বিশ্বজুড়ে মন্দা, ব্যয় সংকোচন আর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উত্থানে বিপাকে বিশ্বের অন্যতম বড় ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান অ্যামাজন। ৩০ হাজার কর্মী ছাঁটাইয়ের ঘোষণা বিশ্বব্যাপী কর্পোরেট দুনিয়ায় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু।
বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ই-কমার্স কোম্পানি অ্যামাজন আবারও বড় আকারের কর্মী ছাঁটাইয়ের ঘোষণা দিয়েছে। কোম্পানিটি জানিয়েছে, তারা প্রায় ৩০ হাজার কর্পোরেট কর্মীকে ছাঁটাই করার পরিকল্পনা করছে।
এটি হবে ২০২২ সালের পর থেকে অ্যামাজনের সবচেয়ে বড় ছাঁটাই কার্যক্রম। এর মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে কর্মক্ষেত্রে নতুন করে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
বিবিসি, রয়টার্স এবং ব্লুমবার্গ–এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই ছাঁটাইয়ের মূল কারণ হলো অতিরিক্ত নিয়োগের চাপ, অর্থনৈতিক মন্দা এবং খরচ কমানোর কৌশল।
অ্যামাজনের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ছাঁটাইগুলোর একটি
অ্যামাজনের মোট কর্মী সংখ্যা বর্তমানে প্রায় ১৫ লাখ। এর মধ্যে কর্পোরেট পর্যায়ে কর্মরত আছেন প্রায় ৩ লাখ ৫০ হাজার জন।
নতুন ছাঁটাইয়ের এই সংখ্যা কর্পোরেট কর্মীর প্রায় ১০ শতাংশ। যদিও এটি অ্যামাজনের মোট কর্মীর তুলনায় ছোট অংশ, তবুও এটি কর্পোরেট কাঠামোর ওপর বড় প্রভাব ফেলবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
কোম্পানির একাধিক বিভাগ—যেমন মানবসম্পদ, অপারেশনস, ডিভাইস ও সার্ভিস, এবং অ্যামাজন ওয়েব সার্ভিসেস (AWS)—এই ছাঁটাইয়ের আওতায় আসতে পারে।
মহামারির সময়ের নিয়োগই এখন বোঝা
কোভিড–১৯ মহামারির সময় অনলাইন ডেলিভারি ও ডিজিটাল পরিষেবার চাহিদা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়।
এই চাহিদা পূরণে অ্যামাজন সে সময় বিপুল সংখ্যক নতুন কর্মী নিয়োগ দেয়—গুদাম থেকে শুরু করে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার পর্যন্ত।
তবে এখন বিশ্ব অর্থনীতি ধীর গতিতে চলায় ও ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ায় অ্যামাজনের বিক্রি আগের মতো বাড়ছে না। ফলে ব্যয় সংকোচনই এখন তাদের মূল লক্ষ্য।
একজন বিশ্লেষক বলেন,
“অ্যামাজন যে হারে মহামারির সময় কর্মী নিয়োগ করেছিল, তা টেকসই ছিল না। এখন সেই বাড়তি ব্যয় সামলাতে ছাঁটাই ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।”
২০২২ সালের পর আরেক দফা বড় সিদ্ধান্ত
অ্যামাজন ২০২২ সালের শেষের দিকে প্রথম বড় দফায় প্রায় ১৮ হাজার কর্মী ছাঁটাই করেছিল।
তারপর ২০২3 সালে আরও একাধিক বিভাগে ছোট ছোট পরিসরে ছাঁটাই হয়—বিশেষত ডিভাইস, কমিউনিকেশন ও পডকাস্ট বিভাগে।
এখন আবার ২০২৫ সালে ৩০ হাজার ছাঁটাইয়ের ঘোষণা সেই ধারাবাহিকতারই অংশ।
এই সিদ্ধান্তের ফলে কোম্পানির অভ্যন্তরীণ মনোবলেও নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
অ্যামাজনের অনেক কর্মী ইতিমধ্যেই LinkedIn–এ তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করছেন এবং নতুন চাকরির খোঁজে পোস্ট দিচ্ছেন।
অ্যামাজনের বক্তব্য ও প্রতিক্রিয়া
বিবিসি অ্যামাজনের সঙ্গে যোগাযোগ করলে প্রতিষ্ঠানটি কোনো আনুষ্ঠানিক মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানায়।
তবে কোম্পানির ঘনিষ্ঠ এক সূত্র জানিয়েছে, এই ছাঁটাই হবে “বাজার বাস্তবতার সঙ্গে নিজেদের খাপ খাইয়ে নেওয়ার অংশ।”
অ্যামাজনের সিইও অ্যান্ডি জ্যাসি গত বছরও এক বার্তায় জানিয়েছিলেন,
“আমরা এমন একটি সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি যেখানে আমাদের আরও দক্ষ হতে হবে, খরচ কমাতে হবে এবং ভবিষ্যতের জন্য টেকসই ব্যবসায়িক মডেল তৈরি করতে হবে।”
বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর সংকট
শুধু অ্যামাজন নয়, বিশ্বব্যাপী বড় বড় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোও একই পথে হাঁটছে।
২০২৪ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে গুগল, মেটা (ফেসবুক), মাইক্রোসফট, টুইটার (এক্স) এবং অ্যাপল–সহ প্রায় সব বড় কোম্পানিই ছাঁটাইয়ের পথে হেঁটেছে।
- গুগল ২০২৪ সালে প্রায় ১২ হাজার কর্মী ছাঁটাই করেছিল।
- মেটা (ফেসবুকের মূল কোম্পানি) প্রায় ২১ হাজার কর্মী কমিয়েছে।
- মাইক্রোসফট–ও কমিয়েছে ১০ হাজারের বেশি কর্মী।
- এমনকি অ্যাপল, যাদের সাধারণত ছাঁটাই এড়িয়ে চলার ইতিহাস রয়েছে, তারাও কিছু চুক্তিভিত্তিক কর্মীকে বিদায় দিয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রযুক্তি খাতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) ও অটোমেশন প্রযুক্তির উত্থানের কারণে অনেক পদ অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ছে।
অ্যামাজনও সেই পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রভাব
অ্যামাজনের অভ্যন্তরীণ বিশ্লেষণ অনুযায়ী, AI এবং মেশিন লার্নিং–ভিত্তিক সিস্টেম অনেক কাজ আগের চেয়ে দ্রুত ও কম খরচে করতে পারছে।
ফলে মানবসম্পদ খাতে কম জনবল প্রয়োজন হচ্ছে।
অ্যামাজনের অ্যালেক্সা এবং অ্যামাজন ওয়েব সার্ভিসেস (AWS) বিভাগেও এখন AI-নির্ভর প্রকল্পের সংখ্যা বাড়ছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ভবিষ্যতে এই বিভাগগুলোয় নতুন নিয়োগ না দিয়ে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা (automation) বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দেবে কোম্পানিটি।
বিশ্ববাজারে প্রভাব ও কর্মসংস্থানের ভবিষ্যৎ
অ্যামাজনের এই ছাঁটাই শুধু কোম্পানির জন্য নয়, পুরো প্রযুক্তি খাতের জন্য একটি সতর্ক সংকেত।
বিশ্বব্যাপী অর্থনীতি যখন ধীরগতির, তখন এই ধরনের ছাঁটাই বাজারে ভোক্তাদের আস্থা কমিয়ে দিতে পারে।
অনেক অর্থনীতিবিদ মনে করেন, এটি একধরনের “পোস্ট-প্যানডেমিক রিসেট” যেখানে কোম্পানিগুলো তাদের পুরোনো সম্প্রসারণ নীতি বদলে আরও বাস্তবসম্মত দিকেই যাচ্ছেন।
তবে এতে একটি বড় উদ্বেগও রয়েছে—
যদি একইভাবে চাকরির বাজারে সংকোচন চলতে থাকে, তাহলে বিশ্বব্যাপী টেক খাতে নতুন কর্মসংস্থান পাওয়াও আরও কঠিন হয়ে যাবে।
অর্থনৈতিক বাস্তবতা না কর্পোরেট নীতি?
বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, অ্যামাজনের এই সিদ্ধান্ত শুধুই অর্থনৈতিক মন্দার ফল নয়।
এটি এক অর্থে কর্পোরেট পুনর্গঠনের অংশ, যেখানে কম জনবল দিয়ে বেশি উৎপাদনশীলতা নিশ্চিত করার পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে।
অনেকেই বলছেন, ২০২৫ সাল হতে পারে এমন এক বছর, যেখানে
“মানুষ নয়, মেশিনই বড় ভূমিকা নেবে কর্পোরেট দুনিয়ায়।”
তবে এই রূপান্তর প্রক্রিয়া সফল করতে হলে অ্যামাজনকে কর্মীদের মানসিক নিরাপত্তা, নতুন দক্ষতা অর্জনের সুযোগ এবং AI-সহ মানব সহযোগিতা মডেল তৈরি করতে হবে।
অ্যামাজনের ৩০ হাজার কর্মী ছাঁটাই শুধু একটি কোম্পানির সিদ্ধান্ত নয়—এটি বিশ্ব প্রযুক্তি অর্থনীতির পরিবর্তনের প্রতিচ্ছবি।
যেখানে প্রতিটি প্রতিষ্ঠান এখন প্রশ্ন করছে:
“কীভাবে কম খরচে বেশি কার্যকরভাবে টিকে থাকা যায়?”
এই পরিবর্তন যেমন চাকরির বাজারে অনিশ্চয়তা তৈরি করছে, তেমনি নতুন প্রযুক্তিভিত্তিক দক্ষতার চাহিদাও বাড়িয়ে দিচ্ছে।
অ্যামাজনের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো যদি এই ভারসাম্য ঠিকভাবে বজায় রাখতে পারে, তবে ভবিষ্যতের কর্পোরেট কাঠামো আরও স্মার্ট, টেকসই ও দক্ষ হয়ে উঠবে।
MAH – 13515 I Signalbd.com



