মধ্যপ্রাচ্যে নতুন যুদ্ধের আশঙ্কা, উত্তপ্ত লেবানন সীমান্তে বাড়ছে উত্তেজনা
মধ্যপ্রাচ্যে আবারও বড় ধরণের যুদ্ধের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। লেবাননের সশস্ত্র সংগঠন হিজবুল্লাহর সাথে সম্ভাব্য সংঘাতের প্রস্তুতি নিচ্ছে ইসরাইলের সেনাবাহিনী (IDF)। সাম্প্রতিক দিনগুলোতে ইসরাইলি সামরিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের বক্তব্য এবং সীমান্ত এলাকায় সেনা সমাবেশ দেখে বিশ্লেষকরা বলছেন—যেকোনো মুহূর্তে ইসরাইল-হিজবুল্লাহ যুদ্ধ শুরু হতে পারে।
মঙ্গলবার (২৮ অক্টোবর) আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম মিডল ইস্ট মনিটর এবং আল জাজিরাসহ একাধিক সূত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ইসরাইলি গণমাধ্যমগুলো এখন সরব হিজবুল্লাহর সাথে সম্ভাব্য পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে যাওয়ার খবর নিয়ে।
উত্তর সীমান্তে ইসরাইলের সামরিক প্রস্তুতি জোরদার
ইসরাইলের উত্তরাঞ্চলীয় সীমান্তে, বিশেষ করে গ্যালিলি ও গোলান হাইটস অঞ্চলে, সেনা মোতায়েন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ইসরাইলি সেনারা বলছে, তারা “উত্তর ফ্রন্টে বৃহৎ আকারের সামরিক অভিযানের জন্য প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে।”
ইসরাইল আর্মি রেডিও–র এক প্রতিবেদনে সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ সূত্রের বরাত দিয়ে বলা হয়, হিজবুল্লাহর “কৌশলগত স্থাপনাগুলো ও নেতৃত্বকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা” হবে আসন্ন অভিযানের প্রধান উদ্দেশ্য। ইসরাইলি কর্মকর্তারা দাবি করেছেন, “হিজবুল্লাহকে একবারে দুর্বল করতে হলে তাদের নেতৃত্ব কাঠামো ধ্বংস করতে হবে।”
তবে ইসরাইলের পক্ষ থেকে এখনও কোনো আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ ঘোষণা দেওয়া হয়নি। সামরিক সূত্রগুলো বলছে, সীমান্ত পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে “যেকোনো মুহূর্তে” অভিযান শুরু হতে পারে।
ভঙ্গুর যুদ্ধবিরতির মাঝেও চলেছে সংঘর্ষ
২০২৪ সালের নভেম্বর মাসে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ইসরাইল ও হিজবুল্লাহর মধ্যে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। কিন্তু সেই যুদ্ধবিরতি এখন কার্যত নামেমাত্র টিকে আছে।
দক্ষিণ লেবাননের মারজাউন, নাবতিয়া, এবং বেকা উপত্যকা এলাকায় প্রায় প্রতিদিনই ইসরাইলি ড্রোনের নজরদারি এবং সীমিত হামলার খবর পাওয়া যাচ্ছে। ইসরাইল বলছে, এসব হামলা “নিরাপত্তা অভিযানের” অংশ এবং যুদ্ধবিরতির লঙ্ঘন নয়। কিন্তু লেবানন সরকার এবং হিজবুল্লাহ উভয়েই একে “উস্কানিমূলক আগ্রাসন” হিসেবে দেখছে।
হিজবুল্লাহর পাল্টা প্রস্তুতি
লেবাননের অন্যতম প্রভাবশালী সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহও নীরব নেই। তারা সীমান্তজুড়ে নতুন করে অবস্থান পুনর্বিন্যাস করছে এবং প্রতিরোধ ব্যবস্থা জোরদার করছে।
সংগঠনটির মহাসচিব হাসান নাসরুল্লাহ সম্প্রতি এক টেলিভিশন ভাষণে বলেন,
“ইসরাইল যদি লেবাননের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করে, তবে তার জবাব দেওয়া হবে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে কঠোরভাবে।”
নাসরুল্লাহ দাবি করেন, হিজবুল্লাহর হাতে এখন আগের চেয়ে উন্নতমানের রকেট ও ড্রোন প্রযুক্তি রয়েছে, যা ইসরাইলের অভ্যন্তরে গভীর পর্যন্ত হামলা চালাতে সক্ষম।
ইসরাইলের লক্ষ্য: হিজবুল্লাহর সামরিক ক্ষমতা ধ্বংস
ইসরাইলি নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করছেন, তেল আবিব সরকার হিজবুল্লাহকে “আগেভাগে দুর্বল করে” ভবিষ্যৎ যুদ্ধক্ষেত্রে নিজেদের সুবিধা নিশ্চিত করতে চায়।
ইসরাইলি সেনাবাহিনীর এক মুখপাত্র বলেন,
“আমাদের লক্ষ্য হিজবুল্লাহকে এমন অবস্থায় নিয়ে যাওয়া, যাতে তারা আগামী কয়েক বছর কোনো বড় ধরনের সামরিক অভিযান পরিচালনা করতে না পারে।”
সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে ইসরাইলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সীমান্ত এলাকায় বায়ু প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা (Iron Dome) এবং নতুন David’s Sling interceptor স্থাপন করেছে। পাশাপাশি, হাজার হাজার রিজার্ভ সেনাকে ডাকা হয়েছে।
লেবাননের রাজনৈতিক সংকটের মাঝে নতুন হুমকি
লেবানন বর্তমানে ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটে আছে। দেশটির মুদ্রার মান অব্যাহতভাবে পতন হচ্ছে, বেকারত্ব বেড়েছে, এবং খাদ্যদ্রব্যের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে।
এই সংকটের মাঝেই যদি ইসরাইল-হিজবুল্লাহ যুদ্ধ শুরু হয়, তবে দেশটির অবকাঠামো ও অর্থনীতি ধ্বংসের মুখে পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
লেবাননের সাবেক প্রধানমন্ত্রী সাআদ হারিরি এক বিবৃতিতে বলেন,
“লেবানন আরেকটি যুদ্ধ সহ্য করার মতো অবস্থায় নেই। হিজবুল্লাহকে সংযম দেখাতে হবে, এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ইসরাইলের আগ্রাসন থামাতে হবে।”
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
জাতিসংঘ (UN) ইতোমধ্যেই সীমান্তের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। UNIFIL (United Nations Interim Force in Lebanon) জানিয়েছে, উভয় পক্ষকে যুদ্ধবিরতি রক্ষা করতে এবং “অতিরিক্ত উত্তেজনা সৃষ্টি না করতে” আহ্বান জানানো হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্স, যারা লেবাননে শান্তিরক্ষী বাহিনীর প্রধান সহায়তাকারী, তারা বলছে—যেকোনো বড় ধরনের সংঘাত “পুরো মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলবে।”
হোয়াইট হাউসের এক মুখপাত্র বলেন,
“আমরা ইসরাইলের আত্মরক্ষার অধিকারকে সম্মান করি, তবে আমরা একইসাথে লেবাননের সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকার আহ্বান জানাই।”
অন্যদিকে, ইরান, সিরিয়া এবং ইয়েমেনের হুথি গোষ্ঠী ইসরাইলের কর্মকাণ্ডের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। তারা হিজবুল্লাহর প্রতি “সংহতি ও সহায়তা” অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতামত: আসন্ন যুদ্ধ কি অনিবার্য?
মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিশ্লেষকরা মনে করেন, বর্তমান পরিস্থিতি “১৯৮২ সালের ইসরাইল-লেবানন যুদ্ধের মতোই উত্তেজনাপূর্ণ।”
জেরুজালেমভিত্তিক সামরিক বিশ্লেষক মাইকেল হারারি বলেন,
“ইসরাইল মনে করছে, এখনই সময় হিজবুল্লাহর ওপর আঘাত হানার, কারণ তাদের মনোযোগ বর্তমানে গাজা ও পশ্চিম তীরের সংঘাতের দিকে ছড়িয়ে আছে।”
অন্যদিকে, বৈরুত বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ রিমা ফারহাত বলেন,
“হিজবুল্লাহ এখন আগের চেয়ে বেশি সংগঠিত ও প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত। ইসরাইল যদি পূর্ণাঙ্গ হামলা চালায়, তাহলে তার প্রতিক্রিয়া হবে ভয়াবহ।”
পূর্বের সংঘাতের স্মৃতি
ইসরাইল ও হিজবুল্লাহর মধ্যে সর্বশেষ বড় যুদ্ধ হয়েছিল ২০০৬ সালে। সেই যুদ্ধ টানা ৩৪ দিন স্থায়ী ছিল। প্রায় ১,২০০ লেবানিজ ও ১৬৫ ইসরাইলি নিহত হন। বৈরুত, টাইর ও সাইদার মতো শহরগুলো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল।
আজও লেবাননের জনগণ সেই যুদ্ধের ক্ষত বহন করে চলেছে। বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন, যদি ২০২৫ সালে নতুন করে যুদ্ধ শুরু হয়, তবে সেটি আগের চেয়েও ভয়াবহ হবে—কারণ উভয় পক্ষের অস্ত্রভাণ্ডার এখন অনেক বেশি আধুনিক ও বিধ্বংসী।
ভবিষ্যতের সম্ভাবনা
বর্তমানে ইসরাইল গাজার যুদ্ধ, পশ্চিম তীরের অস্থিরতা, এবং অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সরকার অভ্যন্তরীণ সমালোচনার মুখে পড়েছে। অনেকেই মনে করছেন, হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে সম্ভাব্য অভিযান হতে পারে “রাজনৈতিক চাপ সরানোর” একটি কৌশল।
তবে আন্তর্জাতিক কূটনীতিকরা সতর্ক করেছেন—এমন একটি যুদ্ধ শুরু হলে তা শুধুমাত্র লেবানন ও ইসরাইল নয়, বরং পুরো মধ্যপ্রাচ্যকে অগ্নিগর্ভ করে তুলবে।
ইসরাইল ও হিজবুল্লাহর সম্পর্কের ইতিহাস মূলত সংঘাত, প্রতিশোধ ও পারস্পরিক অবিশ্বাসে ভরা। বর্তমানে উভয় পক্ষের বক্তব্য ও প্রস্তুতি দেখে মনে হচ্ছে, যুদ্ধ যেন কেবল সময়ের অপেক্ষা।
মধ্যপ্রাচ্যের মানুষের প্রত্যাশা—দু’পক্ষই শেষ মুহূর্তে সংযম দেখাবে এবং কূটনৈতিক পথে সমাধানের দিকে এগিয়ে যাবে। কিন্তু বাস্তবতা বলছে, উত্তর সীমান্তে যুদ্ধের মেঘ ক্রমেই ঘনীভূত হচ্ছে।
MAH – 13542 I Signalbd.com



