ভারতে আবারও উঠেছে দেশপ্রেম ও রাষ্ট্রদ্রোহের জটিল বিতর্ক। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অমর সৃষ্টি “আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি” গানটি গাওয়াকে কেন্দ্র করে উত্তাল হয়ে উঠেছে আসাম রাজ্য। এই গানটি গাওয়ার দায়ে এবার দেশদ্রোহ মামলার মুখে পড়ছেন কংগ্রেস সেবাদলের এক প্রবীণ কর্মী—বিদ্যুৎ ভূষণ দাস (বয়স ৭৪)।
বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত “আমার সোনার বাংলা” ভারতের ভূখণ্ডে গাওয়ার বিষয়টিকে দেশদ্রোহী কর্মকাণ্ড হিসেবে বিবেচনা করেছেন আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা। তিনি পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছেন, ওই ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে দ্রুত মামলা রুজু করে গ্রেফতার করতে।
ঘটনার সূচনা: করিমগঞ্জের এক সাধারণ বৈঠক থেকে দেশজোড়া বিতর্ক
ঘটনাটি ঘটেছে আসামের করিমগঞ্জ জেলার শ্রীভূমি শহরে। গত সোমবার (২৭ অক্টোবর) স্থানীয় কংগ্রেস সেবাদলের এক সভায় বিদ্যুৎ ভূষণ দাস রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা গান “আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি” পরিবেশন করেন।
এই গানের সঙ্গে বাঙালির গভীর আবেগ জড়িত থাকলেও ভারতের রাজনৈতিক পরিসরে বিষয়টি অন্য অর্থে দেখা হচ্ছে। কারণ, গানটি বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে স্বীকৃত।
সভায় উপস্থিত কয়েকজন বিজেপি–সমর্থক স্থানীয় ব্যক্তি ওই ঘটনার ভিডিও ধারণ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেন। মুহূর্তেই তা ভাইরাল হয়। এরপর রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা নিজেই বিষয়টি নজরে আনেন এবং কড়া অবস্থান নেন।
মুখ্যমন্ত্রীর কড়া হুঁশিয়ারি: “এটি দেশের মর্যাদার বিরুদ্ধে”
বুধবার (২৯ অক্টোবর) গৌহাটিতে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মুখ্যমন্ত্রী বলেন—
“ভারতের মাটিতে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত গাওয়া কোনোভাবেই দেশপ্রেমের পরিচায়ক নয়। এটি দেশের মর্যাদার পরিপন্থী কাজ। যারা এমন অপরাধ করেছে, তাদের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহের মামলা রুজু করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আইন অনুযায়ী তাদের গ্রেফতার করা হবে।”
তার এই বক্তব্য ছড়িয়ে পড়ার পরই সারা ভারতে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়। অনেকেই মনে করছেন, এটি রাজনৈতিক প্রতিহিংসারই একটি রূপ; আবার কেউ কেউ বলছেন, দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য এমন কঠোর পদক্ষেপ প্রয়োজন।
বিপাকে পড়েছেন বিদ্যুৎ ভূষণ দাস ও স্থানীয় কংগ্রেস নেতারা
এই ঘটনার পর থেকেই কংগ্রেস সেবাদলের প্রবীণ নেতা বিদ্যুৎ ভূষণ দাসের বাড়ির সামনে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। স্থানীয় কংগ্রেসের কয়েকজন নেতাকেও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করা হয়েছে।
বিদ্যুৎ ভূষণ দাস স্থানীয়ভাবে একজন সংস্কৃতিমনা মানুষ হিসেবে পরিচিত। দীর্ঘদিন ধরে তিনি রবীন্দ্রসংগীত ও দেশাত্মবোধক গানের আয়োজন করে আসছেন। তাঁর পরিবারের দাবি, তিনি কখনও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে গান গাওয়ার কাজ করেননি।
তাঁর পুত্র সুশান্ত দাস গণমাধ্যমকে বলেন—
“বাবা একজন গায়ক, তিনি রবীন্দ্রসংগীত ভালোবাসেন। ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি গেয়েছেন শিল্পী হিসেবে, দেশবিরোধী মানসিকতা থেকে নয়। এখন যেভাবে তাঁকে অভিযুক্ত করা হচ্ছে, তা একেবারেই অমানবিক।”
কংগ্রেসের প্রতিক্রিয়া: “গান নয়, সরকার ভয় পাচ্ছে প্রতিবাদের সুরে”
অন্যদিকে আসাম রাজ্য কংগ্রেসের সভাপতি ভূপেন বরা বলেছেন—
“হিমন্ত বিশ্বশর্মা নিজের ব্যর্থতা আড়াল করতে এসব ইস্যু তৈরি করছেন। ‘আমার সোনার বাংলা’ শুধু বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত নয়, এটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা, যিনি ভারতবর্ষের গর্ব। তাঁর গানকে দেশদ্রোহ বলা মানে ভারতের সংস্কৃতিকে অপমান করা।”
তিনি আরও যোগ করেন, “এটি আসলে কণ্ঠরোধের রাজনীতি। গান গাওয়ার স্বাধীনতাকেও এখন অপরাধ বানানো হচ্ছে।”
রবীন্দ্রসংগীতের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন “আমার সোনার বাংলা”। গানটি মূলত ভারতীয় বাঙালিদের ঐক্যের আহ্বান হিসেবে রচিত হয়। পরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর ১৯৭১ সালে এটি বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে গ্রহণ করা হয়।
তবে গানটির উৎস ও ভাবধারা মূলত ভারতীয় মাটিতে বাঙালি জাতির দেশপ্রেম থেকেই উদ্ভূত। তাই ভারতের বহু বাঙালি আজও এই গান গেয়ে থাকেন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বা স্কুল–কলেজে।
সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব বিশিষ্ট অধ্যাপক গৌতম রায় বলেন—
“এই গান দুই বাংলার আবেগের সেতুবন্ধন। এটিকে দেশদ্রোহ বলা মানে ইতিহাসের অস্বীকার করা। এটি রাজনীতির নয়, সংস্কৃতির বিষয়।”
আইন বিশেষজ্ঞদের মতামত: “দেশদ্রোহের অভিযোগের ভিত্তি দুর্বল”
আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারতের সংবিধান অনুযায়ী, দেশদ্রোহ (Sedition) বলতে বোঝায়—রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সহিংসতা উস্কে দেওয়া, সরকারের পতন ঘটানোর ষড়যন্ত্র বা সংবিধানবিরোধী কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকা।
একটি গান গাওয়া, বিশেষত যখন তা কোনো প্রতিবাদ বা ষড়যন্ত্রমূলক প্রেক্ষাপটে নয়, তখন সেটি দেশদ্রোহ হিসেবে গণ্য করা যায় না।
দিল্লি হাই কোর্টের আইনজীবী প্রণব মুখার্জি বলেন—
“এই মামলায় দেশদ্রোহের ধারা প্রয়োগ হলে তা আইনগতভাবে টিকবে না। কারণ এতে রাষ্ট্রবিরোধী কোনো কর্মকাণ্ডের উপাদান নেই।”
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঝড়
এই ঘটনার পর থেকেই টুইটার (এক্স), ফেসবুক ও ইউটিউবজুড়ে #AmarSonarBangla এবং #Rabindranath হ্যাশট্যাগে হাজারো পোস্ট এসেছে। অনেক ভারতীয় নাগরিক মুখ্যমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছেন।
বাংলাদেশের সামাজিক মাধ্যমে বিষয়টি নিয়েও তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। অনেকেই বলেছেন, রবীন্দ্রনাথ দুই বাংলার যৌথ ঐতিহ্য—তাঁর গানকে রাজনৈতিক রঙে দেখা দুঃখজনক।
ভারতের বিখ্যাত সংগীত পরিচালক শান্তনু মোয়িত্র বলেন—
“যিনি ভারতের জাতীয় সংগীত ‘জন গণ মন’ রচনা করেছেন, তাঁর আরেকটি গান গাওয়া কীভাবে দেশদ্রোহ হতে পারে? এটা সাংস্কৃতিক সংকীর্ণতার পরিচায়ক।”
দুই বাংলার সাংস্কৃতিক সম্পর্কের ছায়া
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এমন এক সাহিত্যিক, যিনি ভারত ও বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐক্যের প্রতীক। তাঁর রচনাই দুই দেশের মানুষকে একই সুরে বাঁধে।
বাংলাদেশে জাতীয় সংগীত “আমার সোনার বাংলা”, আর ভারতে জাতীয় সংগীত “জন গণ মন”—দুটি গানই তাঁর সৃষ্টি।
তাই অনেক বিশ্লেষক বলছেন, রাজনৈতিক কারণে তাঁর গানের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া দুই দেশের সম্পর্কেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক নাসির উদ্দিন বলেন—
“এই ঘটনা দক্ষিণ এশিয়ার সাংস্কৃতিক ঐক্যকে প্রশ্নের মুখে ফেলে। ভারতের মতো বৃহৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে একটি গান গাওয়াকে যদি অপরাধ বলা হয়, তবে সেটি মুক্তচিন্তার জন্য বিপজ্জনক দৃষ্টান্ত।”
আসাম রাজ্যের রাজনীতি ও জাতীয়তাবাদী তীব্রতা
হিমন্ত বিশ্বশর্মা ক্ষমতায় আসার পর থেকেই আসামে জাতীয়তাবাদী রাজনীতির প্রবণতা বেড়েছে। রাজ্যে দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশ, নাগরিকপঞ্জি (NRC) ও ধর্মীয় রাজনীতি নিয়ে বিতর্ক চলছেই।
রাজনীতিবিদদের মতে, এই ঘটনার মাধ্যমে বিজেপি সরকার আবারও জাতীয়তাবাদকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে।
সাংবাদিক অরুণাভ দত্ত লিখেছেন—
“আসামে ভোটের রাজনীতি এখন ধর্ম ও জাতীয়তাবাদের ঘূর্ণিপাকে। এমন সময় একটি গানকে কেন্দ্র করে দেশপ্রেমের মাপকাঠি বানানো, আসলে জনমত নিয়ন্ত্রণের কৌশল।”
জনগণের প্রশ্ন: গান গাওয়া কি সত্যিই অপরাধ?
এই ঘটনার পর সাধারণ মানুষও প্রশ্ন তুলছেন—একজন প্রবীণ মানুষ যদি রবীন্দ্রসংগীত গেয়ে থাকেন, তবে তা কি সত্যিই দেশদ্রোহ হতে পারে?
গুয়াহাটির কলেজছাত্রী তনুশ্রী চক্রবর্তী বলেন—
“আমরা ছোটবেলায় স্কুলে এই গান শিখেছি। এটি তো আমাদের সংস্কৃতির অংশ। এখন যদি সেটিকেও নিষিদ্ধ করা হয়, তাহলে শিল্প ও স্বাধীনতার জায়গাটা কোথায়?”
বাংলাদেশের প্রতিক্রিয়া: “রবীন্দ্রনাথ সীমান্তের নয়, মানবতার কবি”
বাংলাদেশের সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী জানিয়েছেন,
“রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দুই বাংলার গর্ব। তাঁর গান, কবিতা, সাহিত্য আমাদের মানবতার শিক্ষা দেয়। কোনো রাজনৈতিক অবস্থান তাঁর সৃষ্টিকে সীমাবদ্ধ করতে পারে না।”
এছাড়া বাংলাদেশের সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারীরাও জানিয়েছেন, তাঁরা ভারতের এই ঘটনাকে হতাশাজনক মনে করছেন। অনেকেই বলেছেন, “রবীন্দ্রনাথ কারও সম্পত্তি নয়, তিনি সমগ্র বাঙালি জাতির।”
“আমার সোনার বাংলা” শুধু একটি গান নয়, এটি বাঙালির আত্মপরিচয়ের প্রতীক।
ভারতের একটি অংশে সেই গান গাওয়াকে দেশদ্রোহ বলা—সংস্কৃতি ও রাজনীতির মধ্যে ক্রমবর্ধমান দূরত্বের প্রমাণ।
বস্তুত, যখন একটি সমাজ শিল্পকে রাজনৈতিক দৃষ্টিতে বিচার করতে শুরু করে, তখন তা সভ্যতার পরিপক্বতার প্রশ্ন তোলে।
বিশ্ব এখন সংলাপ, সংস্কৃতি ও সহাবস্থানের সময় পার করছে। এই প্রেক্ষাপটে রবীন্দ্রনাথের গান নিষিদ্ধ বা অপরাধ ঘোষণার মতো সিদ্ধান্ত শুধু বিতর্কই নয়, বরং ইতিহাসের প্রতি এক প্রকার অসম্মান।
MAH – 13564 I Signalbd.com



