বিশ্ব

সুদানে চলমান সংঘাত: গৃহযুদ্ধ, মানবিক সংকট ও আন্তর্জাতিক উদ্বেগ

Advertisement

সুদানে সেনাবাহিনী ও আধা-সামরিক বাহিনী র‍্যাপিড সাপোর্ট ফোর্স (আরএসএফ) এর মধ্যে সংঘাত চলমান। এই সংঘাতের কারণে দেশের লক্ষাধিক মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। সম্প্রতি পশ্চিম দারফুরের এল-ফাশের শহরে আরএসএফ বাহিনী দখল নেওয়ার পর সেখানে গণহত্যার অভিযোগ উঠেছে। জাতিসংঘের ভাষ্য অনুযায়ী, বর্তমানে সুদানে বিশ্বের বৃহত্তম মানবিক সংকট চলছে।

এই প্রতিবেদনে আমরা বিশ্লেষণ করেছি কেন সুদানে গৃহযুদ্ধের অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে, এর পেছনের রাজনৈতিক কারণগুলো কী, আর সাধারণ মানুষকে কীভাবে এর প্রভাব পড়েছে।

সুদানে গৃহযুদ্ধের প্রেক্ষাপট

সুদানে যে গৃহযুদ্ধ চলছে, তার মূল সূত্রপাত ঘটে ২০১৯ সালে। দীর্ঘ তিন দশক ধরে দেশের ক্ষমতায় থাকা প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশিরকে ক্ষমতাচ্যুত করার মধ্য দিয়ে এই সংকটের বীজ বোনা হয়।

১৯৮৯ সালে সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা আল-বশিরকে ২০১৯ সালে বিপুল মাত্রায় বিক্ষোভের মুখে পদচ্যুত করা হয়। সাধারণ মানুষ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে রাস্তায় নেমেছিল। সেনাবাহিনী অভ্যুত্থান করে ক্ষমতা দখল করে এবং সাময়িকভাবে বেসামরিক প্রশাসনের সঙ্গে যৌথভাবে একটি ট্রানজিশনাল সরকার গঠন করা হয়।

তবে ২০২১ সালের অক্টোবর মাসে আবারও সেনা অভ্যুত্থান ঘটে এবং দেশটিতে ক্ষমতার শীর্ষে দাঁড়ায় দুই সেনাপ্রধান:

  • জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহান – সুদানের সেনাবাহিনীর প্রধান এবং রাষ্ট্রপতি।
  • জেনারেল মোহামেদ হামদান দাগালো (হেমেডটি) – কুখ্যাত আধা-সামরিক বাহিনী আরএসএফ-এর কমান্ডার।

প্রথমদিকে তারা বন্ধু ছিলেন, ওমর আল-বশিরকে ক্ষমতাচ্যুত করতে একসাথে কাজ করেছেন। কিন্তু ভবিষ্যতের নেতৃত্ব ও রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দুই নেতা ভিন্ন মতের, যা ধীরে ধীরে সশস্ত্র সংঘাতে রূপ নেয়।

সংঘাতের মূল কারণ

প্রধান দ্বন্দ্বের কেন্দ্রবিন্দু ছিল আরএসএফ-এর সৈন্যদের সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করার প্রক্রিয়া। এই সেনাদের নিয়োগ নিয়ে দুই নেতার মধ্যে বিরোধ তৈরি হয়, কারণ এটি নতুন বাহিনীকে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা সংক্রান্ত।

এই উত্তেজনা থেকে ২০২৩ সালের এপ্রিল মাসে সংঘর্ষ শুরু হয়। সেনাবাহিনী এই সিদ্ধান্তকে হুমকি হিসেবে দেখে, এবং ১৫ এপ্রিল দুই পক্ষের মধ্যে সশস্ত্র সংঘাত শুরু হয়।

সংঘাতের শুরুতে, আরএসএফের সৈন্যরা রাজধানী খার্তুমের বড় অংশ দখল করে। দুই বছরের মধ্যে, ২০২৫ সালের মে মাসে সেনাবাহিনী আবার খার্তুমের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পায়।

আরএসএফ ও তাদের ইতিহাস

আরএসএফ বাহিনী গঠিত হয় ২০১৩ সালে। এটি মূলত জানজাওয়িদ মিলিশিয়া গ্রুপের উত্তরসূরি। এই গ্রুপ দারফুরে বিদ্রোহ দমন এবং নৃশংসতার জন্য খ্যাত ছিল।

আন্তর্জাতিক নিন্দা সত্ত্বেও, প্রেসিডেন্ট আল-বশির এই গ্রুপকে আনুষ্ঠানিকভাবে আধা-সামরিক বাহিনী হিসেবে স্বীকৃতি দেন। পরবর্তীতে আরএসএফ সদস্যরা সুদানের গোয়েন্দা সংস্থার অংশ হয়ে ওঠে। জেনারেল দাগালো বাহিনীটির নেতৃত্ব নেন এবং নিজেকে ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত করেন।

আরএসএফ বাহিনী সুদানের অভ্যন্তরীণ সংঘাত ছাড়াও ইয়েমেন ও লিবিয়ার সংঘাতে জড়িত হয়েছে। তারা দেশের কয়েকটি সোনার খনিতেও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে।

মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগও আছে। ২০১৯ সালের বিক্ষোভে ১২০ জনেরও বেশি প্রতিবাদকারীকে হত্যা করা হয়েছে।

দারফুর ও এল-ফাশের গণহত্যার অভিযোগ

দারফুরের স্থানীয় জনগণ বিশ্বাস করে যে আরএসএফ ও তাদের সহযোগী মিলিশিয়া গোষ্ঠী অঞ্চলটিকে আরব প্রধান করে তোলার চেষ্টা করছে।

জাতিসংঘ ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচের রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, শিশুদের ধর্ষণ এবং যৌন নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। এমনকি অনেকে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন।

আনুমানিকভাবে, এল-ফাশের অঞ্চলে আড়াই লাখ মানুষ এই সহিংসতার মুখোমুখি হয়েছে। এর মধ্যে অনেকেই জাতিগতভাবে আরব নয়।

সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণাধীন অঞ্চল

সুদানের উত্তর ও পূর্বাঞ্চল মূলত সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। এই অঞ্চলে মিসর তাদের সমর্থন দিচ্ছে। সেনাপ্রধান জেনারেল বুরহান পোর্ট সুদানকে প্রধান ঘাঁটি হিসেবে ঘোষণা করেছেন।

যদিও পোর্ট সুদান নিরাপদ নয়। মার্চ মাসে আরএসএফ এখানে ভয়াবহ ড্রোন হামলা চালায়। দারফুর এবং গেজিরাও সেনাবাহিনী পুনর্দখল করেছে, তবে অক্টোবরের শেষদিকে এল-ফাশের দখল আরএসএফের দিক থেকে পুনরায় ঘটে।

সুদানের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব

সুদান উত্তর-পূর্ব আফ্রিকার দেশ এবং আফ্রিকার বৃহত্তম দেশগুলোর একটি। সুদানের আয়তন প্রায় ১৯ লাখ বর্গকিলোমিটার।

সুদানের সীমান্ত সাতটি দেশের সঙ্গে সংযুক্ত এবং এটি লোহিত সাগরের সাথেও সংযোগ রাখে। নীল নদো দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় কৌশলগতভাবে সুদান গুরুত্বপূর্ণ।

জনসংখ্যার বড় অংশ মুসলিম এবং ভাষা আরবি ও ইংরেজি।

মানবিক সংকট

গৃহযুদ্ধের কারণে দেশটিতে দুর্ভিক্ষ, পানির অভাব এবং স্বাস্থ্যসেবা সংকট তৈরি হয়েছে। প্রায় এক কোটি ২০ লাখ মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছে।

সুদানের অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, রাষ্ট্রীয় আয় প্রায় ৮০ শতাংশ কমে গেছে। দেশের গড় বার্ষিক আয় প্রায় ৭৫০ ডলারের কম।

জাতিসংঘের মতে, সুদানে বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় মানবিক সংকট চলছে।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

সুদানের সংকট নিয়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা উদ্বিগ্ন। জাতিসংঘ, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এবং ইউনিসেফ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা নিয়ে তদন্ত চালাচ্ছে।

আঞ্চলিক শক্তি যেমন মিসর এবং আফ্রিকার অন্যান্য দেশ এই সংঘাতের প্রভাব মোকাবিলায় সক্রিয়ভাবে যুক্ত।

ভবিষ্যৎ

বর্তমান পরিস্থিতি সুদানের জন্য এক অস্থির সময়। আরএসএফ দেশটির বড় অংশের ওপর নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করে একটি আলাদা সরকার প্রতিষ্ঠার দাবি করছে। এর ফলে সুদানের দ্বিতীয়বার বিভাজনের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

গৃহযুদ্ধ ও মানবিক সংকট দীর্ঘ সময় ধরে চললে সুদানের অর্থনীতি, সমাজ এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের উপর গভীর প্রভাব পড়বে।

সুদান বর্তমানে রাজনৈতিক অস্থিরতা, সেনা-বাহিনী ও আধা-সামরিক বাহিনীর সংঘাত এবং মানবিক সংকটের চাপে দিশাহীন। দারফুর এবং এল-ফাশের অঞ্চলে গণহত্যার অভিযোগ, লক্ষাধিক বাস্তুচ্যুত মানুষ এবং অর্থনৈতিক দুরবস্থা দেশটিকে বৈশ্বিক মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে রাখছে।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি, স্থানীয় নেতৃত্বের সিদ্ধান্ত এবং জনগণের গণতান্ত্রিক দাবিই সুদানের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে।

MAH – 13587 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button