচ বছর বয়সী কন্যাসন্তানকে বিশাল ঢেউয়ের কবল থেকে বাঁচাতে গিয়ে মর্মান্তিক পরিণতি বরণ করেছেন তার ৩৯ বছর বয়সী বাবা ইউজি হু। সমুদ্রে ঢেউয়ের আঘাতে মেয়েকে ভেসে যেতে দেখে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েন, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তিনি মেয়েকে রক্ষা করতে পারেননি এবং নিজেও ঢেউয়ের তোড়ে ভেসে যান। পরে তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা মৃত ঘোষণা করেন। এই করুণ ঘটনাটি সন্তানের প্রতি বাবার নিঃস্বার্থ ভালোবাসার এক মর্মস্পর্শী দৃষ্টান্ত হিসেবে সামনে এসেছে। তবে এখনও পর্যন্ত নিখোঁজ শিশুটির কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।
বিস্তারিত বিবরণ: যেভাবে ঘটেছিল দুর্ঘটনা
স্থানীয় সংবাদমাধ্যম এবং মন্টেরে কাউন্টি শেরিফ কমান্ডার আন্দ্রেস রোসাসের বরাতে জানা যায়, ঘটনাটি ঘটেছিল মন্টেরে কাউন্টির হাইওয়ে ১–এর পাশের গারাপাতা স্টেট বিচে। দুর্ঘটনার সময় সমুদ্রের ঢেউয়ের উচ্চতা ছিল অত্যন্ত বেশি, যা আনুমানিক ১৫ থেকে ২০ ফুট পর্যন্ত ছিল বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান। হঠাৎই একটি অস্বাভাবিক বড় ঢেউ সৈকতে আছড়ে পড়ে এবং পাঁচ বছর বয়সী শিশুটিকে টেনে প্রশান্ত মহাসাগরের গভীরে নিয়ে যায়।
কানাডীয় নাগরিক ইউজি হু তার কন্যাসন্তানকে এভাবে বিপদে পড়তে দেখে মুহূর্তের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়েন। মেয়েকে বাঁচানোর এই মরিয়া প্রচেষ্টার সময় তিনিও স্রোতের কবলে পড়েন। কমান্ডার রোসাস নিশ্চিত করেন, প্রাথমিক পর্যায়ে বাবা তার মেয়েকে ধরেও ফেলেছিলেন, কিন্তু বিশাল ঢেউয়ের তীব্রতায় তারা দুজনই ভাটার দিকে সাগরের গভীরে ভেসে যেতে থাকেন।
মায়ের চেষ্টা ও অলৌকিক প্রত্যাবর্তন
বাবা ও মেয়েকে সমুদ্রে ভাসতে দেখে শিশুটির মাও তাদের সাহায্য করতে দ্রুত পানিতে নামেন। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই স্রোতের তীব্রতা বুঝে তিনি কোনোমতে উপকূলে ফিরে আসতে সক্ষম হন। এই দম্পতির দুই বছর বয়সী আরও একটি সন্তান সৈকতে ছিল এবং সে অক্ষত রয়েছে। মা তীরে ফিরে আসতে পারলেও স্বামী ইউজি হু এবং তার কন্যা সমুদ্রের গভীরে ভেসে যান। শিশুটির মা হাইপোথার্মিয়াজনিত সামান্য আঘাতের চিকিৎসা নিয়েছিলেন।
মনস্তাত্ত্বিকরা বলছেন, মুহূর্তের মধ্যে এমন বিপর্যয়কর পরিস্থিতিতে মা নিজের জীবন বাঁচানোর জন্য যে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছিলেন, তা তাঁর জীবনে চরম মানসিক আঘাত দেবে। অন্যদিকে, নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মেয়েকে বাঁচাতে বাবার ঝাঁপিয়ে পড়া পিতৃত্বের এক অনন্য উদাহরণ।
উদ্ধার অভিযান এবং ইউজি হু-এর মৃত্যু
দুর্ঘটনার সময় ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট পার্কের একজন অফ-ডিউটি লাইফগার্ড এবং একজন পথচারী সৈকতে উপস্থিত ছিলেন। তারা দ্রুত ব্যবস্থা নিয়ে ইউজি হু-কে পানির বাইরে টেনে আনেন এবং তাকে কার্ডিওপালমোনারি রিসাসিটেশন (সিপিআর) দেওয়া হয়। এরপর মা ও বাবাকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। হাসপাতালে পৌঁছানোর পর চিকিৎসকরা ইউজি হু-কে মৃত ঘোষণা করেন। শিশুটির মা প্রাথমিক চিকিৎসার পর ছেড়ে দেওয়া হলেও তিনি শোকে গভীরভাবে ভেঙে পড়েছেন।
পুলিশ জানিয়েছে, পরিবারটি এই মর্মান্তিক ঘটনায় সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে এবং বাবার মৃত্যুর বিষয়ে কোনো মন্তব্য না করে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা বজায় রাখার অনুরোধ জানিয়েছে।
নিখোঁজ শিশুটির সন্ধানে তল্লাশি অভিযান
ইউজি হু-কে উদ্ধার করা গেলেও পাঁচ বছর বয়সী শিশুটির কোনো সন্ধান এখনও পাওয়া যায়নি। ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট পার্ক কর্তৃপক্ষ অবিলম্বে উপকূল বরাবর বিস্তৃত তল্লাশি অভিযান শুরু করেছে। পুলিশ জানিয়েছে, নিখোঁজ শিশুটিকে খুঁজে বের করার প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে এবং আগামী দিনগুলোতে স্টেট পার্কস কর্মকর্তারা তটরেখায় এবং সমুদ্র বরাবর টহল চালিয়ে যাবেন। তল্লাশি অভিযানে লাইফগার্ড, উপকূলরক্ষী এবং স্থানীয় উদ্ধারকারী দলও সহায়তা করছে। সময়ের সাথে সাথে শিশুটিকে খুঁজে পাওয়ার আশা ক্ষীণ হয়ে এলেও উদ্ধারকারীরা হাল ছাড়ছেন না।
কর্তৃপক্ষের সতর্কতা ও নিরাপত্তা বিধি
এই মর্মান্তিক ঘটনার পর কর্তৃপক্ষ উপকূলীয় এলাকায় ভ্রমণের সময় জনসাধারণের জন্য কঠোর সতর্কবার্তা জারি করেছে। মন্টেরে কাউন্টি শেরিফ কমান্ডার আন্দ্রেস রোসাস জোর দিয়ে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, সমুদ্র উপকূলীয় এলাকায় ভ্রমণের সময় সর্বদা অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে। বিশেষ করে, যখন বড় ঢেউ বা বিপজ্জনক স্রোতের পরিস্থিতি থাকে, তখন কখনোই সাগরের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকা যাবে না। শিশুদের ক্ষেত্রে বাবা-মায়েদের আরও বেশি সতর্ক থাকার আহ্বান জানানো হয়েছে। সমুদ্রের ধারে খেলার সময় বা সাঁতার কাটার সময় নিরাপত্তা বিধি মেনে চলা অত্যাবশ্যক। এই ধরনের ঘটনা এড়াতে আগাম সতর্কতা এবং নিরাপত্তা জ্ঞান খুব জরুরি।
পিতার আত্মত্যাগ
মনস্তত্ত্ববিদ ড. সায়মা আলম বলেন, “নিজের সন্তানকে বিপদে দেখে একজন বাবার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ছিল স্বতঃস্ফূর্ত এবং চরম আত্মত্যাগের। এটি মস্তিষ্কের সেই আদিম প্রবৃত্তির ফল, যেখানে নিজের জীবন বিপন্ন করেও সন্তানকে রক্ষার চেষ্টা করা হয়। যদিও পরিণতি মর্মান্তিক, কিন্তু এটি পিতৃত্বের চিরন্তন এবং নিঃশর্ত ভালোবাসার প্রতীক। এই ঘটনা সমাজে গভীর প্রভাব ফেলবে এবং নিরাপত্তা বিষয়ে আরও সচেতন হওয়ার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরবে।”
ক্যালিফোর্নিয়ার গারাপাতা স্টেট বিচে পাঁচ বছরের মেয়েকে বাঁচাতে গিয়ে বাবার মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনাটি সত্যিই হৃদয়বিদারক। এই আত্মত্যাগ চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। একদিকে বাবার করুণ মৃত্যু, অন্যদিকে নিখোঁজ শিশুটিকে খুঁজে বের করার জন্য চলছে ব্যাপক তল্লাশি। এই ঘটনা উপকূলীয় এলাকায় নিরাপত্তা এবং সতর্কতা বজায় রাখার গুরুত্ব আবারও প্রমাণ করল। পরিবারের সদস্যদের জন্য এই শোক সামলানো এক বিশাল চ্যালেঞ্জ।
এম আর এম – ২২৯৫,Signalbd.com



