আফগানিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী খলিফা সিরাজউদ্দিন হক্কানী সাম্প্রতিক এক বিবৃতিতে সতর্কবার্তা দেন যে, আফগানিস্তানে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে চাওয়া যে কোনো দেশের পরিণতি হবে সোভিয়েত ইউনিয়ন, আমেরিকা ও ন্যাটোর মতো। তিনি বলেন, আফগানিস্তান কারও জন্য হুমকি নয়, কিন্তু যারা উসকানি দেবে, তাদের ওপর সমস্ত দায়ভার অর্পিত হবে।
বৃহস্পতিবার, ৩০ অক্টোবর, আফগান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে এই মন্তব্য করেন খলিফা সিরাজউদ্দিন হক্কানী। বৈঠকে দেশের নিরাপত্তা, সীমান্ত পরিস্থিতি এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে।
আফগানিস্তানের নিরাপত্তা: হুমকি নয়, প্রতিরোধ অবশ্যই
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হক্কানী বলেন, “আমরা শান্তি চাই। আফগানিস্তান কোনো দেশকে হুমকি নয়। তবে কেউ যদি আমাদের দেশে অশান্তি সৃষ্টি করতে চায়, বা কোনো উসকানি দেয়, তবে সেই দেশের ওপর পরবর্তী যে কোনো আক্রমণের সমস্ত দায়ভার অর্পিত হবে। আমাদের প্রতিরোধ ক্ষমতা দৃঢ়, এবং আমরা আমাদের সীমান্ত ও দেশের নিরাপত্তা রক্ষা করতে প্রস্তুত।”
তিনি আরও বলেন, আফগানরা শুধু যুদ্ধক্ষেত্রে শক্তিশালী নয়, কূটনীতিক ক্ষেত্রে ও আলোচনার ময়দানে সমানভাবে দক্ষ। দেশের দীর্ঘ ইতিহাসে আফগানরা বারবার প্রমাণ করেছে যে তারা যেকোনো আক্রমণ প্রতিরোধে সক্ষম এবং আলোচনার মাধ্যমে জটিল পরিস্থিতি সমাধান করতে পারে।
আফগানিস্তানের ইতিহাসে যুদ্ধ ও কূটনীতি
খলিফা সিরাজউদ্দিন হক্কানী আফগানিস্তানের বীরত্বপূর্ণ ইতিহাসের কথা স্মরণ করিয়ে দেন। তিনি বলেন, “আমাদের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত। আফগানরা শুধু তাদের ভূখণ্ড রক্ষায় নয়, আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা প্রদর্শন করেছে। আমরা শত্রুদের সঙ্গে কখনো অকারণ সংঘর্ষে লিপ্ত হইনি, কিন্তু আমাদের দেশের নিরাপত্তা রক্ষা করা আমাদের মৌলিক অধিকার।”
প্রায় দুই দশক ধরে আফগানিস্তান আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ও সামরিক সংকটের কেন্দ্রে ছিল। সোভিয়েত আক্রমণ, তালেবান প্রাধান্য, মার্কিন নেতৃত্বাধীন যুদ্ধ এবং ন্যাটো মিশন—সবই আফগানদের জীবনের গভীর প্রভাব ফেলেছে। এই প্রেক্ষাপটে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হক্কানীর মন্তব্য ছিল স্পষ্ট সতর্কবার্তা, যা বিদেশি নীতি নির্ধারকদের মনে রাখতে হবে।
পাকিস্তানি কর্মকর্তাদের সাম্প্রতিক মন্তব্যের জবাব
সম্প্রতি পাকিস্তানি কর্মকর্তারা আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে কিছু মন্তব্য করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে খলিফা সিরাজউদ্দিন হক্কানী বলেন, “প্রত্যেক দেশই তাদের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয়। কিন্তু অন্য কোনো দেশের ব্যাপারে ধারণা করার আগে যথেষ্ট সতর্ক থাকা উচিত। কোনোরকম ভুল ব্যাখ্যা বা উসকানি দেশের মধ্যে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে।”
তিনি আরও বলেন, “আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সতর্কতা, সংলাপ এবং কূটনৈতিক প্রজ্ঞা অপরিহার্য। আফগানিস্তান শান্তি এবং স্থিতিশীলতার পক্ষে কাজ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, কিন্তু কেউ যদি আমাদের স্বার্থে হস্তক্ষেপ করে, আমরা সঠিক প্রতিক্রিয়া জানাতে প্রস্তুত।”
আন্তর্জাতিক পরিপ্রেক্ষিত: আফগানিস্তানের কৌশল
আফগানিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতি আন্তর্জাতিক মহলে গুরুত্বপূর্ণ। আফগানিস্তান মধ্য এশিয়ার একটি কৌশলগত দেশ। রাশিয়া, চীন, পাকিস্তান, ইরান এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে এর সীমান্ত সংযোগ রয়েছে। তাই আফগানিস্তানের নিরাপত্তা শুধু দেশটির অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়, পুরো অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, হক্কানীর বক্তব্য শুধুমাত্র আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার প্রতিফলন নয়, এটি আন্তর্জাতিক কূটনীতির ক্ষেত্রে একটি শক্তিশালী বার্তা। তারা বলেন, “আফগানিস্তান একদিকে শান্তিপ্রিয়, কিন্তু যারা দেশটির স্বাধীনতা ও সুরক্ষাকে হুমকি জানায়, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা রাখে।”
সোভিয়েত ও মার্কিন ইতিহাসের শিক্ষা
খলিফা সিরাজউদ্দিন হক্কানীর তুলনায় যে দেশগুলো আফগানিস্তানে হস্তক্ষেপ করেছে, তারা প্রায়শই ব্যর্থ হয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৮০-এর দশকে আফগানিস্তানে প্রবেশ করেছিল, কিন্তু দেশটির সশস্ত্র প্রতিরোধ ও জঙ্গি নীতি তাদের জন্য দুর্ভোগ এবং রাজনৈতিক বিপর্যয়ের কারণ হয়। একইভাবে, মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনী দীর্ঘ ২০ বছরের উপস্থিতি সত্ত্বেও আফগানিস্তানে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয়েছে।
এই ইতিহাস থেকে হক্কানী স্পষ্ট বার্তা দেন, “যারা আফগানিস্তানে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে চায়, তারা সেই পুরনো ভুলের পুনরাবৃত্তি করবে। আফগানিস্তান প্রতিরোধে সক্ষম এবং স্বাধীনতার জন্য যে কোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে প্রস্তুত।”
আফগানিস্তানের ভবিষ্যত: শান্তি ও উন্নয়নের দিকে
আফগান সরকার দেশের নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য সচেষ্ট। খলিফা সিরাজউদ্দিন হক্কানী বলেন, “আমরা দেশের পুনর্গঠন, শিক্ষার উন্নয়ন এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে আফগানিস্তানকে শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ রাষ্ট্রে পরিণত করতে চাই। তবে দেশকে অস্থিতিশীল করার যে কোনো প্রচেষ্টা আমরা সহ্য করব না।”
আফগান জনগণের বার্তা
আফগান জনগণও শান্তিপ্রিয়। তারা চায় দেশ পুনর্গঠন হোক, শিক্ষিত প্রজন্ম গড়ে উঠুক, এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে সমন্বয় বজায় থাকুক। কিন্তু তারা শক্তি প্রদর্শনের জন্য প্রস্তুত, যদি কেউ তাদের স্বাধিকার ও স্বাধীনতাকে হুমকি দেয়।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, আফগানিস্তানের এই অবস্থান কেবল একটি রাষ্ট্রের কূটনীতির প্রকাশ নয়, এটি মধ্য এশিয়ার স্থিতিশীলতা রক্ষার এক গুরুত্বপূর্ণ সংকেত।
খলিফা সিরাজউদ্দিন হক্কানীর মন্তব্য স্পষ্টভাবে বলছে যে আফগানিস্তান শান্তি পছন্দ করে, কিন্তু স্বাধীনতা ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে আপস করবে না। যেকোনো দেশের যদি উসকানি বা হস্তক্ষেপের চেষ্টা থাকে, তাদের জন্য ফলাফল হবে ইতিমধ্যেই ইতিহাসের পৃষ্ঠায় লিপিবদ্ধ—সোভিয়েত ইউনিয়ন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটোর অভিজ্ঞতার মতো।
আফগানিস্তান বর্তমান ও ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক কূটনীতি, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রবিন্দু। দেশটি যেভাবেই অগ্রসর হোক, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে সমন্বয় এবং কূটনৈতিক প্রজ্ঞা অব্যাহত রাখাই হবে মূল চাবিকাঠি।
MAH – 13574 I Signalbd.com



