মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দক্ষিণ কোরিয়া সফরের ঠিক মধ্যেই ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রের নতুন পরীক্ষা চালিয়েছে উত্তর কোরিয়া। দেশটির পশ্চিম উপকূলে এই ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের ঘটনা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নতুন করে উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে।
খবর আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা রয়টার্স এবং এএফপি।
উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা কেসিএনএ জানায়, পশ্চিম উপকূলের একটি সামরিক ঘাঁটি থেকে একাধিক দূরপাল্লার ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ করা হয়। এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলো প্রায় দুই ঘণ্টা আকাশে উড়ে চলার পর ইয়েলো সাগরে (পশ্চিম সাগর) স্থির করা লক্ষ্যবস্তুতে নির্ভুলভাবে আঘাত হানে।
উত্তর কোরিয়ার সামরিক কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে কেসিএনএ আরও জানায়, এই পরীক্ষা মূলত তাদের কৌশলগত অস্ত্রের নির্ভরযোগ্যতা যাচাই এবং সামরিক সক্ষমতা প্রদর্শনের অংশ হিসেবে চালানো হয়েছে।
ক্ষেপণাস্ত্রের ধরন ও উদ্দেশ্য
বিশ্লেষকদের মতে, উত্তর কোরিয়া এবার যে ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছে, তা সম্ভবত তাদের উন্নতমানের “হাওসং-১০” বা “পুলহাওং সিরিজের” অংশ হতে পারে। এই ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র নিম্ন উচ্চতায় উড়ে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করতে সক্ষম, যা শনাক্ত করা তুলনামূলকভাবে কঠিন।
প্রতিটি ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লা প্রায় ১৫০০ কিলোমিটার, যা দক্ষিণ কোরিয়ার যেকোনো সামরিক স্থাপনা এমনকি জাপানের কিছু অংশেও আঘাত হানতে সক্ষম বলে ধারণা করা হচ্ছে।
উত্তর কোরিয়া বলছে, এটি ছিল “একটি কৌশলগত প্রতিরক্ষা মহড়া,” তবে দক্ষিণ কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র এই ঘটনাকে “সরাসরি উস্কানি” হিসেবে দেখছে।
ট্রাম্পের সফরের সময় কেন এই পরীক্ষা?
ট্রাম্প দক্ষিণ কোরিয়ায় পৌঁছান বুধবার সকালে। সিউলের রাষ্ট্রপতি ভবনে তাকে দেওয়া হয় লাল গালিচা সংবর্ধনা, যেখানে উপস্থিত ছিলেন দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট ইউন সুক ইয়োল। দুই নেতার বৈঠকে মূল আলোচ্য বিষয় ছিল উত্তর কোরিয়ার পরমাণু কর্মসূচি এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তা জোরদার করা।
কিন্তু এই বৈঠকের মধ্যেই পিয়ংইয়ংয়ের ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ— বিষয়টি শুধু কোরীয় উপদ্বীপ নয়, গোটা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নতুন করে নিরাপত্তা উদ্বেগ তৈরি করেছে।
বিশ্লেষকদের মতে, ট্রাম্পের উপস্থিতির সময়েই এমন পরীক্ষা চালিয়ে উত্তর কোরিয়া একটি রাজনৈতিক বার্তা দিতে চেয়েছে— “তাদের সামরিক অবস্থান নিয়ে কোনো ছাড় দেবে না”।
দক্ষিণ কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া
দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানায়, তারা ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণের বিষয়টি রাডার ও স্যাটেলাইটের মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করেছে। বর্তমানে দক্ষিণ কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ সামরিক গোয়েন্দা দল পুরো ঘটনাটি বিশ্লেষণ করছে।
দক্ষিণ কোরিয়ার জয়েন্ট চিফ অব স্টাফ (জেসিএস) এক বিবৃতিতে বলেন—
“উত্তর কোরিয়ার এমন আচরণ আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য মারাত্মক হুমকি। আমরা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছি এবং যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রস্তুত।”
অন্যদিকে, হোয়াইট হাউস থেকে জানানো হয়, ওয়াশিংটন এই ঘটনাকে “উস্কানিমূলক ও দায়িত্বজ্ঞানহীন” বলে অভিহিত করেছে। মার্কিন প্রশাসনের এক মুখপাত্র বলেন—
“উত্তর কোরিয়ার এই পরীক্ষা কোরীয় উপদ্বীপের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে ঝুঁকিতে ফেলছে। আমরা দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের সঙ্গে একত্রে কাজ করছি।”
উত্তর কোরিয়ার অবস্থান
উত্তর কোরিয়ার পক্ষ থেকে জানানো হয়, তাদের এই ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা কোনো দেশের বিরুদ্ধে নয়, বরং এটি ছিল প্রতিরক্ষা প্রস্তুতির অংশ। রাষ্ট্রীয় বার্তায় বলা হয়—
“আমাদের সামরিক শক্তি কারও বিরুদ্ধে নয়, বরং আমাদের সার্বভৌমত্ব ও শান্তি রক্ষার জন্যই।”
তবে একই সঙ্গে তারা স্পষ্ট করে জানায় যে, যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা যদি উত্তর কোরিয়ার ওপর অর্থনৈতিক বা সামরিক চাপ বাড়ায়, তাহলে তারা আরও “শক্তিশালী প্রতিক্রিয়া” জানাবে।
বিশ্লেষণ: নতুন করে উত্তপ্ত উপদ্বীপ
কোরীয় উপদ্বীপে বহু বছর ধরেই উত্তেজনা বিদ্যমান। কিন্তু ২০২৫ সালে এসে পরিস্থিতি আবারও তীব্র আকার ধারণ করেছে। চলতি বছরে উত্তর কোরিয়া অন্তত ১৫ বারের বেশি ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালিয়েছে, যা ২০১৭ সালের পর সর্বাধিক।
এই ঘটনার পেছনে দুটি বড় উদ্দেশ্য বিশ্লেষকরা চিহ্নিত করেছেন—
১. দেশের অভ্যন্তরে নেতৃত্বকে শক্ত করা:
কিম জং উনের নেতৃত্বে উত্তর কোরিয়া বর্তমানে কঠিন অর্থনৈতিক সংকটে রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞার কারণে তাদের অর্থনীতি ধীরে ধীরে স্থবির হয়ে পড়ছে। এই অবস্থায় সামরিক শক্তি প্রদর্শন দেশের জনগণের মধ্যে জাতীয়তাবোধ জাগাতে সহায়তা করে।
২. আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে মনোযোগ আকর্ষণ:
যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া যখন যৌথ প্রতিরক্ষা জোট নিয়ে ব্যস্ত, তখন উত্তর কোরিয়া দেখাতে চায় যে তারা এখনও প্রভাবশালী ও ভয়ঙ্কর প্রতিপক্ষ।
বিশ্ব নেতাদের প্রতিক্রিয়া
জাপান ঘটনাটিকে “অসহনীয় উস্কানি” বলে নিন্দা জানিয়েছে।
জাপানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেন—
“এই পরীক্ষায় আমাদের নাগরিকদের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছে। আমরা যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে যৌথভাবে পরবর্তী পদক্ষেপ নেব।”
চীন, যাকে সাধারণত উত্তর কোরিয়ার ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে দেখা হয়, বিষয়টিতে সতর্ক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। বেইজিংয়ের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে—
“আমরা সব পক্ষকে সংযম দেখানোর আহ্বান জানাচ্ছি। কোরীয় উপদ্বীপে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখা জরুরি।”
অন্যদিকে রাশিয়া বলেছে, যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ কোরিয়ার সামরিক মহড়া উত্তর কোরিয়াকে উস্কানি দিচ্ছে। মস্কো মনে করে, “দুই পক্ষকেই সংলাপে ফিরতে হবে”।
আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে নতুন চ্যালেঞ্জ
উত্তর কোরিয়ার এই সাম্প্রতিক পরীক্ষা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি বড় কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। ট্রাম্প প্রশাসন ২০২৫ সালের শুরু থেকে উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে “শর্তহীন আলোচনা” শুরু করতে চেয়েছিল। কিন্তু এখন সেই আলোচনার সম্ভাবনা প্রায় শূন্যে নেমে এসেছে।
দক্ষিণ কোরিয়া সরকারও এখন দ্বিধার মধ্যে— একদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নিরাপত্তা জোট বজায় রাখতে চায়, অন্যদিকে উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে সংঘাত বাড়াতে চায় না।
সামনের দিনগুলো
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা কেবল একদিনের ঘটনা নয়, বরং এটি একটি বড় রাজনৈতিক বার্তার অংশ। উত্তর কোরিয়া এখন এমন এক অবস্থানে পৌঁছেছে যেখানে তারা আলোচনার পরিবর্তে শক্তি প্রদর্শনে বেশি আগ্রহী।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ড. মিন হো-জুং বলেন—
“ট্রাম্পের সফরের সময় ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা করে কিম জং উন আসলে দেখাতে চেয়েছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র বা দক্ষিণ কোরিয়া যেভাবেই এগোতে চাইুক না কেন, পিয়ংইয়ং তার নিজস্ব পথে এগিয়ে যাবে।”
ডোনাল্ড ট্রাম্পের দক্ষিণ কোরিয়া সফরের দিনেই উত্তর কোরিয়া পশ্চিম উপকূলে ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালিয়েছে। দুই ঘণ্টার বেশি সময় উড়ে ক্ষেপণাস্ত্রগুলো ইয়েলো সাগরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানে। উত্তর কোরিয়া বলছে এটি প্রতিরক্ষামূলক পদক্ষেপ, তবে যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ কোরিয়া একে উস্কানিমূলক হিসেবে দেখছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কোরীয় উপদ্বীপে নতুন করে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে।
MAH – 13532 I Signalbd.com



