ক্যারিবীয় সাগরের নীল জলরাশিতে আবারও রক্ত ঝরল। কথিত মাদকবিরোধী অভিযানের নামে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী দুটি নৌযানে হামলা চালিয়েছে। এতে অন্তত ১৪ জন নিহত হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে স্থানীয় গণমাধ্যম ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো।
ঘটনাটি ঘটেছে স্থানীয় সময় সোমবার রাতে, ক্যারিবীয় অঞ্চলের পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরীয় অংশে। হামলার ভিডিও প্রকাশ করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ, যা এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে।
মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দাবি
ভিডিওতে প্রতিরক্ষামন্ত্রী হেগসেথ দাবি করেন,
“আমাদের সেনারা মাদকবাহী দুটি নৌযান শনাক্ত করে অভিযান চালিয়েছে। সেখানকার অপরাধীরা পালানোর চেষ্টা করলে আত্মরক্ষার্থে গুলি চালানো হয়। এতে মাদক পাচারকারীরা নিহত হয়।”
তবে আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা রয়টার্স এবং অ্যালজাজিরা জানিয়েছে, মার্কিন বাহিনী এখন পর্যন্ত কোনো নির্ভরযোগ্য প্রমাণ দেখাতে পারেনি যে, নিহতরা মাদক পাচারকারীর সঙ্গে যুক্ত ছিল।
মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রীর প্রকাশিত ভিডিওতে নৌযান দুটির ধ্বংসাবশেষ দেখা গেলেও, নিহতদের পরিচয় বা মাদক উদ্ধার সংক্রান্ত কোনো তথ্য প্রকাশ করা হয়নি।
একজন জীবিত উদ্ধার, হস্তান্তর মেক্সিকোকে
হামলায় প্রাণে বেঁচে যান মাত্র একজন ব্যক্তি। মার্কিন কর্মকর্তারা জানান, আহত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে এবং পরে মেক্সিকো সরকারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
মেক্সিকো সরকার এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে ওই ব্যক্তির নাম বা নাগরিকত্ব প্রকাশ করেনি। তবে স্থানীয় সূত্রের বরাত দিয়ে জানা গেছে, তিনি মধ্য আমেরিকার কোনো দেশের নাগরিক হতে পারেন।
অতীতেও এমন হামলার নজির
এটি কোনো একক ঘটনা নয়। গত তিন মাসে ক্যারিবীয় অঞ্চলে অন্তত ১০টি অনুরূপ হামলা চালিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। প্রতিবারই “মাদক পাচার রোধের অভিযান” দাবি করা হলেও, কোনো নির্দিষ্ট প্রমাণ হাজির করতে পারেনি ওয়াশিংটন।
এমনকি জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনও সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, মার্কিন বাহিনীর এসব তথাকথিত অভিযান অনেক ক্ষেত্রেই “অবৈধ সামরিক আগ্রাসন” হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
ক্যারিবীয় দ্বীপ রাষ্ট্র সেন্ট লুসিয়া, জ্যামাইকা ও ডোমিনিকা ইতিমধ্যে এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তা কাউন্সিলের জরুরি বৈঠক আহ্বানের দাবি জানিয়েছে।
ক্যারিবীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতি
ক্যারিবীয় অঞ্চল দীর্ঘদিন ধরেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত নজরদারির আওতায়। যুক্তরাষ্ট্র দাবি করে, এই অঞ্চলের জলপথ মাদক পাচারের প্রধান রুটগুলোর একটি।
১৯৮০-এর দশকে “War on Drugs” বা “মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ” নীতির অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ক্যারিবীয় ও ল্যাটিন আমেরিকায় ব্যাপক সামরিক অভিযান শুরু করে।
কিন্তু আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই নীতি মূলত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব বিস্তারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। মাদকবিরোধী অভিযানের আড়ালে মার্কিন সামরিক শক্তি অঞ্চলটিতে আধিপত্য বিস্তার করছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তীব্র নিন্দা
ঘটনার পরপরই আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচ যুক্তরাষ্ট্রের এই হামলার কঠোর নিন্দা জানিয়েছে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে,
“কোনো রাষ্ট্রই অন্য দেশের জলসীমায় বিনা অনুমতিতে হামলা চালাতে পারে না। যদি যুক্তরাষ্ট্রের দাবি সত্যও হয়, তা হলেও নিহতদের পরিচয় ও ঘটনার স্বচ্ছ তদন্ত প্রকাশ করা জরুরি।”
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ আরও বলেছে,
“মাদকবিরোধী অভিযানের নামে নিরীহ জেলেদের হত্যা করা মানবাধিকার লঙ্ঘনের সামিল। যুক্তরাষ্ট্রের এসব কার্যক্রম আন্তর্জাতিক আইন পরিপন্থী।”
জাতিসংঘের প্রতিক্রিয়া
জাতিসংঘ মহাসচিবের মুখপাত্র স্টেফান দ্যুজারিক এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন,
“জাতিসংঘ এই ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্তের আহ্বান জানাচ্ছে। সব দেশকেই আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলতে হবে।”
এছাড়া জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে ভেনেজুয়েলা, কিউবা, এবং নিকারাগুয়া এই ঘটনার ওপর বিশেষ আলোচনার দাবি তুলেছে। তাদের অভিযোগ, যুক্তরাষ্ট্রের এসব হামলা মূলত অঞ্চলটিতে “রাজনৈতিক ভয় প্রদর্শন”।
ক্যারিবীয় জনগণের ক্ষোভ
ক্যারিবীয় অঞ্চলের সাধারণ মানুষ এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হাজারো পোস্টে মানুষ যুক্তরাষ্ট্রের নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছে।
একজন স্থানীয় নাগরিক লিখেছেন,
“আমরা সমুদ্রে মাছ ধরতে যাই, মাদক নয়। কিন্তু মার্কিন ড্রোন বা যুদ্ধজাহাজের কারণে প্রতিদিন জীবন নিয়ে ভয় পাই।”
অন্যদিকে ক্যারিবীয় সাংবাদিক লুইস ফার্নান্দেজ টুইটারে লেখেন,
“যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতি, সেখানেই রক্তপাত। তারা কখনো ন্যায়বিচারের জন্য যুদ্ধ করে না; করে কৌশলগত নিয়ন্ত্রণের জন্য।”
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষণ: বাস্তব লক্ষ্য কী?
বিভিন্ন বিশ্লেষক মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্রের এসব অভিযান আসলে ভূ-রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের অংশ।
ক্যারিবীয় অঞ্চল হলো ভেনেজুয়েলা ও কিউবার নিকটবর্তী কৌশলগত এলাকা। যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরেই এই অঞ্চলকে তার প্রভাব বলয়ের মধ্যে রাখতে চায়।
বিশ্লেষক মার্ক হেনরি বলেন,
“মাদকবিরোধী অভিযান একটি অজুহাত মাত্র। যুক্তরাষ্ট্রের প্রকৃত লক্ষ্য হচ্ছে সামুদ্রিক রুটগুলোর নিয়ন্ত্রণ নেওয়া, যাতে ল্যাটিন আমেরিকার তেল ও প্রাকৃতিক সম্পদ পরিবহনে তাদের প্রভাব বজায় থাকে।”
কিউবা ও ভেনেজুয়েলার প্রতিক্রিয়া
কিউবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে,
“এই হামলা আন্তর্জাতিক আইন ও রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের চরম লঙ্ঘন। যুক্তরাষ্ট্রের এই আগ্রাসী আচরণ পুরো ক্যারিবীয় অঞ্চলের শান্তিকে বিপন্ন করছে।”
ভেনেজুয়েলা সরকারও এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, তারা এই ঘটনার তীব্র নিন্দা করছে এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের পাশে থাকার ঘোষণা দিয়েছে।
ভেনেজুয়েলার পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন,
“আমরা মনে করি, যুক্তরাষ্ট্রের এসব পদক্ষেপ একটি বড় আঞ্চলিক যুদ্ধের পূর্বাভাস হতে পারে।”
মার্কিন অভ্যন্তরে বিভক্ত মতামত
যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরেও এই হামলা নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে।
ওয়াশিংটনের কয়েকজন কংগ্রেস সদস্য বলেছেন, এসব সামরিক অভিযান স্বচ্ছ নয় এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
ডেমোক্র্যাট সিনেটর এলিজাবেথ ওয়ারেন মন্তব্য করেছেন,
“আমরা বিশ্বের পুলিশ হতে পারি না। যদি সত্যিই মাদকবিরোধী অভিযান চালানো হয়, তবে তা আইনি কাঠামোর মধ্যে হতে হবে।”
অন্যদিকে রিপাবলিকান নেতারা বলছেন,
“যতক্ষণ পর্যন্ত এটি যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তার স্বার্থে, ততক্ষণ এমন অভিযান অব্যাহত রাখা উচিত।”
ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ও ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা
হামলার পর ক্যারিবীয় দেশগুলোর মধ্যে ভয় এবং ক্ষোভ বেড়েছে। স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, অনেক জেলে ও ছোট নৌযান মালিক এখন সমুদ্রে যেতে ভয় পাচ্ছেন।
এদিকে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা আশঙ্কা করছেন, এমন ঘটনা বারবার ঘটলে অঞ্চলটিতে আঞ্চলিক সশস্ত্র সংঘাতের সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে।
একই সঙ্গে মার্কিন প্রশাসনের বিরুদ্ধে মামলা ও আন্তর্জাতিক তদন্তের দাবিও উঠছে।
ক্যারিবীয় সাগরে সাম্প্রতিক এই হামলা আবারও তুলে ধরেছে যুক্তরাষ্ট্রের মাদকবিরোধী নীতির বিতর্কিত চরিত্র।
প্রশ্ন এখন একটাই — এটি কি সত্যিই অপরাধ দমন, নাকি নতুন ধরনের আধিপত্যের রাজনীতি?
এই প্রশ্নের উত্তর হয়তো আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই পরিষ্কার হবে, যখন আন্তর্জাতিক তদন্ত শুরু হবে।
তবে একথা নিশ্চিত — ক্যারিবীয় সাগরের বুকে নিহত সেই ১৪ জনের রক্ত শুধু সমুদ্রের জলে মিশে যাবে না; তা হয়তো একদিন বিশ্বরাজনীতির নতুন অধ্যায় লিখবে।
MAH – 13540 I Signalbd.com



