বিশ্ব

এক মাসে ১.১৭ কোটি মুসল্লির ওমরাহ পালন, সৌদি আরবে রেকর্ড।

Advertisement

বিশ্বজুড়ে মুসলিমদের জন্য পবিত্র মক্কা-মদিনা হলো আত্মার প্রশান্তির কেন্দ্র। আর সেই আধ্যাত্মিক কেন্দ্রেই সম্প্রতি ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন কোটি কোটি মুসল্লি। হিজরি বর্ষের রবিউস সানি মাসে সৌদি আরবে ওমরাহ পালন করেছেন ১ কোটি ১৭ লাখেরও বেশি মুসল্লি—যা সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যা বলে জানিয়েছে সৌদি কর্তৃপক্ষ।

ওমরাহ পালনে অভূতপূর্ব ভিড়

সৌদি আরবের হজ ও ওমরাহ মন্ত্রণালয় এবং মসজিদুল হারাম ও মসজিদে নববীর সাধারণ কর্তৃপক্ষ (General Presidency for the Affairs of the Two Holy Mosques) এর যৌথ পরিসংখ্যান অনুসারে, এ এক মাসেই শুধু বিদেশি মুসল্লির সংখ্যা পেরিয়েছে ১৫ লাখেরও বেশি
বিশ্বের প্রায় ১৮০টিরও বেশি দেশ থেকে মুসলমানরা এসেছেন মক্কা-মদিনার পবিত্র ভূমিতে ইবাদত ও তাওয়াফে অংশ নিতে।

সৌদি গেজেট, আরব নিউজসহ মধ্যপ্রাচ্যের একাধিক সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, এবারের রেকর্ড সংখ্যক মুসল্লি আগমন সৌদি সরকারের উন্নত ব্যবস্থাপনা, আধুনিক অবকাঠামো ও ডিজিটাল সেবার সফল ফল।

ডিজিটাল প্রযুক্তিতে সহজতর ওমরাহ যাত্রা

সৌদি সরকারের হজ ও ওমরাহ মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য অনুযায়ী, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ওমরাহ ব্যবস্থাপনা পুরোপুরি ডিজিটালাইজড করা হয়েছে।
বিদেশি মুসল্লিরা এখন অনলাইনে সহজেই—

  • ওমরাহ ভিসার আবেদন করতে পারেন,
  • ফ্লাইট ও আবাসন বুক করতে পারেন,
  • এমনকি মসজিদুল হারামে নামাজের সময়সূচি পর্যন্ত আগেই জানতে পারেন।

নুসুক (Nusuk) অ্যাপ” নামের সরকারি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে ওমরাহ যাত্রীদের সব সেবা এক জায়গায় পাওয়া যাচ্ছে। এতে ভিসা অনুমোদন, হোটেল বুকিং, পরিবহন ও গাইড সেবা পাওয়া যাচ্ছে মাত্র কয়েক মিনিটে।

মন্ত্রণালয়ের ভাষায়, “আগে যেখানে একটি আবেদন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে কয়েকদিন লাগত, এখন সেটি সম্ভব হচ্ছে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই।”

ভিশন ২০৩০–এর অংশ হিসেবে আধ্যাত্মিক সেবার উন্নয়ন

সৌদি আরবের “ভিশন ২০৩০” কর্মপরিকল্পনায় ধর্মীয় পর্যটন উন্নয়ন একটি প্রধান লক্ষ্য।
এই উদ্যোগের মাধ্যমে সৌদি সরকার চায়—প্রতি বছর আরও বেশি মুসলিম যেন সহজে দুই পবিত্র মসজিদ পরিদর্শন করতে পারেন, একই সঙ্গে ওমরাহ ও হজ পালনে পান সর্বোচ্চ আরাম, নিরাপত্তা ও মানসিক প্রশান্তি।

সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী—

  • ২০৩০ সালের মধ্যে বছরে ৩ কোটি ওমরাহযাত্রীকে সেবা দেওয়ার প্রস্তুতি চলছে।
  • হজ মৌসুমে প্রায় ৫০ লাখ হাজি অংশ নিতে পারবেন।
  • মক্কা ও মদিনার অবকাঠামো, হোটেল, পরিবহন ও যোগাযোগব্যবস্থায় চলছে ব্যাপক উন্নয়ন।

পবিত্র দুই মসজিদের সম্প্রসারণ ও নতুন অবকাঠামো

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সৌদি সরকার মসজিদুল হারাম (মক্কা) ও মসজিদে নববী (মদিনা)–তে বিশাল সম্প্রসারণ প্রকল্প হাতে নিয়েছে।
এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য—

  • মসজিদুল হারামে নতুন ছাদ ও শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত প্রার্থনা এলাকা।
  • স্মার্ট হুইলচেয়ার সার্ভিস, যেখানে অ্যাপের মাধ্যমে ভাড়া ও ফেরত দেওয়া যায়।
  • নতুন ট্রাম ও বাস সার্ভিস, যা জেদ্দা বিমানবন্দর থেকে সরাসরি মক্কা ও মদিনায় যাত্রী পরিবহন করছে।
  • মক্কার চারপাশে আধুনিক হোটেল ও রেস্তোরাঁ চেইন গড়ে তোলা হচ্ছে, যেখানে একসঙ্গে লাখো মুসল্লি থাকতে পারেন।

নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থায় নজিরবিহীন প্রস্তুতি

এই বিপুল সংখ্যক মুসল্লির আগমন ঘিরে সৌদি কর্তৃপক্ষ নিয়েছে কঠোর নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থা।
দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ২৪ ঘণ্টা দায়িত্ব পালন করছে দশ সহস্রাধিক নিরাপত্তা কর্মকর্তা, পুলিশ ও স্বাস্থ্যকর্মী।
এছাড়া, মক্কা ও মদিনায় স্থাপন করা হয়েছে বিশেষ জরুরি মেডিক্যাল সেন্টার ও মোবাইল ক্লিনিক, যাতে মুসল্লিরা যেকোনো স্বাস্থ্য সমস্যায় তাৎক্ষণিক সেবা পান।

২০২০ সালের করোনা মহামারির সময় যেখানে সীমিত সংখ্যক ওমরাহ অনুমতি দেওয়া হয়েছিল, এখন পরিস্থিতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক এবং আগের চেয়ে নিরাপদ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, “সৌদি সরকার স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তায় যে মাত্রায় গুরুত্ব দিচ্ছে, তা ইসলামী বিশ্বের জন্য অনুকরণীয় উদাহরণ।”

ওমরাহ যাত্রায় অর্থনৈতিক প্রভাব

ওমরাহ শুধু ধর্মীয় আয়োজন নয়—এটি সৌদি আরবের অর্থনীতিরও একটি বড় অংশ।
বিশেষজ্ঞদের হিসেবে, ধর্মীয় পর্যটন খাত থেকে সৌদি আরবের বার্ষিক আয় প্রায় ১২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
ভিশন ২০৩০ বাস্তবায়নের মাধ্যমে এই আয় বাড়িয়ে ২০৩০ সালের মধ্যে ৫০ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত নিয়ে যেতে চায় দেশটি।

নতুন হোটেল, পরিবহন, খাদ্য সরবরাহ ও বাণিজ্যিক সেবার কারণে স্থানীয় অর্থনীতিতে কর্মসংস্থানও বেড়েছে।
সৌদি আরবের মক্কা অঞ্চলে এখন প্রতিদিন হাজার হাজার নতুন চাকরি তৈরি হচ্ছে—বিশেষ করে হোটেল ম্যানেজমেন্ট, গাইড সার্ভিস ও অনলাইন টেক সাপোর্ট খাতে।

বিশ্ব মুসলিমদের আধ্যাত্মিক ঐক্যের প্রতিচ্ছবি

১ কোটি ১৭ লাখ মুসল্লির এই অংশগ্রহণ শুধুমাত্র একটি সংখ্যা নয়—এটি বিশ্ব মুসলিম সমাজের ঐক্য, বিশ্বাস ও আধ্যাত্মিক সংযোগের প্রতীক।
মক্কা-মদিনায় আগত মুসল্লিরা বলেছেন, “এখানে এসে মনে হয়েছে, আমরা সবাই এক উম্মাহ, এক বিশ্বাসে যুক্ত।”

বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, মিশর, ভারত, তুরস্ক, নাইজেরিয়া, মালয়েশিয়া, ইউরোপ ও আমেরিকা থেকেও বিপুল সংখ্যক মুসল্লি এবার ওমরাহ পালন করেছেন।
বাংলাদেশ থেকে এক মাসে গেছেন প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার মুসল্লি, যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ৩০ শতাংশ বেশি।

বাংলাদেশি মুসল্লিদের অভিজ্ঞতা

ওমরাহ শেষে মক্কা থেকে এক বাংলাদেশি হাজি মো. আব্দুল হামিদ বলেন,
“আগে ভিসা ও যাত্রা নিয়ে অনেক দুশ্চিন্তা থাকত। এখন অনলাইনেই সব কিছু সহজভাবে করা যায়। মক্কায় এসে সেবাও অনেক উন্নত মনে হয়েছে। সরকার যে পরিবর্তন এনেছে, তা সত্যিই প্রশংসনীয়।”

অন্যদিকে, ঢাকার হজ ট্রাভেল এজেন্সিগুলোর তথ্য অনুযায়ী, এখন বাংলাদেশের মুসল্লিরা নিজেরাই অনলাইনে ওমরাহ বুকিং করতে পারছেন, যার ফলে মধ্যস্বত্বভোগীদের নির্ভরতা কমছে এবং খরচও হ্রাস পেয়েছে।

ইসলামি বিশ্বের প্রতিক্রিয়া

বিশ্ব মুসলিম নেতারা ও ইসলামি সংগঠনগুলো সৌদি সরকারের এই উন্নয়নমূলক উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন।
তারা বলেছেন, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে ধর্মীয় সেবাকে সহজলভ্য করার এই প্রচেষ্টা ইসলামি ঐক্যের প্রতীক এবং ভবিষ্যতের জন্য অনুপ্রেরণাদায়ক।

ওআইসি (Organization of Islamic Cooperation) এক বিবৃতিতে বলেছে,
“সৌদি আরবের নেতৃত্বে পবিত্র দুই মসজিদের সেবায় যে উন্নয়ন ঘটছে, তা মুসলিম বিশ্বের জন্য এক মহান অবদান।”

ওমরাহ ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত, যা সারাবছরই পালন করা যায়।
কিন্তু ২০২৫ সালের এই রেকর্ড সংখ্যক ওমরাহ পালন প্রমাণ করে—বিশ্ব মুসলমানদের ঈমান, ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধন আজও কতটা শক্তিশালী।

সৌদি সরকারের আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি, প্রযুক্তিগত অগ্রগতি ও আধ্যাত্মিক সেবার উন্নয়ন ভবিষ্যতে এই সংখ্যা আরও বাড়াবে বলে আশা করছে সবাই।
এক কথায় বলা যায়—
“মক্কা-মদিনা এখন আগের চেয়ে আরও কাছে, আরও সহজ, আরও আলোকিত।”

MAH – 13522 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button