বিশ্ব

বাসের সঙ্গে সংঘর্ষে যাত্রীদের ওপর পড়ল ট্রাকের পাথর, ২৪ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু

Advertisement

ভারতের তেলেঙ্গানায় ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনায় এক মুহূর্তে থেমে গেল ২৪টি প্রাণের জীবনযাত্রা। সোমবার সকালে পাথরবোঝাই ট্রাক ও যাত্রীবাহী বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে এই মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। ট্রাকের ওপর থাকা পাথর পুরো বাসের গায়ে পড়ে বাসটি মুহূর্তেই দুমড়ে-মুচড়ে যায়। ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান অধিকাংশ যাত্রী।

ভয়াবহ দুর্ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ

সোমবার (৩ নভেম্বর) সকালে ভারতের তেলেঙ্গানার রাঙ্গা রেড্ডি জেলার মির্জাগুদা গ্রামের কাছে রাজ্য পরিবহন সংস্থার (আরটিসি) একটি বাস ও পাথরবোঝাই ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। স্থানীয় সময় সকাল ৬টার দিকে দুর্ঘটনাটি ঘটে।

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, তান্দুর ডিপোর বাসটি প্রায় ৭০ জন যাত্রী নিয়ে হায়দরাবাদের দিকে যাচ্ছিল। বিপরীত দিক থেকে অতিরিক্ত গতিতে আসা ট্রাকটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বাসের সামনের অংশে সজোরে আঘাত করে। সংঘর্ষের মুহূর্তেই ট্রাকের পাথরের বোঝা উল্টে গিয়ে বাসের ছাদ ভেদ করে যাত্রীদের ওপর পড়ে। মুহূর্তেই বাসের ভেতরে চিৎকার, কান্না আর রক্তে মিশে যায় মৃত্যুপুরী।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, দুর্ঘটনার শব্দে চারপাশ কেঁপে ওঠে। স্থানীয়রা দ্রুত ঘটনাস্থলে ছুটে এসে উদ্ধারকাজ শুরু করেন। কয়েক মিনিটের মধ্যে পুলিশ ও দমকল বাহিনী ঘটনাস্থলে পৌঁছে তিনটি জেসিবি মেশিন দিয়ে ধ্বংসস্তূপ সরানোর কাজ শুরু করে।

নিহত ও আহতদের পরিচয় এবং উদ্ধার অভিযান

পুলিশ নিশ্চিত করেছে যে নিহত ২৪ জনের মধ্যে দুই চালক, বেশ কয়েকজন নারী ও শিশু রয়েছে। নিহতদের মধ্যে একজন মাত্র ১০ মাস বয়সী শিশুও রয়েছে। আহত হয়েছেন অন্তত ৩০ জন। তাদের মধ্যে ১২ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।

চেভেল্লা থানার সার্কেল ইনস্পেক্টর ভূপাল শ্রীধর জানিয়েছেন, “সংঘর্ষ এতটাই ভয়াবহ ছিল যে বাসের সামনের অংশ প্রায় পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। যাত্রীদের অনেকেই পাথরের নিচে আটকে পড়েছিলেন। স্থানীয়দের সহায়তায় ১৫ জনকে জীবিত উদ্ধার করা গেছে।”

উদ্ধারকাজে অংশ নিতে গিয়ে নিজেও আহত হন ভূপাল শ্রীধর। একটি জেসিবি মেশিনের ধাক্কায় তার পায়ে আঘাত লাগে এবং তাকে স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

আহতদের প্রথমে চেভেল্লা সরকারি হাসপাতালে নেওয়া হয়। গুরুতর আহতদের হায়দরাবাদের বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে। দুর্ঘটনাস্থল থেকে এখনও কিছু দেহাবশেষ উদ্ধার করা বাকি আছে বলে জানিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন।

প্রাথমিক তদন্তে যা জানা গেছে

তেলেঙ্গানা পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে, অতিরিক্ত গতিতে ট্রাক চালানোর কারণেই দুর্ঘটনাটি ঘটে। ট্রাকচালক একটি ঢালু রাস্তায় এসে নিয়ন্ত্রণ হারান এবং সামনের বাসটিকে এড়িয়ে যেতে না পেরে সরাসরি ধাক্কা মারেন।

একজন সিনিয়র পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, “আমরা দুর্ঘটনাস্থল থেকে ট্রাকচালকের দেহ উদ্ধার করেছি। ব্রেক ফেল বা অতিরিক্ত ওজনের কারণে নিয়ন্ত্রণ হারানোর আশঙ্কা করা হচ্ছে। রাস্তার অবস্থা ও যানবাহনের গতি বিশ্লেষণ করতে ফরেনসিক টিম কাজ করছে।”

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, সংঘর্ষের আগে বাসচালক ট্রাককে সাইড দিতে চিৎকার করছিলেন, কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়া আসেনি। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই সংঘর্ষ ঘটে যায়।

পূর্বের ঘটনার সঙ্গে তুলনা ও রাস্তা নিরাপত্তা সংকট

তেলেঙ্গানায় গত কয়েক মাসে একাধিক বড় সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। বিশেষ করে খারাপ রাস্তা, অতিরিক্ত গতি ও ভারী যানবাহনের অনিয়ন্ত্রিত চলাচলই এসব দুর্ঘটনার প্রধান কারণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

ভারতের ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর (এনসিআরবি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে তেলেঙ্গানায় সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন প্রায় ৯ হাজার মানুষ। এর মধ্যে ৩০ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটেছে অতিরিক্ত গতি ও ক্লান্ত চালকের কারণে।

স্থানীয়রা বলছেন, “এই এলাকায় প্রতিদিনই ট্রাক চলে অতিরিক্ত বোঝা নিয়ে। পুলিশ খুব একটা নজরদারি করে না। আজকের এই দুর্ঘটনা সেই অবহেলার ফল।”

প্রশাসনের প্রতিক্রিয়া ও সরকারি উদ্যোগ

তেলেঙ্গানার মুখ্যমন্ত্রী এ রেবন্ত রেড্ডি এই দুর্ঘটনায় গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। তিনি মুখ্য সচিব রামকৃষ্ণ রাও এবং রাজ্য পুলিশের মহাপরিচালক বি শিবধর রেড্ডিকে তাৎক্ষণিক উদ্ধার ও ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনার নির্দেশ দেন। আহতদের উন্নত চিকিৎসার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে বিশেষ মেডিকেল টিম পাঠানো হয়েছে।

মুখ্যমন্ত্রী এক বিবৃতিতে বলেন, “এই দুর্ঘটনা আমাদের জন্য গভীর বেদনার। নিহতদের পরিবারকে রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে সবধরনের সহায়তা দেয়া হবে।”

এদিকে রাজ্য পরিবহন বিভাগ দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। কমিটি আগামী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে প্রাথমিক প্রতিবেদন জমা দেবে।

বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ: সড়ক নিরাপত্তায় প্রয়োজন কঠোর ব্যবস্থা

যানবাহন নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারতের রাজ্য মহাসড়কগুলোতে পণ্যবাহী ট্রাকের অতিরিক্ত গতি ও বোঝাই এখন বড় সংকটে পরিণত হয়েছে। ট্রাকচালকদের দীর্ঘ সময় ড্রাইভে থাকার কারণে ক্লান্তি ও মনোযোগ কমে যায়, যা দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ায়।

সড়ক নিরাপত্তা বিশ্লেষক সুব্রত চক্রবর্তী বলেন, “যানবাহনের নিয়মিত ফিটনেস টেস্ট, চালকদের প্রশিক্ষণ এবং রুট মনিটরিং না থাকলে এই দুর্ঘটনা রোধ সম্ভব নয়। প্রযুক্তিগত মনিটরিং ও ওভারলোডিং নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।”

তিনি আরও বলেন, “এ ধরনের দুর্ঘটনা প্রতিরোধে ‘স্মার্ট ট্রাফিক সার্ভিলেন্স’ ব্যবস্থা চালু করা উচিত, যাতে ট্রাকের গতি ও ওজন রিয়েল-টাইমে পর্যবেক্ষণ করা যায়।”

তেলেঙ্গানার রাঙ্গা রেড্ডি জেলার এই ভয়াবহ দুর্ঘটনা আবারও মনে করিয়ে দিল ভারতের সড়ক নিরাপত্তার ভয়াবহ বাস্তবতা। এক মুহূর্তের বেপরোয়া গতি কেড়ে নিল ২৪টি প্রাণ, আহত করল বহু মানুষকে।

প্রশাসনের উদ্ধার তৎপরতা প্রশংসনীয় হলেও বিশেষজ্ঞদের মতে, শুধু সহানুভূতি নয় — এখনই সময় কঠোর নীতি, নিয়ন্ত্রণ ও প্রযুক্তি-নির্ভর নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলার। না হলে এমন হৃদয়বিদারক দুর্ঘটনা বারবারই ঘটবে ভারতের ব্যস্ত সড়কগুলোতে।

এম আর এম – ২০৬৫,Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button