বিশ্ব

কানাডার সঙ্গে নতুন করে বাণিজ্য আলোচনায় বসবেন না ট্রাম্প

Advertisement

রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন নিয়ে উত্তেজনা, যুক্তরাষ্ট্র–কানাডা সম্পর্ক আবারও সংকটে

যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার মধ্যকার বহু দশকের স্থিতিশীল বাণিজ্য সম্পর্ক আবারও অস্থির হয়ে উঠেছে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা দিয়েছেন, তার প্রশাসন কানাডার সঙ্গে আর কোনো নতুন বাণিজ্য আলোচনায় বসবে না।

ট্রাম্পের এই ঘোষণা এসেছে একটি রাজনৈতিক বিজ্ঞাপনকে ঘিরে, যা কানাডার অন্টারিও প্রাদেশিক সরকার প্রচার করেছিল। ওই বিজ্ঞাপনে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগান–এর বক্তব্য উদ্ধৃত করা হয়, যেখানে বলা হয়েছিল— “বিদেশি পণ্যের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ বাণিজ্যযুদ্ধ সৃষ্টি করে এবং চাকরি হারানোর কারণ হয়।”

কিন্তু ট্রাম্প দাবি করেছেন, বিজ্ঞাপনটি ছিল “ভুয়া” এবং “অশোভন রাজনৈতিক প্রচারণা”।

ট্রাম্পের বক্তব্য: “আমি তাকে পছন্দ করি, কিন্তু তারা যা করেছে তা ভুল”

শুক্রবার (৩১ অক্টোবর) রাতে হোয়াইট হাউসে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় ট্রাম্প বলেন, “কানাডার প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নি আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে ক্ষমা চেয়েছেন, তবে এখন আর আলোচনা শুরু হবে না। আমি তাকে অনেক পছন্দ করি, কিন্তু তারা যা করেছে, তা ভুল ছিল। ওই বিজ্ঞাপনটি সত্যের বিকৃতি ঘটিয়েছে।”

আল জাজিরা, বিবিসি, ও সিএনএন-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ট্রাম্প প্রশাসন মনে করছে— এই বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে কানাডা অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সুবিধা নিতে চাইছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক নীতিকে ‘বিকৃতভাবে উপস্থাপন’ করেছে।

প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নির দপ্তর অবশ্য বিষয়টি নিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো মন্তব্য করেনি।

রিগানের পুরোনো ভাষণ নিয়ে ‘বিতর্কিত বিজ্ঞাপন’

বিতর্কের সূত্রপাত ঘটে যখন অন্টারিও প্রাদেশিক সরকার একটি রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন প্রকাশ করে, যেখানে ১৯৮০–এর দশকে রিগানের দেওয়া এক ভাষণের অংশ কেটে প্রচার করা হয়।

বিজ্ঞাপনটিতে রিগানের কণ্ঠে বলা হয়— “যখন সরকার বিদেশি পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপ করে, তখন তা শেষ পর্যন্ত সাধারণ আমেরিকানদের ক্ষতি করে।”

ট্রাম্প প্রশাসনের দাবি, বিজ্ঞাপনটি এমনভাবে সম্পাদনা করা হয়েছিল যেন মনে হয় রিগান সরাসরি ট্রাম্পের বর্তমান নীতির বিরোধিতা করছেন।

অন্টারিওর প্রিমিয়ার ডগ ফোর্ড পরে জানান, “আমরা বিজ্ঞাপনটি স্থগিত করেছি, কারণ এটি ভুলভাবে ব্যাখ্যা হতে পারে। আমাদের লক্ষ্য ছিল দুই দেশের আলোচনাকে উৎসাহিত করা, বিতর্ক সৃষ্টি করা নয়।”

কানাডার অবস্থান: “আমরা আলোচনা চালিয়ে যেতে প্রস্তুত”

বিতর্কের মাঝেই কানাডার প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নি জানিয়েছেন, “আমরা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় বসতে প্রস্তুত। আমাদের দুই দেশের সম্পর্ক দীর্ঘদিনের, এবং এই সম্পর্ককে রাজনৈতিক প্রচারণা দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত করা উচিত নয়।”

তিনি আরও বলেন, “রিগান যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের একজন শ্রদ্ধাভাজন প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তার বক্তব্যের একটি অংশ আমাদের বিজ্ঞাপনে ব্যবহার করা হয়েছে, কিন্তু উদ্দেশ্য ছিল ইতিবাচক বার্তা দেওয়া।”

তবে ট্রাম্পের প্রশাসন বলছে, এই ঘটনার পর দুই দেশের মধ্যে বিশ্বাসের সম্পর্ক “গভীরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত” হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র–কানাডা বাণিজ্য সম্পর্ক: এক নজরে

ঐতিহাসিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রই কানাডার সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার।

  • কানাডার মোট রপ্তানির ৭৫ শতাংশেরও বেশি যায় যুক্তরাষ্ট্রে।
  • বছরে দুই দেশের বাণিজ্যিক লেনদেনের পরিমাণ প্রায় ৮০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার
  • প্রধান রপ্তানি পণ্য: তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস, গাড়ি, যন্ত্রপাতি, কাঠ ও কৃষিপণ্য।

২০১৮ সালে ট্রাম্প প্রশাসনের সময় থেকেই দুই দেশের মধ্যে শুল্কনীতি ও বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে টানাপোড়েন চলছে। সেই সময় তিনি NAFTA (North American Free Trade Agreement) বাতিল করে USMCA (United States–Mexico–Canada Agreement) চালু করেন।

তবে অনেক বিশ্লেষকের মতে, সেই চুক্তিও আজ আবার ঝুঁকির মুখে।

নতুন শুল্কের ঘোষণা: আবারও বাণিজ্যযুদ্ধের আশঙ্কা

বিতর্কিত বিজ্ঞাপনের পর ট্রাম্প প্রশাসন কানাডার পণ্যে অতিরিক্ত ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছে।

হোয়াইট হাউসের অর্থনৈতিক উপদেষ্টারা জানিয়েছেন, “কানাডা যদি যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করে, তাহলে এর জবাব দেওয়া হবে।”

এই ঘোষণার পর কানাডার ব্যবসায়ী মহলে তীব্র উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। কানাডিয়ান চেম্বার অব কমার্স এক বিবৃতিতে বলেছে— “নতুন শুল্ক আরোপ উভয় দেশের ব্যবসায়িক স্থিতিশীলতা নষ্ট করবে এবং মূল্যস্ফীতি আরও বাড়াবে।”

অর্থনীতিবিদদের বিশ্লেষণ: “রাজনৈতিক ইস্যুতে অর্থনীতি জিম্মি”

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, রিগানের বক্তব্য নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক আসলে অর্থনৈতিক সম্পর্কের মূল জায়গা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিচ্ছে।

টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতিবিদ ড. র‍্যাচেল বয়েড বলেন, “এই বিজ্ঞাপন মূলত একটি রাজনৈতিক কৌশল ছিল, কিন্তু তা এখন দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক আস্থার সংকট তৈরি করেছে।”

ওয়াশিংটনভিত্তিক থিংকট্যাঙ্ক ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশন জানিয়েছে, “ট্রাম্পের নতুন শুল্কনীতি কেবল কানাডাকেই নয়, বরং উত্তর আমেরিকার উৎপাদনশীলতাকেও ক্ষতিগ্রস্ত করবে।”

ট্রাম্প প্রশাসনের অবস্থান: “আমেরিকা প্রথম”

ট্রাম্প আবারও তার পুরোনো নীতি ‘America First’–এর কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “আমরা আমাদের দেশের কর্মসংস্থান ও শিল্প রক্ষা করতে চাই। যদি কেউ আমাদের বিরুদ্ধে অন্যায় করে, তবে তার জবাব আমরা দেবই।”

তিনি আরও যোগ করেন, “আমরা কানাডার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে চাই, কিন্তু সেটি হতে হবে সম্মানের ভিত্তিতে, অপপ্রচার নয়।”

কানাডার ভেতরে প্রতিক্রিয়া

কানাডার মূলধারার সংবাদমাধ্যমগুলো ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তকে “কঠোর ও অপ্রত্যাশিত” বলে মন্তব্য করেছে।

দ্য গ্লোব অ্যান্ড মেইল লিখেছে, “ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত দুই দেশের সীমান্ত বাণিজ্যে অনিশ্চয়তা তৈরি করবে।”
সিবিসি নিউজ জানিয়েছে, “এই উত্তেজনার ফলে কানাডিয়ান ডলার সাময়িকভাবে মার্কিন ডলারের বিপরীতে দুর্বল হয়েছে।”

কানাডার বিরোধীদলীয় নেতা পিটার ম্যাককলে বলেছেন, “একটি বিজ্ঞাপনকে কেন্দ্র করে যদি কূটনৈতিক সম্পর্ক নষ্ট হয়, তবে সেটি কোনো দেশের জন্যই মঙ্গলজনক নয়।”

ভবিষ্যতের পথ কোথায়?

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ট্রাম্পের এই ঘোষণা দুই দেশের সম্পর্কের ওপর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলতে পারে।
বিশেষ করে, ২০২৬ সালে যখন USMCA চুক্তির পুনঃমূল্যায়ন হওয়ার কথা, তখন এই উত্তেজনা পুনরায় আলোচনাকে কঠিন করে তুলবে।

ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল এক বিশ্লেষণে বলেছে, “ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত কেবল একটি বিজ্ঞাপন নিয়ে নয়, বরং এটি তার কঠোর জাতীয়তাবাদী অর্থনৈতিক নীতির অংশ।”

রাজনৈতিক বার্তা না কূটনৈতিক সংকেত?

এই পুরো ঘটনাটি আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এখন বড় আলোচনার বিষয়। কেউ বলছেন, এটি ট্রাম্পের কৌশলগত বার্তা— “আমেরিকা কোনো দেশের কাছ থেকে অপমান মেনে নেবে না।”
অন্যদিকে অনেকে মনে করছেন, এটি নির্বাচনের আগের একটি রাজনৈতিক স্টান্ট, যা দিয়ে তিনি দেশীয় ভোটারদের আকৃষ্ট করতে চান।

যা–ই হোক না কেন, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা— দুই প্রতিবেশী ও অর্থনৈতিক অংশীদারের সম্পর্ক আবারও এক নতুন সংকটে পড়েছে।

বিশ্বের বাণিজ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, “যদি এই উত্তেজনা দীর্ঘায়িত হয়, তবে উত্তর আমেরিকার অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।”


যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা দিয়েছেন, কানাডার সঙ্গে নতুন করে বাণিজ্য আলোচনা শুরু হবে না। কানাডার একটি রাজনৈতিক বিজ্ঞাপনে রোনাল্ড রিগানের পুরোনো বক্তব্য ব্যবহারে ক্ষুব্ধ হন ট্রাম্প। এই ঘটনার পর দুই দেশের সম্পর্ক আবারও টানাপোড়েনে, এবং অর্থনীতিবিদরা বলছেন— উত্তর আমেরিকার অর্থনীতি বড় সংকটে পড়তে পারে।

MAH – 13565 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button