বিশ্ব

ইউক্রেনকে ১০০ রাফাল এফ-৪ যুদ্ধবিমান দিচ্ছে ফ্রান্স

Advertisement

ইউক্রেন–রাশিয়া যুদ্ধের প্রায় চার বছর পূর্ণ হতে চলেছে। রাশিয়ার ব্যাপক ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলার ফলে ইউক্রেনের বিদ্যুৎ, রেলপথ, তেল স্থাপনাসহ গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোগুলো বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যুদ্ধের আগুনে পুরো দেশ ক্লান্ত, কিন্তু লড়াই থামেনি। এমন অবস্থায় ইউক্রেনের সামরিক সক্ষমতা পুনর্গঠনের সবচেয়ে বড় উদ্যোগ হিসেবে ফ্রান্স থেকে ১০০টি অত্যাধুনিক রাফাল এফ-৪ যুদ্ধবিমান পাওয়ার ঘোষণা বিশ্বব্যাপী আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে।

ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ এবং ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি প্যারিসের নিকটবর্তী একটি বিমান ঘাঁটিতে এই ঐতিহাসিক সমঝোতা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। জেলেনস্কি এই পদক্ষেপকে ইউক্রেনের সামরিক ইতিহাসে এক “নতুন যুগের সূচনা” বলে উল্লেখ করেছেন।

ফরাসি সংবাদমাধ্যম, বিবিসি, রয়টার্স, ডয়চে ভেলে ও আল–জাজিরার আন্তর্জাতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, এটাই ইউক্রেনের জন্য কোনো পশ্চিমা রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় সামরিক বিমান চুক্তি।

রাশিয়ার আক্রমণ ঠেকাতে রাফাল কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?

রাফাল যুদ্ধবিমানকে বিশ্বের অন্যতম দক্ষ মাল্টিরোল ফাইটার জেট ধরা হয়। ফ্রান্সের কোম্পানি দাসো অ্যাভিয়েশন তৈরি এই যুদ্ধবিমানটি বিশ্বের আধুনিকতম ফাইটার জেটগুলোর মধ্যে শীর্ষ সারিতে।

রাফাল এফ-৪ সংস্করণের প্রধান বৈশিষ্ট্য

  • দূরপাল্লার মিসাইল ছোড়ার ক্ষমতা
  • স্টেলথ বৈশিষ্ট্য—রাডারে ধরা পড়া কঠিন
  • অত্যাধুনিক রাডার ও ট্র্যাকিং সিস্টেম
  • ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার সিস্টেম ‘স্পেক্ট্রা’
  • একসাথে আকাশ–স্থল উভয় লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার সক্ষমতা

রাশিয়া এখন প্রতি মাসে প্রায় ৬,০০০ গ্লাইড বোমা ব্যবহার করছে—যা ইউক্রেনের শহর, সামরিক ঘাঁটি ও গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোর ওপর ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতি ডেকে আনছে। ইউক্রেনের সামরিক বিশ্লেষক সের্হি কুজান বলেন—

“রাফালের মতো ২০০ কিলোমিটার পাল্লার আকাশ–থেকে–আকাশে আঘাত হানতে সক্ষম প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ইউক্রেনের বেঁচে থাকার জন্য অত্যন্ত জরুরি।”

বর্তমানে ইউক্রেনের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা রাশিয়ার সু-৩৫ ও সু-৩৪ বিমানের মোকাবিলায় পুরোপুরি যথেষ্ট নয়। ফলে সীমান্তবর্তী এলাকাগুলো রাশিয়ার বিমান হামলার সহজ লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠেছে।

কখন ডেলিভারি শুরু—কবে সব ১০০টি বিমান হাতে পাবে ইউক্রেন?

ফরাসি প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ জানিয়েছেন—

  • ২০২৫ সালের মধ্যেই প্রশিক্ষণ ও প্রস্তুতি শুরু হবে।
  • ২০২৭ সাল থেকে রাফাল সরবরাহের প্রথম ধাপ শুরু হবে।
  • ২০৩৫ সালের মধ্যে ১০০টি এফ-৪ সংস্করণের বিমান সরবরাহ সম্পন্ন হবে।

একই সঙ্গে ড্রোন প্রতিহত করার লক্ষ্যে ইউক্রেন–ফ্রান্স যৌথভাবে ইন্টারসেপ্টর ড্রোন উৎপাদন শুরু করছে।

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি বলেন—

“এই চুক্তি মাত্র এক দিনের জন্য নয়। এটি আগামী ১০ বছরের পরিকল্পনা। রাশিয়ার আগ্রাসন ঠেকাতে আমাদের দীর্ঘমেয়াদী নিরাপত্তা দরকার, আর রাফাল বিমানগুলো সেই শক্তি দেবে।”

চুক্তির অর্থ জোগাবে কে? ইইউ–এর বড় দ্বন্দ্ব

চুক্তির সবচেয়ে জটিল অংশ হলো এর অর্থায়ন। ফ্রান্সের পক্ষ থেকে প্রাথমিকভাবে বলা হয়েছে—

  • ইউরোপীয় ইউনিয়নের যৌথ ঋণ তহবিল থেকে অর্থায়ন হতে পারে।
  • একই সঙ্গে ইউরোপে জব্দ করা রাশিয়ার ১৪০ বিলিয়ন ইউরো সম্পদ ব্যবহারের কথাও বিবেচনায় আছে।

কিন্তু সমস্যা হলো—

  • আইনগতভাবে রুশ সম্পদ ব্যবহারের বৈধতা এখনো নিশ্চিত নয়।
  • ইইউর কয়েকটি বড় দেশ এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে।
  • ইউক্রেনকে সহায়তার তহবিল ধীরে ধীরে ফুরিয়ে আসছে।

ব্রাসেলসে কূটনীতিকরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন—

“রাশিয়ার সম্পদ যুদ্ধ শেষে ফিরিয়ে দিতে হতে পারে। তাই এখনই সব ব্যবহার করা ঝুঁকিপূর্ণ।”

ফলে এই বিশাল প্রকল্প বাস্তবায়নে আর্থিক কাঠামো স্পষ্ট হতে আরও সময় লাগবে বলে মনে করা হচ্ছে।

ইউক্রেনের বর্তমান বিমান শক্তি: কোন কোন দেশ সাহায্য করছে?

ইউক্রেন এরই মধ্যে কয়েকটি উন্নত বিমান হাতে পেয়েছে—

  • মার্কিন তৈরি এফ-১৬ — নেদারল্যান্ডস, ডেনমার্ক, নরওয়ে সরবরাহ করছে
  • ফরাসি মিরাজ ২০০০
  • সুইডেনের গ্রিপেন জেট — পরীক্ষামূলক অনুমতি পেয়েছে

তবে বিশ্লেষকদের মতে—

“ইউক্রেনের আকাশকে নিরাপদ করতে কমপক্ষে ১৫০–২০০ উন্নত যুদ্ধবিমান প্রয়োজন।”

রাফালের ১০০টি বিমান এই ফাঁক অনেকটাই পূরণ করবে।

রাশিয়ার প্রতিক্রিয়া—মস্কোর ভীতি নাকি নতুন ষড়যন্ত্র?

রাশিয়া পূর্বেই পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর অস্ত্র সহায়তাকে “যুদ্ধকে দীর্ঘায়িত করার কৌশল” বলে সমালোচনা করে আসছে। মস্কো বারবার সতর্ক করে বলেছে—

  • “ইউক্রেনকে অস্ত্র দিলে পুরো ইউরোপ যুদ্ধের ঝুঁকিতে পড়বে।”
  • “রাফাল বিমান সরবরাহকে রাশিয়া সরাসরি হুমকি হিসেবে দেখবে।”

রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমগুলোতে চুক্তিকে “উস্কানিমূলক” বলে বর্ণনা করা হচ্ছে। তবে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ বলেছেন—

“রাশিয়ার ভয়ে আমরা ইউক্রেনকে অসহায় ফেলে রাখতে পারি না। স্বাধীনতার লড়াইয়ে ইউক্রেনের পাশে থাকা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।”

ইউক্রেনে সাম্প্রতিক রুশ হামলা: হতাহতের সংখ্যা বাড়ছে প্রতিদিন

চুক্তির দিনেই রাশিয়া উত্তর–পূর্ব ইউক্রেনের বালাক্লিয়া শহরে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। স্থানীয় কর্মকর্তাদের তথ্য অনুযায়ী—

  • ৩ জন নিহত
  • ১৫ জন আহত

এ ছাড়াও রাশিয়ার ড্রোন ও ক্রুজ মিসাইল হামলায় দেশজুড়ে বারবার বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হচ্ছে। জেলেনস্কি এসব হামলাকে “যুদ্ধাপরাধ” বলেছেন।

বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ: রাফাল কি যুদ্ধের গতিপথ বদলাতে পারবে?

ব্রিটিশ থিঙ্ক–ট্যাঙ্ক RUSI–এর বিশেষজ্ঞ জাস্টিন ব্রঙ্ক বলেন—

“রাফাল বিমানগুলো নিঃসন্দেহে শক্তিশালী। কিন্তু এগুলো কবে আসবে এবং সাথে কোন অস্ত্র প্যাকেজ দেওয়া হবে—এটাই নির্ধারণ করবে প্রকৃত ফলাফল।”

বিশ্লেষকদের মতে—

  1. রাফাল–এফ৪ অত্যাধুনিক।
  2. কিন্তু পাইলট প্রশিক্ষণ, যন্ত্রাংশ, রক্ষণাবেক্ষণে সময় লাগবে।
  3. তাৎক্ষণিক পরিবর্তন আশা করা বাস্তবসম্মত নয়।

এফ–১৬ হোক, লেপার্ড–টু ট্যাংক হোক—সব পশ্চিমা অস্ত্র ব্যবস্থারই একই সমস্যা:
সঠিক ব্যবহার শেখাতে দীর্ঘ সময় লাগে এবং বিশাল সাপোর্ট ক্রু প্রয়োজন।

তবে দীর্ঘমেয়াদী নিরাপত্তার দিক থেকে এটি ইউক্রেনের জন্য বিরাট অর্জন।

জেলেনস্কির পরবর্তী কূটনৈতিক মিশন: স্পেন, গ্রিস এবং আরও দেশ

ফ্রান্স সফর শেষে জেলেনস্কি এখন—

  • স্পেনের কাছ থেকে আরও বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা
  • গ্রিসের কাছ থেকে গ্যাস সরবরাহ
  • ইতালির কাছ থেকে সাইবার ডিফেন্স সহায়তা
  • জার্মানির কাছ থেকে আরও IRIS–T প্রতিরক্ষা সিস্টেম

চাইতে ইউরোপ সফরে রয়েছেন।

বিশেষ করে শীতের আগে জ্বালানি ও বিদ্যুৎসংকট ঠেকাতে গ্রিসের সঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্যাস চুক্তি সম্পন্ন করেছেন।

রাশিয়ার দখলে এখনও ইউক্রেনের ২০% ভূখণ্ড

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি পূর্ণ মাত্রায় যুদ্ধ শুরু করেন।
বর্তমানে—

  • ডোনেৎস্ক
  • লুহানেস্ক
  • জাপোরিজ্জিয়া
  • খেরসন

অঞ্চলের একটি বড় অংশসহ প্রায় ২০% এলাকা রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে

ধীরগতির হলেও রাশিয়ার সেনারা ক্রমাগত অগ্রসর হচ্ছে।

ইউক্রেন–ফ্রান্স চুক্তি কি ইউরোপের নিরাপত্তা নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করবে?

ফ্রান্সের কাছ থেকে ১০০ রাফাল যুদ্ধবিমান পাওয়া শুধু ইউক্রেনের জন্য নয়—সমগ্র ইউরোপের নিরাপত্তার সমীকরণ পাল্টে দিতে পারে।
ইউক্রেন এখন পশ্চিমা বিশ্বের সমর্থনে এক নতুন প্রতিরক্ষা যুগে প্রবেশ করছে।
যুদ্ধের অবসান এখনও অনিশ্চিত, কিন্তু রাফাল চুক্তি ইউক্রেনকে ভবিষ্যতের জন্য নতুন আশা ও শক্তি দিচ্ছে।

MAH – 13854 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button