মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনীতি যখন চরম উত্তেজনার কেন্দ্রে, ঠিক সেই সময়ে লেবাননের প্রভাবশালী সংগঠন হিজবুল্লাহর মহাসচিব শেখ নাইম (নাঈম) কাসেম এক স্পষ্ট ও কঠোর বার্তা দিয়ে বিশ্ব রাজনীতিতে নতুন করে আলোচনা সৃষ্টি করেছেন। গত ৩১ অক্টোবর এক গুরুত্বপূর্ণ সমাবেশে তিনি সরাসরি অভিযোগ করেছেন যে, “যুক্তরাষ্ট্র লেবাননের জন্য নিরপেক্ষ মধ্যস্থতাকারী নয়; বরং তারা ইসরাইলি আগ্রাসন এবং দখলদারিত্বকে প্রকাশ্যে সমর্থন ও ত্বরান্বিত করছে।” তাঁর এই বক্তব্য এমন এক সময়ে এসেছে যখন লেবাননের দক্ষিণ সীমান্তে ইসরাইলি অনুপ্রবেশ ও হামলার ঘটনায় উত্তেজনা তুঙ্গে।
এই বিস্ফোরক উক্তি কেবল লেবাননের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নয়, বরং বৃহত্তর মধ্যপ্রাচ্যের কৌশলগত ভারসাম্যের ক্ষেত্রেও সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলতে পারে। শেখ কাসেমের বার্তাটি সরল: লেবাননের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় বিদেশি শক্তির মিথ্যা নিরপেক্ষতার ওপর নির্ভর না করে, অভ্যন্তরীণ ঐক্য এবং জাতীয় সেনাবাহিনীর শক্তিশালীকরণের মাধ্যমে নিজেদের প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে হবে।
আমেরিকার ভূমিকা: নিরপেক্ষতার মুখোশ ও আগ্রাসীর সহায়ক শক্তি
নাইম কাসেমের ভাষ্যের মূল ভিত্তি হলো—যুক্তরাষ্ট্র মুখে লেবাননের স্থিতিশীলতার কথা বললেও, বাস্তবে তাদের নীতি পুরোপুরি ইসরাইল-কেন্দ্রিক। তিনি বলেন, আমেরিকা এমন একটি রূপ দেখানোর চেষ্টা করে যেন তারা দুই পক্ষের মধ্যে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করছে, কিন্তু তাদের সামরিক ও আর্থিক সমর্থন কেবল আগ্রাসীর হাতেই শক্তি যোগাচ্ছে।
“আমেরিকা এমন ভান করছে যে তারা একটি মধ্যস্থতাকারী, কিন্তু সত্য হলো—তারা ইসরাইলকে ব্যতীত অন্য কোনো পক্ষকে সমানভাবে সমর্থন করে না। লেবাননের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় তাদের ভূমিকা নিরপেক্ষ নয়, বরং আগ্রাসীর সহায়ক।”
আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থাগুলির প্রতিবেদন এবং স্থানীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্র একদিকে লেবাননের সেনাবাহিনীকে আর্থিক ও সামরিক সহায়তা দেয়, আবার অন্যদিকে ইসরাইলের নিরাপত্তার নামে হিজবুল্লাহকে নিরস্ত্র করার জন্য লেবাননের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। হিজবুল্লাহর মতে, এই দ্বিমুখী নীতি লেবাননের জাতীয় স্বার্থ ও সার্বভৌমত্বের জন্য ক্ষতিকর।
লেবাননের ঐক্য ও সেনাবাহিনীর প্রতি আহ্বান
দক্ষিণ লেবাননে ক্রমাগত উত্তেজনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০২৪ সালের নভেম্বরে যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও ইসরাইল তা বারবার লঙ্ঘন করে চলছে। তারা পাঁচটি কৌশলগত অবস্থানে সেনা মোতায়েন রেখেছে এবং নিয়মিত বিমান হামলা চালাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে লেবাননের প্রেসিডেন্ট জোসেফ আউন সেনাবাহিনীকে ইসরাইলি অনুপ্রবেশ প্রতিহত করার নির্দেশ দেওয়ার প্রস্তাব দেন।
নাইম কাসেম এই প্রস্তাবকে “দায়িত্বশীল ও ভরসাযোগ্য পদক্ষেপ” হিসেবে স্বাগত জানিয়েছেন। তবে একইসঙ্গে তিনি লেবাননের সরকারকে উদ্দেশ্য করে এক সুদৃঢ় আহ্বান জানিয়েছেন:
“সেনাবাহিনীকে কার্যকরভাবে সজ্জিত ও রাজনৈতিকভাবে সমর্থন না দিলে, সেই নির্দেশ কাগজেই আটকে যাবে। হিজবুল্লাহ সরকারের কাছে অনুরোধ জানাচ্ছে—সেনাবাহিনীকে সমর্থন দেওয়ার জন্য সরকার একটি সুস্পষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণ করুক।”
কাসেম জোর দিয়ে বলেন, দক্ষিণ লেবাননের মানুষ তাদের ত্যাগ ও সংগ্রামের মাধ্যমে তাদের ভূমি রক্ষা করেছে। যেকোনো অভ্যন্তরীণ বিভাজন বা বাহ্যিক চাপের সামনে জাতীয় ঐক্য রক্ষা করা অপরিহার্য। হিজবুল্লাহ মহাসচিবের মতে, এই ঐক্যই লেবাননের শক্তি, যা দেশকে ‘বৃহৎ ইসরাইল’ গঠনের যেকোনো প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে সাহস জোগাবে।
আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট: এক জটিল সমীকরণ
মধ্যপ্রাচ্যে চলমান গাজা যুদ্ধ ও সিরিয়াসহ অন্যান্য ফ্রন্টে উত্তেজনা—লেবাননের পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।
- লেবাননের সামরিক সীমাবদ্ধতা: লেবাননের সেনাবাহিনী অর্থ এবং আধুনিক অস্ত্রের জন্য মূলত বিদেশী সহায়তার ওপর নির্ভরশীল। যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলোই তাদের সবচেয়ে বড় পৃষ্ঠপোষক। সামরিক সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, লেবাননের সেনাবাহিনীর সদস্য সংখ্যা প্রায় ৫০,০০০ হলেও তাদের কাছে কোনো যুদ্ধবিমান নেই এবং হেলিকপ্টারের সংখ্যাও সীমিত। এই অবস্থায়, শক্তিশালী ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে এককভাবে লড়াই করার সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন আছে।
- হিজবুল্লাহর সামরিক শক্তি: অন্যদিকে, হিজবুল্লাহ একটি সুসংগঠিত, প্রশিক্ষিত এবং ইরান-সমর্থিত শক্তিশালী আধা-সামরিক গোষ্ঠী। তারা লেবাননের অভ্যন্তরে ব্যাপক সামরিক প্রভাব রাখে। লেবাননের সংবিধান অনুযায়ী দেশের প্রতিরক্ষা দায়িত্ব সেনাবাহিনীর হাতে থাকলেও, বাস্তবে হিজবুল্লাহর অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ নিয়ে অভ্যন্তরীণ বিতর্ক লেবাননের রাজনীতিতে একটি নাজুক সম্পর্ক সৃষ্টি করেছে।
- যুক্তরাষ্ট্রের চাপ: রয়টার্স ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থার মতে, যুক্তরাষ্ট্র লেবাননকে হিজবুল্লাহকে অস্ত্রহীন করার জন্য চাপে ফেলার পাশাপাশি নিরাপত্তা জোরদারের প্রস্তাবও দিয়েছে, যা হিজবুল্লাহ প্রত্যাখ্যান করে আসছে। সম্প্রতি মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরও হিজবুল্লাহকে নিরস্ত্রীকরণে পূর্ণ সমর্থন দিয়েছে। এই চাপ অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে আরও বিভাজন সৃষ্টি করছে।
- ইসরাইলের কৌশলগত ব্যর্থতা: ফরেন অ্যাফেয়ার্সের মতো বিখ্যাত মার্কিন সাময়িকীও ইসরাইলের সামরিক লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থতা তুলে ধরেছে। গাজা, লেবানন এবং সিরিয়ায় সামরিক অভিযান সত্ত্বেও হামাস গাজায় সক্রিয় রয়েছে এবং হিজবুল্লাহ অস্ত্রত্যাগ করতে অস্বীকার করেছে। এই ব্যর্থতা মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলের প্রভাব কমিয়েছে এবং প্রতিরোধ জোটের অবস্থানকে শক্তিশালী করেছে।
সম্ভাব্য পরিণতি ও কৌশলগত প্রভাব
নাইম কাসেমের এই তীব্র ভাষা এবং সেনাবাহিনীর প্রতি তাঁর আহ্বান শুধুমাত্র রাজনৈতিক কৌশল নয়, এর সামরিক ও কূটনৈতিক প্রভাবও রয়েছে:
- সীমান্তে সংঘাতের ঝুঁকি বৃদ্ধি: যদি লেবানন সরকার সেনাবাহিনীকে কার্যকরভাবে সমর্থন না করে বা হিজবুল্লাহর দাবি অনুযায়ী ঐক্যবদ্ধ না হয়, তবে হিজবুল্লাহর প্রতিরোধবাদী ভূমিকা আরও জোরালো হতে পারে, যার ফলস্বরূপ সীমান্তে ইসরাইলের সাথে বড় আকারের সামরিক সংঘর্ষের ঝুঁকি বাড়বে।
- কূটনৈতিক চাপ: কাসেমের বক্তব্যে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি অভিযুক্ত হওয়ায় ওয়াশিংটন এবং পশ্চিমাদের পক্ষ থেকে লেবাননের সরকারের ওপর চাপ আরও বাড়তে পারে। লেবাননকে আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্ন করার প্রচেষ্টা হতে পারে, যা দেশটির বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটকে আরও বাড়িয়ে তুলবে।
- অভ্যন্তরীণ ক্ষমতার দ্বন্দ্ব: হিজবুল্লাহর এই অবস্থান লেবাননের আন্তঃদলীয় সমঝোতাকে কঠিন করে তুলবে। সরকারের মধ্যে হিজবুল্লাহকে সমর্থনকারী এবং নিরস্ত্রীকরণে আগ্রহী পক্ষগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব আরও তীব্র হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
- বৃহৎ ইসরাইল তত্ত্ব: হিজবুল্লাহর পক্ষ থেকে ইসরাইলের আগ্রাসনকে ‘বৃহৎ ইসরাইল’ গঠনের অংশ হিসেবে গণ্য করার ঘোষণা পুরো অঞ্চলের জন্য এক কঠোর বার্তা। এর অর্থ হলো—লেবাননের যেকোনো সামরিক বা রাজনৈতিক দুর্বলতাকে তারা ইসরাইলের সাম্রাজ্যবাদী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে দেখবে এবং এর বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাবে।
কাসেমের আবেদন: ঐক্যবদ্ধ লেবাননই প্রতিরোধের মূলমন্ত্র
নাইম কাসেম তার বক্তব্যে বারবার লেবাননের জনগণের প্রতি ঐক্যের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি মনে করেন, অভ্যন্তরীণ বিভেদকে দূরে সরিয়ে যদি লেবাননিরা একজোট হয়, তবেই দেশের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
“যত বেশি আমরা ঐক্যবদ্ধ হব, তত দ্রুত লেবাননের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে সক্ষম হব। আমাদের বিভেদ ভুলে যেতে হবে, কারণ ইসরাইল সমগ্র লেবাননের জন্য হুমকি।”
তাঁর প্রস্তাবিত কৌশলগত প্রস্তুতিগুলি হলো:
- সেনাবাহিনীর পূর্ণাঙ্গ সমর্থন: সরকারকে সামরিক, আর্থিক ও রাজনৈতিকভাবে লেবাননের সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করার জন্য একটি সুনির্দিষ্ট এবং দ্রুত কার্যকর পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
- কঠোর কূটনৈতিক অবস্থান: আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য শক্তির ভূমিকা সম্পর্কে স্পষ্ট বক্তব্য রাখা এবং ইসরাইলের যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে বিশ্ব জনমত গঠন করা।
- সমাজভিত্তিক ঐক্য: লেবাননের জনগণকে সশক্ত করার উদ্দেশ্যে সামাজিক সংহতি বাড়ানো এবং উন্নয়নমূলক উদ্যোগ এগিয়ে নেওয়া।
ভবিষ্যতের পথ: সংকট, কূটনীতি ও স্থিতিশীলতা
লেবানন আজ এক কঠিন রাজনৈতিক ও সামরিক মোড়ের মুখে দাঁড়িয়ে। একদিকে হিজবুল্লাহর কঠোর প্রতিরোধবাদী অবস্থান, অন্যদিকে ইসরাইলের নিরবচ্ছিন্ন আগ্রাসন এবং আন্তর্জাতিক শক্তির চাপ।
বিশ্লেষকরা বলছেন, হিজবুল্লাহ অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে তার প্রভাব বজায় রাখতে সক্ষম। তাদের এই কণ্ঠস্বর সরকারকে একটি প্রতিরোধমূলক ভারসাম্য দিচ্ছে, কিন্তু একইসঙ্গে তা আন্তর্জাতিকভাবে চাপ বাড়াচ্ছে। গাজা ও লেবাননে ইসরাইলের কৌশলগত ব্যর্থতা সত্ত্বেও, ইসরাইল তার সামরিক প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করতে মরিয়া।
লেবাননের সাধারণ মানুষ শান্তি ও অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার চায়। তারা চায় একটি দায়িত্বশীল রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা, যা সীমান্ত সহিংসতা বন্ধ করবে। তবে, কাসেমের বক্তব্য স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, দ্রুত কোনো সমাধান সহজে আসবে না। কূটনৈতিক আলোচনা, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ঐক্য এবং আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সাথে সুচিন্তিত বোঝাপড়ার মাধ্যমে লেবাননকে স্থিতিশীল করার জন্য একটি সুদূরপ্রসারী ও বাস্তবভিত্তিক কৌশল প্রয়োজন।
শেখ নাইম কাসেমের এই আহ্বান লেবাননের বর্তমান পরিস্থিতির গুরুত্বকে আরও বাড়িয়ে তুলল। লেবাননের রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং জনগণের সামনে এখন প্রশ্ন, তারা কি ঐক্যবদ্ধ হয়ে সার্বভৌমত্বের জন্য দৃঢ়ভাবে দাঁড়াবে, নাকি বিভেদকে প্রশ্রয় দিয়ে বৈদেশিক আগ্রাসনকে আরও উৎসাহিত করবে? সময়ই বলে দেবে, লেবাননের ভবিষ্যৎ কোন পথে এগোবে।
MAH – 13600 I Signalbd.com



