ইসরাইলের বিরুদ্ধে জাতিসংঘে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দায়েরের প্রস্তুতি নিচ্ছে লেবানন। দক্ষিণ-পশ্চিম লেবাননের ইয়রুন এলাকায় জাতিসংঘ নির্ধারিত ‘ব্লু লাইন’ অতিক্রম করে ইসরাইলি সেনাবাহিনীর দেয়াল নির্মাণকে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন হিসেবে দেখছে বৈরুত সরকার। দেশটির প্রেসিডেন্ট জোসেফ আউন ইতোমধ্যে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ প্রস্তুতের নির্দেশ দিয়েছেন। বিষয়টি আন্তর্জাতিক মহলেও নতুন করে উদ্বেগ তৈরি করেছে।
মিডল ইস্ট মনিটরসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, ইসরাইলি বাহিনীর নির্মিত নতুন দেয়ালটি লেবাননের ভৌগোলিক সীমা থেকে প্রায় চার হাজার বর্গমিটার অংশ দখল করে সেটিকে ইসরাইলের অভ্যন্তরীণ এলাকায় যুক্ত করছে। ফলে সেই অংশের স্থানীয় জনগণ এখন আর নিজের জমিতে প্রবেশ করতে পারছেন না, যা স্থানীয়দের জীবনযাত্রায় বড় ধরনের প্রভাব ফেলছে।
ব্লু লাইন অতিক্রম করে ইসরাইলের নির্মাণকাজ—কেন এটি বড় ইস্যু?
‘ব্লু লাইন’ হলো ২০০০ সালে জাতিসংঘ দ্বারা নির্ধারিত একটি অস্থায়ী সীমান্তরেখা, যা ইসরাইল ও লেবাননের মধ্যে যুদ্ধবিরতির সীমা হিসেবে গৃহীত। এটি প্রকৃত আন্তর্জাতিক সীমান্ত নয়, তবে উভয় দেশকে সংঘর্ষ এড়াতে এটি অনুসরণ করতে বলা হয়।
২০০৬ সালের দ্বিতীয় লেবানন যুদ্ধের পর জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের রেজোলিউশন ১৭০১-এর মাধ্যমে এই সীমান্তবর্তী অঞ্চলে যে কোনো ধরনের সামরিক নির্মাণ, স্থাপনা বা সামরিক উপস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কঠোর বিধি আরোপ করা হয়।
কিন্তু লেবাননের অভিযোগ, ইসরাইল সেই বিধি লঙ্ঘন করেই দেয়াল নির্মাণের কাজ এগিয়ে নিচ্ছে।
লেবাননের প্রেসিডেন্টের সরাসরি নির্দেশ
এক বিবৃতিতে প্রেসিডেন্ট জোসেফ আউন বলেন—
“ইসরাইলের এই পদক্ষেপ লেবাননের সার্বভৌমত্ব, আঞ্চলিক অখণ্ডতা এবং জাতিসংঘের রেজোলিউশন ১৭০১-এর সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। লেবানন রাষ্ট্র এই অবৈধ নির্মাণ কোনোভাবেই মেনে নেবে না।”
তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইউসুফ রাগিকে নির্দেশ দিয়েছেন জাতিসংঘে লেবাননের স্থায়ী মিশনের মাধ্যমে জরুরি অভিযোগ দাখিল করতে এবং এই ঘটনার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা চাইতে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, ইসরাইলকে ‘ব্লু লাইন’ থেকে সরে যাওয়ার জন্য জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশন (UNIFIL)-এর সঙ্গেও বৈরুত সরকার যোগাযোগ করছে।
জাতিসংঘও জানায় উদ্বেগ
গত সপ্তাহে জাতিসংঘ মহাসচিবের মুখপাত্র স্টেফান দ্যুজারিক সাংবাদিকদের জানান যে, ইসরাইলি দেয়াল নির্মাণের ফলে প্রায় ৪,০০০ বর্গমিটার এলাকা লেবাননের সাধারণ মানুষ ব্যবহারের বাইরে চলে গেছে।
জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশন UNIFIL ইতোমধ্যে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে এবং বিষয়টি খতিয়ে দেখছে। তবে ইসরাইলকে তারা এখনো প্রকাশ্যে কোনো সতর্কতা জানায়নি।
ইসরাইলের যুক্তি—নিজেদের নিরাপত্তার জন্য “প্রতিরক্ষা দেয়াল”
ইসরাইলি সামরিক বাহিনী বলছে, এই দেয়াল তাদের নিরাপত্তার স্বার্থে নির্মিত। তাদের দাবি, হিজবুল্লাহ সীমান্ত এলাকায় টানেল বা গোপন পথ তৈরি করতে পারে—এ কারণে সীমান্তে অতিরিক্ত সুরক্ষা প্রয়োজন।
তবে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের মতে, ইসরাইল বেশ কয়েক বছর ধরে লেবানন সীমান্তে ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণ বাড়াতে চাইছে। এর অংশ হিসেবেই প্রতিরক্ষা দেয়ালের নামে তারা নতুন নতুন এলাকাকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিচ্ছে।
হিজবুল্লাহ ও ইসরাইলের উত্তেজনা—পটভূমি
লেবাননের শক্তিশালী রাজনৈতিক ও সামরিক সংগঠন হিজবুল্লাহ দীর্ঘদিন ধরে ইসরাইলের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে আসছে। সীমান্ত এলাকায় প্রায়ই ছোটখাটো গোলাগুলি, ড্রোন হামলা বা পাল্টা হামলার ঘটনা ঘটে।
২০২৩–২০২৫ সময়কালে এই উত্তেজনা আরও বেড়েছে। বিশেষ করে গাজার পরিস্থিতির পর হিজবুল্লাহ ইসরাইলের উত্তরাঞ্চলে বেশ কয়েকটি রকেট হামলা চালিয়েছে, আর ইসরাইলও লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলে টার্গেটেড হামলা বৃদ্ধি করেছে।
এ অবস্থায় ব্লু লাইন এলাকায় নতুন করে ইসরাইলের দেয়াল নির্মাণ সেদেশে উত্তেজনার মাত্রা দ্বিগুণ করেছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের কঠোর সমালোচনা
গত সপ্তাহে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ইসরাইলের প্রতি ‘চরম সংযম’ দেখানোর আহ্বান জানায়। ইইউর বিবৃতিতে বলা হয়—
“লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলে ইসরাইলের ধারাবাহিক আক্রমণ উদ্বেগজনক। আমরা ইসরাইলকে হিজবুল্লাহর সঙ্গে বিদ্যমান যুদ্ধবিরতি সম্মান করার আহ্বান জানাই।”
ইইউ আরও জানায়, সীমান্তে নতুন নির্মাণকাজ এ অঞ্চলের স্থিতিশীল পরিস্থিতিকে বিপন্ন করছে।
লেবাননের জনগণের ক্ষোভ ও উদ্বেগ
ইয়রুন এলাকার বাসিন্দারা বলছেন, তাদের কৃষিজমি, বাগান ও বসতবাড়ির অংশ দেয়াল নির্মাণের কারণে ব্যবহার করতে পারছেন না। সীমান্তে UNIFIL-এর অনুমতি ছাড়া তারা এখন একাধিক স্থানে চলাচল করতে পারছেন না।
স্থানীয় এক বাসিন্দা গণমাধ্যমকে বলেন—
“ইসরাইল যখন খুশি সীমান্তে এসে আমাদের জমির অংশ কেটে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা প্রতিদিন ভয় নিয়ে বেঁচে আছি।”
আন্তর্জাতিক আইন কী বলে?
জাতিসংঘের রেজোলিউশন ১৭০১ অনুসারে—
- ব্লু লাইন অতিক্রম করে কোনো সামরিক স্থাপনা নির্মাণ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ
- ইসরাইলকে লেবাননের সীমান্তে সামরিক তৎপরতা কমাতে হবে
- লেবাননের সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করতে হবে
- UNIFIL-এর অনুমতি ব্যতিরেকে কোনো পরিবর্তন আনা যাবে না
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইসরাইলের নতুন দেয়াল নির্মাণ স্পষ্টভাবে এই রেজোলিউশন ভঙ্গ করছে।
মধ্যপ্রাচ্যের নতুন অস্থিরতার ঝুঁকি
ইসরাইল-লেবানন উত্তেজনা শুধু এই দুই দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এটি পুরো মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে নড়বড়ে করার সম্ভাবনা রাখে।
বিশ্লেষকদের মতে—
- গাজা ও পশ্চিম তীরে চলমান সংঘাত
- ইরান-ইসরাইল উত্তেজনা
- সিরিয়ার অস্থিতিশীলতা
- লেবাননের অর্থনৈতিক সংকট
—এসব মিলিয়ে মধ্যপ্রাচ্য এখন এমন একটি পর্বে রয়েছে যেখানে সামান্য উত্তেজনাও বড় যুদ্ধের জন্ম দিতে পারে।
ইসরাইলের নতুন দেয়াল সেই উত্তেজনা আরও বাড়িয়েছে।
জাতিসংঘের ভূমিকা কতটা কার্যকর হবে?
অনেকবারের মতো এবারও জাতিসংঘের সামনে চ্যালেঞ্জ—ইসরাইলকে আন্তর্জাতিক আইন মানতে বাধ্য করা।
তবে অতীত অভিজ্ঞতা বলছে, নিরাপত্তা পরিষদে যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো ক্ষমতার কারণে ইসরাইলের বিরুদ্ধে কঠোর কোনো ব্যবস্থা নিতে জাতিসংঘ সাধারণত অক্ষম হয়ে পড়ে।
তবে লেবানন আশা করছে, কমপক্ষে আন্তর্জাতিক চাপ তৈরি হলে ইসরাইল কিছুটা হলেও নির্মাণকাজ থামাতে বাধ্য হবে।
বৈরুতের দাবি—ইসরাইলের নতুন পরিকল্পনা থামাতেই হবে
লেবাননের প্রেসিডেন্টের দপ্তর এক বিবৃতিতে বলেছে—
“ইসরাইল যেভাবে সীমান্ত লঙ্ঘন করে নির্মাণকাজ চালিয়ে যাচ্ছে, তা শুধু লেবাননের বিরুদ্ধে নয়—আন্তর্জাতিক আইনের বিরুদ্ধেও আঘাত।”
তারা আরও বলেছে, যদি প্রয়োজন হয়, লেবানন আন্তর্জাতিক আদালতেও ইসরাইলের বিরুদ্ধে মামলা করতে প্রস্তুত।
বিশ্লেষকদের অভিমত
মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক রাজনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন—
- ইসরাইল এই দেয়ালকে নিরাপত্তার অজুহাতে ব্যবহার করছে
- প্রকৃত উদ্দেশ্য হলো সীমান্তে ‘নতুন বাস্তবতা’ তৈরি করা
- এতে ভবিষ্যতে সীমান্ত পুনর্নির্ধারণ সহজ হবে
- লেবাননের দুর্বল রাজনৈতিক অবস্থার সুযোগ নিচ্ছে ইসরাইল
একই সঙ্গে তারা মনে করছেন, লেবাননের অভিযোগ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নজর কাড়লেও ইসরাইল তা থামাবে কিনা, তা অনিশ্চিত।
সংক্ষেপে—পরবর্তী দিনগুলোতে কী ঘটতে পারে?
পরিস্থিতির সারসংক্ষেপ—
- লেবানন আনুষ্ঠানিক অভিযোগ পাঠাচ্ছে UN-এ
- জাতিসংঘ বিষয়টি তদন্ত করছে
- ইসরাইল নির্মাণকাজ থামানোর কোনো ইঙ্গিত দেয়নি
- UNIFIL সীমান্তে নজরদারি বাড়াচ্ছে
- লেবানন–ইসরাইল উত্তেজনা যেকোনো সময় বৃদ্ধি পেতে পারে
মধ্যপ্রাচ্যের সংকটপূর্ণ অবস্থা বিবেচনায় এই দেয়াল নির্মাণ আগামী সপ্তাহগুলোতে আন্তর্জাতিক সংবাদে বড় আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠতে পারে।
MAH – 13839 I Signalbd.com



