বিশ্ব

ফিলিস্তিনে নেতৃত্বে নিজের উত্তরসূরীর নাম ঘোষণা করলেন প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস

Advertisement

৮৯ বছর বয়সে উত্তরসূরীর নাম ঘোষণা করলেন মাহমুদ আব্বাস

ফিলিস্তিনের রাজনীতিতে এক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন দীর্ঘদিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস। বয়সের ভারে নুয়ে পড়া এই অভিজ্ঞ নেতা এবার নিজের উত্তরসূরীর নাম ঘোষণা করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, যদি কোনো কারণে তিনি রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করতে অসমর্থ হন, তাহলে অস্থায়ীভাবে তার স্থলাভিষিক্ত হবেন ভাইস প্রেসিডেন্ট হুসেইন আল শেখ

রোববার, ২৬ অক্টোবর ২০২৫-এ, ফিলিস্তিনের সরকারি বার্তা সংস্থা ওয়াফা-তে প্রকাশিত এক ঘোষণাপত্রে এই তথ্য আনুষ্ঠানিকভাবে জানান মাহমুদ আব্বাস। ঘোষণাটি মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।

ফিলিস্তিনের ইতিহাসে প্রথমবার আনুষ্ঠানিক উত্তরসূরীর ঘোষণা

৮৯ বছর বয়সে এসে মাহমুদ আব্বাস বুঝতে পেরেছেন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নতুন নেতৃত্বের প্রয়োজনীয়তা তৈরি হয়েছে। তিনি প্রায় দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে ফিলিস্তিনকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এ সময় ইসরায়েলের সঙ্গে সংঘাত, আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক টানাপোড়েন, অভ্যন্তরীণ বিভক্তি—সবকিছুর মধ্যেও তিনি ফিলিস্তিনের স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে অটল থেকেছেন।

তবে এবার তিনি বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে নিজের পরবর্তী উত্তরসূরীর নাম ঘোষণা করেছেন। ঘোষণাপত্রে আব্বাস লিখেছেন—

“কোনো কারণে যদি প্রেসিডেন্টের পদ শূন্য হয়ে যায়, তবে ফিলিস্তিনের ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (পিএলও) জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা হুসেইন আল শেখ অস্থায়ীভাবে এই পদে দায়িত্ব পালন করবেন। তার প্রধান দায়িত্ব হবে সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনের আয়োজন করা এবং নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা।”

সংবিধান অনুযায়ী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন বাধ্যতামূলক

ফিলিস্তিনের সংবিধান অনুযায়ী, প্রেসিডেন্টের পদ শূন্য হলে ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন আয়োজন করতে হয়। তবে বাস্তবে তা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে, কারণ ফিলিস্তিনের রাজনৈতিক পরিস্থিতি জটিল ও বিভক্ত।

ওয়েস্ট ব্যাংকে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের (পিএ) নিয়ন্ত্রণ থাকলেও গাজা উপত্যকা শাসন করে প্রতিদ্বন্দ্বী সংগঠন হামাস। এই বিভাজনই বিগত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের পথে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

হুসেইন আল শেখ কে?

হুসেইন আল শেখ, মাহমুদ আব্বাসের দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও ফিলিস্তিনি প্রশাসনের অন্যতম প্রভাবশালী রাজনীতিক। তিনি বর্তমানে পিএলও-এর নির্বাহী কমিটির সচিব, যা কার্যত সংগঠনের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদ।

আল শেখ আন্তর্জাতিক মহলে বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং আরব দেশগুলোর কূটনৈতিক মহলে পরিচিত মুখ। ইসরায়েলের সঙ্গেও তার যোগাযোগ রয়েছে প্রশাসনিক ও নিরাপত্তা সমন্বয় কার্যক্রমে।

ফিলিস্তিনে অনেকে মনে করেন, আব্বাসের পর দেশ পরিচালনায় তিনিই সবচেয়ে প্রস্তুত ও অভিজ্ঞ ব্যক্তি। তবে, একই সঙ্গে তার সমালোচকও কম নয়। অনেক তরুণ ফিলিস্তিনি নেতার অভিযোগ—আল শেখ মূলত আব্বাসের ঘনিষ্ঠ বৃত্তের অংশ, এবং তার নেতৃত্বে “পুরনো রাজনীতি”র ধারাই বজায় থাকবে।

আব্বাসের দীর্ঘ রাজনৈতিক যাত্রা

মাহমুদ আব্বাসের রাজনৈতিক জীবনের সূচনা হয়েছিল প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও)-এর প্রতিষ্ঠাতা ইয়াসির আরাফাতের ঘনিষ্ঠ সহকর্মী হিসেবে।
২০০৪ সালে আরাফাতের মৃত্যুর পর ২০০৫ সালে আব্বাস ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তখন থেকেই তিনি “দুই রাষ্ট্র সমাধান”-এর দৃঢ় সমর্থক ছিলেন—যেখানে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন পাশাপাশি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকবে।

কিন্তু বাস্তবে সেই স্বপ্ন আজও পূরণ হয়নি। আব্বাসের শাসনামলে ইসরায়েল ক্রমাগত নতুন বসতি গড়ে তুলেছে, আর ফিলিস্তিনের রাজনৈতিক ঐক্য ক্রমেই দুর্বল হয়েছে।

তবুও আন্তর্জাতিক মহলে শান্তিপূর্ণ সমাধানের প্রতীক হিসেবেই আব্বাসকে দেখা হয়। তার কূটনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং স্থির নেতৃত্বের কারণেই ফিলিস্তিন অনেক আন্তর্জাতিক সংগঠনের স্বীকৃতি পেয়েছে, যেমন—জাতিসংঘে পর্যবেক্ষক রাষ্ট্রের মর্যাদা

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের দৃষ্টিতে এই সিদ্ধান্ত

মাহমুদ আব্বাসের এই ঘোষণা রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি শুধু ক্ষমতার উত্তরাধিকার ঘোষণা নয়, বরং আগামী দিনের ফিলিস্তিনি রাজনীতির দিকনির্দেশক পদক্ষেপ।

বিশ্লেষক ড. সামির জালাল, যিনি রামাল্লায় অবস্থিত একটি থিংক ট্যাঙ্কের গবেষক, বলেন—

“আব্বাস জানেন যে তিনি চিরকাল নেতৃত্ব দিতে পারবেন না। তার এই সিদ্ধান্ত ফিলিস্তিনি রাজনীতিতে স্থিতিশীলতার বার্তা দেবে, বিশেষত এমন এক সময়ে যখন গাজা ও ওয়েস্ট ব্যাংকের সম্পর্ক ভঙ্গুর।”

অন্যদিকে, কিছু রাজনৈতিক দল এই ঘোষণাকে “ক্ষমতা আঁকড়ে রাখার কৌশল” হিসেবেও দেখছে। তাদের দাবি, নির্বাচনের প্রস্তুতির পরিবর্তে আব্বাস প্রশাসন কেবল নিজেদের প্রভাব বজায় রাখার পথ তৈরি করছে।হামাসের প্রতিক্রিয়া

গাজা নিয়ন্ত্রিত ইসলামপন্থী সংগঠন হামাস এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি, তবে সংগঠনের ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো বলছে—তারা এই সিদ্ধান্তকে “একতরফা ঘোষণা” হিসেবে দেখছে।

হামাসের এক শীর্ষস্থানীয় নেতা বলেন,

“ফিলিস্তিন কোনো এক ব্যক্তির সিদ্ধান্তে পরিচালিত হয় না। জনগণের ভোটই একমাত্র বৈধ পথ।”

এই প্রতিক্রিয়া থেকেই বোঝা যায়, ফিলিস্তিনে রাজনৈতিক ঐক্যের পথে এখনও অনেক বাধা রয়ে গেছে।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্র জানান—

“আমরা ফিলিস্তিনে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখার উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। প্রেসিডেন্ট আব্বাসের সিদ্ধান্ত ফিলিস্তিনি জনগণের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ধারণে সহায়ক হবে।”

অন্যদিকে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এক বিবৃতিতে বলেছে—

“ফিলিস্তিনে ক্ষমতার শান্তিপূর্ণ হস্তান্তর নিশ্চিত করা অঞ্চলটির স্থিতিশীলতার জন্য জরুরি।”

এদিকে ইসরায়েল এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো মন্তব্য করেনি। তবে ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যমগুলো এই ঘোষণাকে “অভ্যন্তরীণ প্রস্তুতি” হিসেবে উল্লেখ করেছে, যা ফিলিস্তিনি নেতৃত্বে পরিবর্তনের সূচনা হতে পারে।

ফিলিস্তিনের ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে কী পরিবর্তন আসতে পার

মাহমুদ আব্বাসের এই ঘোষণা ফিলিস্তিনে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। তার দীর্ঘ নেতৃত্বের পর ফিলিস্তিনে নতুন নেতৃত্ব, নতুন চিন্তা ও নতুন দিকনির্দেশনা আসতে পারে।

তবে বিশ্লেষকরা বলছেন—
ফিলিস্তিনের প্রকৃত পরিবর্তন নির্ভর করবে দুইটি বিষয়ের ওপর:
১. নির্বাচনের বাস্তবায়ন
২. গাজা ও ওয়েস্ট ব্যাংকের রাজনৈতিক ঐক্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা

যদি হুসেইন আল শেখ অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচন আয়োজন করতে সক্ষম হন, তবে এটি হবে ফিলিস্তিনের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বড় সাফল্য।

মাহমুদ আব্বাসের উত্তরসূরী ঘোষণা শুধু একটি প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নয়—এটি ফিলিস্তিনের ভবিষ্যৎ রাজনীতির রূপরেখা। একদিকে এটি নেতৃত্বে ধারাবাহিকতা রক্ষা করবে, অন্যদিকে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে গণতন্ত্রের প্রত্যাশাও জাগাবে।

তবে এই পদক্ষেপের সাফল্য নির্ভর করবে রাজনৈতিক ঐক্য, নির্বাচনী স্বচ্ছতা এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ওপর।
বিশ্ব এখন তাকিয়ে আছে—কেমন হবে ফিলিস্তিনের আগামী দিনের নেতৃত্ব?

MAH – 13512 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button