ভারতের রাজধানী দিল্লিতে সম্প্রতি ‘ক্লাউড সিডিং‘ বা কৃত্রিম বৃষ্টি ঝরানোর একটি পরীক্ষা চালানো হয়েছে। কোটি টাকা ব্যয় করে চালানো এই উদ্যোগে বহু প্রতীক্ষিত বৃষ্টি না হওয়ায় নগরবাসী এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা হতাশ। দিল্লির আকাশে আর্দ্রতার কম উপস্থিতি এবং শীতকালীন শুষ্ক আবহাওয়া এই পরীক্ষাকে সফল হতে বাধা দিয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলেন, পরীক্ষাটি থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে, যা ভবিষ্যতের জন্য সহায়ক হতে পারে।
ক্লাউড সিডিং কি এবং কেন করা হলো
ক্লাউড সিডিং হলো একটি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি, যার মাধ্যমে মেঘের ওপর রাসায়নিক পদার্থ স্প্রে করে বৃষ্টি তৈরি করা হয়। সাধারণত উড়োজাহাজ থেকে সিলভার আয়োডাইড বা অনুরূপ পদার্থ মেঘে ছিটানো হয়। এই পদার্থ বাতাসে থাকা জলীয় বাষ্পকে ঘনীভূত করে পানির ফোঁটায় পরিণত করে, যা মাটিতে ঝরে আসে।
দিল্লির জন্য এই পদ্ধতি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ কারণ শহরের বায়ুদূষণ খুবই উচ্চমাত্রার। বৃষ্টি নামালে আকাশ পরিষ্কার হয় এবং PM 2.5 ও PM 10 কণার ঘনত্ব কমে যায়। এজন্য বিজেপি সরকার গত ৭ মে এই প্রকল্প অনুমোদন করে এবং ৩ কোটি ২১ লাখ রুপি বরাদ্দ দেয়।
পরীক্ষার বিস্তারিত
মঙ্গলবার দিল্লিতে দুটি পৃথক ধাপে প্রথম ক্লাউড সিডিং পরীক্ষা সম্পন্ন হয়। আইআইটি কানপুরের সঙ্গে যৌথভাবে পরিচালিত এই প্রকল্পের লক্ষ্য ছিল শহরের আকাশে কৃত্রিম বৃষ্টি ঘটানো। তবে আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যমতে, শেষ রাত পর্যন্ত দিল্লিতে কোথাও বৃষ্টিপাত হয়নি।
আইআইটি কানপুরের পরিচালক মনীন্দ্র আগরওয়াল বলেন, “আমরা মেঘে যথেষ্ট আর্দ্রতা পাইনি। মাত্র ১০ থেকে ১৫ শতাংশ আর্দ্রতা ছিল, যা ক্লাউড সিডিংয়ের জন্য আদর্শ নয়। তাই বৃষ্টি নামানো সম্ভব হয়নি।”
তবে তিনি জানান, পরীক্ষায় কিছু ইতিবাচক প্রভাব দেখা গেছে। বাতাসে ভাসমান কণার ঘনত্ব ৬–১০ শতাংশ কমেছে। এটি প্রমাণ করে যে, আর্দ্রতা কম হলেও কিছু মাত্রায় ক্লাউড সিডিং কার্যকর হতে পারে।
রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া
বৃষ্টি না হওয়ায় দিল্লির রাজনৈতিক দলগুলি কটাক্ষ করেছে। বিরোধী দল আম আদমি পার্টি (আপ) বলেছে, “শহরে বৃষ্টি হবে কি না, তা নিশ্চিত করতে কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। কিন্তু ফলাফল শূন্য।” সাবেক নেতা সৌরভ ভরদ্বাজ বলেছেন, “এটি শুধুমাত্র ব্যয়বহুল নয়, বরং নাগরিকদের আস্থা নষ্ট করার মতো উদ্যোগ।”
সরকার পক্ষ বলেছে, এটি একটি পরীক্ষামূলক প্রকল্প, এবং ভবিষ্যতে আরও উপযুক্ত আবহাওয়ায় সাফল্য আসতে পারে। তবে রাজনৈতিক চাপ এবং জনমতের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য বিষয়টি বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে আছে।
আবহাওয়া ও প্রাকৃতিক চ্যালেঞ্জ
শীতকালে দিল্লির আবহাওয়া সাধারণত খুব শুষ্ক থাকে। বাতাসে আর্দ্রতা কম থাকায় বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা সীমিত। আইআইটি দিল্লির সহকারী অধ্যাপক শাহজাদ গনি বলেছেন, “শীতকালে আর্দ্রতার অভাব বৃষ্টির জন্য প্রধান প্রতিবন্ধক।”
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ক্লাউড সিডিং যে কোনো শহরের দূষণ মোকাবিলার স্থায়ী সমাধান নয়। শহরের পরিবহন, বিদ্যুৎ এবং নির্মাণ খাত থেকে নির্গমন কমানোই বায়ুর মান উন্নত করার দীর্ঘমেয়াদী পথ।
বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ
সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টের (সিএসই) নির্বাহী পরিচালক অনুমিতা রায়চৌধুরী বলেন, “দিল্লিতে ক্লাউড সিডিংয়ের পরও উল্লেখযোগ্য বৃষ্টি হয়নি। বৃষ্টির পর দূষণ কিছুটা কমলেও, দ্রুতই পুনরায় বৃদ্ধি পায়।”
থিঙ্কট্যাঙ্ক এনভিরোক্যাটালিস্টসের প্রতিষ্ঠাতা সুনীল দাহিয়া বলেন, “দূষণ মোকাবিলার জন্য প্রাকৃতিক এবং মানবসৃষ্ট পদ্ধতি একসাথে প্রয়োগ করতে হবে। শুধু ক্লাউড সিডিং করলেই কার্যকর হবে না।”
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
পরীক্ষার মাধ্যমে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করা গেছে। পরবর্তী ধাপ হিসেবে উচিৎ, আবহাওয়ার পরিস্থিতি অনুযায়ী আরও পরীক্ষা করা এবং অন্যান্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ নীতিও কার্যকর করা। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ক্লাউড সিডিং কার্যকর হতে গেলে নিয়মিত ও পরিকল্পিতভাবে এটি করতে হবে, অন্যথায় ব্যয়বহুল প্রকল্প হিসেবে পরিচিত হবে।
দিল্লিতে কোটি টাকার ক্লাউড সিডিং পরীক্ষা বৃষ্টিপাত আনতে ব্যর্থ হয়েছে। যদিও আর্দ্রতার অভাব মূল প্রতিবন্ধক, তবুও কিছু ইতিবাচক প্রভাব দেখা গেছে। রাজনৈতিক চাপ এবং জনমতের দৃষ্টি আকর্ষণের কারণে বিষয়টি বিতর্কিত। ভবিষ্যতে কার্যকরতার জন্য আরও পরিকল্পিত ও প্রযুক্তিগত পরীক্ষা প্রয়োজন।
এম আর এম – ২০০৩,Signalbd.com



