বিশ্ব

তুরস্ক থেকে নিজ দেশে ফিরেছেন সাড়ে পাঁচ লাখ সিরীয় শরণার্থী

Advertisement

তুরস্ক থেকে গত কয়েক মাসে সাড়ে পাঁচ লাখেরও বেশি সিরীয় শরণার্থী নিজ দেশে ফিরে গেছেন। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের পতনের পর এই প্রত্যাবর্তনের ধারা শুরু হয়। তুরস্কের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলি ইয়ারলিকায়া শনিবার (১ নভেম্বর) ইস্তাম্বুলে সাংবাদিকদের এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান।

তিনি বলেন, “বর্তমানে তুরস্কে প্রায় ২৪ লাখ সিরীয় শরণার্থী অবস্থান করছেন, যদিও কয়েক বছর আগেও এই সংখ্যা ছিল ৩৫ লাখেরও বেশি। গত এক বছরে আমরা প্রায় ৫ লাখ ৫০ হাজার শরণার্থীর স্বেচ্ছায় দেশে ফেরার বিষয়টি নিবন্ধিত করেছি।”

এই ঘোষণা তুরস্কে দীর্ঘদিন ধরে চলা শরণার্থী বিতর্কের প্রেক্ষাপটে এসেছে। দেশটিতে শরণার্থী সংখ্যা কমানো এবং সীমান্ত নিরাপত্তা জোরদার করা নিয়ে সরকারের ওপর রাজনৈতিক চাপ ক্রমেই বাড়ছিল।

সিরিয়ায় পরিবর্তনের সূচনা: আসাদ সরকারের পতনের পর নতুন অধ্যায়

গত বছরের ৮ ডিসেম্বর সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের সরকারের পতন ঘটে। প্রায় ১৩ বছর ধরে চলা ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ, আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ ও মানবিক বিপর্যয়ের পর এই পতনকে অনেকেই ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ মোড় হিসেবে দেখছেন।

আসাদ সরকারের পতনের পর দেশটির অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসন ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সহায়তায় পুনর্গঠন প্রক্রিয়া শুরু হয়। বিভিন্ন শহরে ধীরে ধীরে স্থিতিশীলতা ফিরতে শুরু করেছে। এর ফলেই শরণার্থীদের মধ্যে ফিরে যাওয়ার প্রবণতা দেখা দিয়েছে বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন।

জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) জানিয়েছে, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৫ সালের অক্টোবর পর্যন্ত প্রায় ১১ লাখ ৬০ হাজার সিরীয় নাগরিক স্বেচ্ছায় নিজ দেশে ফিরে গেছেন। এছাড়া প্রায় ১৯ লাখ মানুষ যারা দেশের ভেতরেই বাস্তুচ্যুত ছিলেন, তারাও নিজেদের ঘরে ফিরে যেতে সক্ষম হয়েছেন।

তুরস্কে শরণার্থীদের জীবন: চ্যালেঞ্জ ও সীমাবদ্ধতা

তুরস্ক ২০১১ সালে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই লাখ লাখ শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছিল। একসময় দেশটিতে ৩৫ লাখের বেশি সিরীয় শরণার্থী অবস্থান করছিলেন, যা বিশ্বের যেকোনো দেশের তুলনায় সর্বাধিক।

তবে এত বিপুল সংখ্যক শরণার্থী তুরস্কের সমাজ, অর্থনীতি এবং রাজনীতিতে গভীর প্রভাব ফেলেছে।
স্থানীয় তুর্কিদের অভিযোগ, শরণার্থীরা শ্রমবাজারে প্রতিযোগিতা বাড়িয়ে দিয়েছে, ভাড়া ও খাদ্যের দামও বেড়েছে। অপরদিকে, সিরীয়দের অভিযোগ—তারা বৈষম্য, অবহেলা ও নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন।

সম্প্রতি তুরস্কে শরণার্থীবিরোধী মনোভাব আরও তীব্র হয়ে ওঠে। বিশেষ করে অর্থনৈতিক মন্দা, মুদ্রাস্ফীতি ও বেকারত্বের কারণে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ বেড়েছে।
এরই প্রেক্ষাপটে তুরস্ক সরকার সিরীয় শরণার্থীদের স্বেচ্ছায় দেশে ফেরার প্রক্রিয়া উৎসাহিত করতে বিশেষ কর্মসূচি শুরু করে।

‘স্বেচ্ছা প্রত্যাবর্তন’ না কি গোপন চাপ?

তুর্কি সরকারের বক্তব্য অনুযায়ী, সব প্রত্যাবর্তনই “স্বেচ্ছায়” হচ্ছে। তবে মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, পরিস্থিতি এতটা সরল নয়।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (HRW) এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল একাধিক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, অনেক সিরীয় শরণার্থী তুরস্কে বাড়তি চাপ, বৈষম্য এবং নিরাপত্তা হুমকির কারণে দেশে ফিরতে বাধ্য হচ্ছেন।

ইউএনএইচসিআর-এর নিয়ম অনুযায়ী, কোনো শরণার্থীকে জোরপূর্বক তার দেশে ফেরানো যাবে না যদি সে দেশে তার নিরাপত্তা নিশ্চিত না হয়। তবে বাস্তবে, সীমান্ত এলাকায় অনেককে “স্বেচ্ছায় ফিরে যাওয়ার” কাগজে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।

সিরিয়ায় নিরাপত্তা পরিস্থিতি: এখনো অনিশ্চিত

আসাদ সরকারের পতনের পরেও সিরিয়ার বেশ কিছু অঞ্চলে এখনো সশস্ত্র সংঘাত চলছে। উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের কিছু এলাকায় বিদ্রোহী গোষ্ঠী ও কুর্দি বাহিনীর মধ্যে উত্তেজনা অব্যাহত রয়েছে।
অবকাঠামো ধ্বংস, পানীয় জলের ঘাটতি, স্বাস্থ্যসেবার সংকট এবং শিক্ষা ব্যবস্থার দুরবস্থা এখনো দেশের পুনর্গঠনের পথে বড় বাধা।

জাতিসংঘ জানিয়েছে, বর্তমানে সিরিয়ার ভেতরে প্রায় ৭০ লাখ মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত অবস্থায় আছেন এবং ৪৫ লাখেরও বেশি শরণার্থী এখনো বিদেশে, বিশেষ করে লেবানন, জর্ডান ও জার্মানিতে অবস্থান করছেন।

অর্থনীতি ও পুনর্গঠন: সামনে কঠিন পথ

সিরিয়া বর্তমানে যুদ্ধবিধ্বস্ত এক দেশ। ২০১১ সালের পর থেকে অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ অনুমান করা হয় ৪০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি।
বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশের অবকাঠামোর ৭০ শতাংশেরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়েছে।

জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আরব লিগ সিরিয়ার পুনর্গঠনে আন্তর্জাতিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তুরস্ক, কাতার ও সৌদি আরবও পুনর্গঠন তহবিলে যোগ দিতে আগ্রহ দেখিয়েছে।

তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না আসা পর্যন্ত বড় বিনিয়োগ বা উন্নয়ন প্রকল্প শুরু করা কঠিন হবে।

তুরস্কের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে শরণার্থী ইস্যু

তুরস্কের আগামী নির্বাচনের প্রাক্কালে শরণার্থী প্রশ্ন একটি বড় রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। বিরোধী দলগুলো সরকারকে সমালোচনা করে বলছে, “শরণার্থীদের উপস্থিতি দেশের অর্থনীতি ও নিরাপত্তার জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
সরকার বলছে, তারা “মানবিক ও নিরাপত্তামূলক ভারসাম্য” বজায় রেখেই পরিস্থিতি সামলাচ্ছে।

তুরস্কের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলি ইয়ারলিকায়া বলেন, “আমরা কারও প্রতি জোর প্রয়োগ করছি না। আমাদের লক্ষ্য হলো, যারা ফিরতে চান তাদের নিরাপদ প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করা।”

তবে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, তুরস্ক সরকারের ওপর অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক চাপ এতটাই বেড়েছে যে, শরণার্থীদের দ্রুত দেশে ফেরানোর নীতি এখন কার্যত এক প্রকার রাজনৈতিক কৌশলে পরিণত হয়েছে।

ফেরত আসা সিরীয়দের বাস্তব চিত্র

যেসব সিরীয় শরণার্থী ফিরে যাচ্ছেন, তাদের অনেকেই নিজেদের পুরনো বাড়িঘর ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কারণে অস্থায়ী আশ্রয়ে বসবাস করছেন। কেউ কেউ স্থানীয় প্রশাসন বা জাতিসংঘের সহায়তায় পুনর্বাসন কেন্দ্র পেয়েছেন।
কিন্তু অনেকের অভিযোগ—খাদ্য, চিকিৎসা ও কর্মসংস্থানের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই।

দামেস্কের কাছাকাছি এলাকায় ফিরে আসা এক শরণার্থী বলেন, “আমরা যুদ্ধ থেকে পালিয়েছিলাম, এখন ফিরেছি কিন্তু শান্তি পুরোপুরি ফিরেনি। তবে ঘরে ফেরার আনন্দ আলাদা।”

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা

ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জাতিসংঘ শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়া “সতর্কতার সঙ্গে” পর্যবেক্ষণ করছে। তারা বলছে, নিরাপত্তা, মানবাধিকার ও পুনর্গঠনের নিশ্চয়তা ছাড়া বড় পরিসরে প্রত্যাবর্তন ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সিরিয়ায় স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা ও পুনর্গঠন প্রক্রিয়া সফলভাবে সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত শরণার্থীদের টেকসই পুনর্বাসন সম্ভব নয়।

আশার আলোয় ফিরতি পথ

সিরীয় শরণার্থীদের দেশে ফেরার এই ধারা নিঃসন্দেহে এক আশার বার্তা বহন করে।
তবে এটি শুধুই সংখ্যার খেলা নয়—এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনের গল্প, হারানো স্বপ্ন, এবং ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা।

বিশ্ববাসী এখন তাকিয়ে আছে সিরিয়ার দিকে—এক দেশ, যে ধ্বংসস্তূপ থেকে আবারও উঠে দাঁড়াতে চায়।

MAH – 13583 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button