বিশ্ব

যুদ্ধবিরতির মধ্যেও গাজ্জায় হামলা, ত্রাণের ৭৫ শতাংশ আটকে রাখছে ইসরাইল

Advertisement

ফিলিস্তিনের গাজ্জা উপত্যকায় যুদ্ধবিরতির প্রজ্ঞাপন কার্যকর হওয়ার পরও ইসরাইলি সেনারা ত্রাণ প্রবাহ সীমিত রাখায় মানবিক সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। আমেরিকার মধ্যস্থতায় ঘোষিত যুদ্ধবিরতি অনুযায়ী গাজ্জায় ত্রাণ ও বাণিজ্যিক পণ্য প্রবেশ করা উচিত হলেও ইসরাইল অনবরত বাধা সৃষ্টি করছে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গাজ্জায় পৌঁছানো ত্রাণের মাত্র এক-চতুর্থাংশ অনুমোদিত হয়েছে, অর্থাৎ মোট ত্রাণের ৭৫ শতাংশ এখনও আটকে রয়েছে।

ত্রাণের প্রবাহ সীমিত: গাজ্জার মানুষের মানবিক সংকট

গাজ্জা কর্তৃপক্ষ জানাচ্ছে, ১০ থেকে ৩১ অক্টোবরের মধ্যে মাত্র ৩,২০৩টি ত্রাণ ও বাণিজ্যিক ট্রাক গাজ্জায় প্রবেশ করতে পেরেছে। এটি দৈনিক গড়ে মাত্র ১৪৫টি ট্রাকের সমান, যা যুদ্ধবিরতির অংশ হিসেবে নির্ধারিত দৈনিক ৬০০ ট্রাকের মাত্র ২৪ শতাংশ।

গাজ্জার সরকারি গণমাধ্যম দপ্তর এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, “ইসরাইলি দখলদার বাহিনী ইচ্ছাকৃতভাবে ত্রাণ ও বাণিজ্যিক পণ্যবাহী ট্রাকগুলোর প্রবেশে বাধা সৃষ্টি করছে। এতে ২৪ লাখেরও বেশি মানুষের মানবিক সংকট ক্রমশ ভয়াবহ আকার নিচ্ছে। এর দায় সম্পূর্ণভাবে ইসরাইলের উপর বর্তায়।”

এই পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ওপর বিশেষ করে মার্কিন প্রেসিডেন্টসহ যুদ্ধবিরতির মধ্যস্থতাকারীদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে, যেন তারা ইসরাইলকে কোনও শর্ত বা বিধিনিষেধ ছাড়াই ত্রাণ প্রবেশের অনুমতি দিতে চাপ প্রয়োগ করেন।

গাজ্জায় মৌলিক চাহিদার তীব্র সংকট

যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়া সত্ত্বেও ইসরাইলি বিধিনিষেধের কারণে গাজ্জার অধিকাংশ মানুষ এখনো খাবার, পানি, ওষুধসহ মৌলিক প্রয়োজনীয় জিনিসের তীব্র সংকটে রয়েছেন। বিশেষ করে দুই বছরের লম্বা ইসরাইলি হামলার ফলে বহু পরিবার এখনো আশ্রয়হীন। ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় অনেকেই খোলা আকাশের নিচে দিন কাটাচ্ছেন।

গাজ্জার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, যুদ্ধবিরতির মধ্যেও ইসরাইলি হামলায় অন্তত ২২২ জন ফিলিস্তিনি নিহত এবং ৫৯৪ জন আহত হয়েছেন। আহতদের মধ্যে অনেকে চিকিৎসা সেবা পেতে বিলম্বের কারণে গুরুতর অবস্থায় আছেন।

ত্রাণ কার্যক্রমে বাধা: জাতিসংঘের সতর্কতা

জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের মুখপাত্র ফারহান হক জানিয়েছে, ইসরাইলি কর্তৃপক্ষের নির্দেশে ত্রাণ কনভয়গুলোর রুট পরিবর্তনের কারণে কার্যক্রম সীমিত হয়েছে। “কনভয়গুলোকে এখন মিসরের সীমান্তঘেঁষা ফিলাডেলফি করিডরের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তা দিয়ে যেতে হচ্ছে, যা মারাত্মক যানজট সৃষ্টি করছে,” তিনি বলেন।

ফারহান হক আরও বলেন, ত্রাণ কার্যক্রম জোরদারে অতিরিক্ত সীমান্তপথ ও অভ্যন্তরীণ রুট চালুর প্রয়োজন রয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপ না থাকলে মানবিক সংকট আরও গভীর হতে পারে।

যুদ্ধবিরতি শর্ত ভঙ্গ: ইসরাইলি হামলা অব্যাহত

রোববারও যুদ্ধবিরতির শর্ত ভঙ্গ করে ইসরাইলি সেনারা গাজ্জা উপত্যকার বিভিন্ন স্থানে হামলা চালিয়েছে। দক্ষিণাঞ্চলীয় খান ইউনিস এলাকায় বিমান, কামান ও ট্যাংকের গোলায় ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছে।

উত্তর গাজ্জার জাবালিয়া শরণার্থী শিবিরের পূর্বদিকে কয়েকটি আবাসিক ভবনও ধ্বংস করা হয়েছে। আল-জাজিরার প্রতিবেদক তারেক আবু আজজুম জানিয়েছেন, “খান ইউনিসে ড্রোন ও ভারী গোলাবর্ষণে ঘরবাড়ি এবং কৃষিজমি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। আকাশে ড্রোনের অব্যাহত উপস্থিতি ও বোমাবর্ষণের কারণে সিভিল ডিফেন্স সংস্থা অনেক ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় পৌঁছাতে পারছে না।”

মানবিক সাহায্য ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

গাজ্জার মানবিক পরিস্থিতি এতটাই সংকটাপন্ন যে জাতিসংঘ, রেড ক্রস, এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলি জরুরি ভিত্তিতে ত্রাণ সরবরাহের আহ্বান জানাচ্ছে। বিশেষ করে শিশু, মহিলা এবং প্রবীণদের জীবন রক্ষা করা আজ অবিলম্বে আন্তর্জাতিক সহায়তার ওপর নির্ভর করছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলেও ত্রাণের প্রবাহ সীমিত রাখার ফলে গাজ্জার মানুষের জন্য খাদ্য, পানি, ওষুধ এবং চিকিৎসা সেবার মৌলিক চাহিদা পূরণে বড় ধরনের সমস্যা তৈরি হচ্ছে। এর ফলে দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্য ঝুঁকি এবং শিশুদের পুষ্টিহীনতার সমস্যা আরও গভীর হচ্ছে।

গাজ্জা: ইতিহাস এবং বর্তমান প্রেক্ষাপট

গাজ্জা দীর্ঘদিন ধরে ইসরাইলি অবরোধের মধ্যে রয়েছে। সাম্প্রতিক দুই বছরের লড়াইয়ে শহরের অবকাঠামো ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিদ্যালয়, হাসপাতাল, আবাসিক ভবন, এবং কৃষিজমি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা বিপর্যস্ত।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুদ্ধবিরতির মধ্যেও ত্রাণ ও বাণিজ্যিক পণ্যের প্রবাহ নিশ্চিত না করলে গাজ্জার মানুষের মানবিক সংকট আরও ভয়াবহ আকার নিতে পারে। এটি শুধুমাত্র স্থানীয় জনগণের জন্যই নয়, বরং আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার জন্যও বড় হুমকি।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্ব

বিশ্ব সম্প্রদায় বিশেষ করে জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্রকে আরও সক্রিয়ভাবে হস্তক্ষেপ করতে হবে। ত্রাণ সরবরাহে বাধা, যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন এবং সিভিলিয়ানদের ওপর হামলা বন্ধ করা অত্যাবশ্যক। আন্তর্জাতিক আইন এবং মানবাধিকার সংক্রান্ত চুক্তি অনুযায়ী, নিরস্ত্র জনগণের জীবন এবং মৌলিক চাহিদা রক্ষা করা প্রতিটি দেশের দায়িত্ব।

বিশেষজ্ঞরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, “যদি অবরোধ এবং সীমিত ত্রাণ প্রবাহ অব্যাহত থাকে, তাহলে গাজ্জার মানুষের জন্য দীর্ঘমেয়াদী সঙ্কট তৈরি হবে। এটি শুধুমাত্র ফিলিস্তিনি জনগণের জন্য নয়, বরং মধ্যপ্রাচ্যে স্থিতিশীলতার জন্যও হুমকি।”
যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পরও গাজ্জায় ত্রাণ প্রবাহ সীমিত রাখা এবং অব্যাহত হামলায় সাধারণ মানুষকে বিপর্যস্ত করা মানবিক ও আন্তর্জাতিক আইনের কঠিন লঙ্ঘন। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অবিলম্বে হস্তক্ষেপ না হলে মানবিক বিপর্যয় আরও ভয়াবহ আকার নেবে। ২৪ লাখেরও বেশি মানুষ খাদ্য, পানি, ওষুধ এবং নিরাপদ আশ্রয়বিহীন হয়ে মানবিক সংকটে পড়েছে।

MAH – 13588 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button