বিশ্ব

ফিলিস্তিনে নির্বাচন চায় হামাস

Advertisement

ফিলিস্তিনে বহু বছর পর জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের আহ্বান জানিয়েছে হামাস। গোষ্ঠীটির শীর্ষ নেতা খলিল আল-হায়া জানিয়েছেন, গাজার প্রশাসনিক দায়িত্ব একটি জাতীয় ফিলিস্তিনি সংস্থার কাছে হস্তান্তরে তাদের কোনো আপত্তি নেই। তিনি বলেন, জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্ত হিসেবে হামাস চায়, গাজা ও পশ্চিম তীরজুড়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক।
শনিবার (২৫ অক্টোবর) আল জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এসব কথা জানান তিনি। তাঁর বক্তব্যকে কেন্দ্র করে ফিলিস্তিনের রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে।

হামাসের নতুন প্রস্তাব: ঐক্য ও নির্বাচনের আহ্বান

সাক্ষাৎকারে খলিল আল-হায়া বলেন, গাজার ভবিষ্যৎ শাসনব্যবস্থা যেন একটি জাতীয় ঐকমত্যভিত্তিক সংস্থা পরিচালনা করে, সে বিষয়ে হামাসের কোনো আপত্তি নেই। তিনি জোর দিয়ে বলেন, “আমরা জাতীয় ঐক্য পুনরুদ্ধার চাই, আর তার পথ নির্বাচন।”
হায়ার মতে, হামাসের লক্ষ্য ফিলিস্তিনি জনগণের অভিন্ন নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা, যাতে দীর্ঘদিনের বিভক্তি দূর হয়। তিনি আরও জানান, যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজার পুনর্গঠন ও প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস জাতিসংঘের মাধ্যমে পরিচালিত হবে — এ বিষয়ে গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে প্রাথমিক সমঝোতা হয়েছে।

জাতীয় সংলাপের পথে: হামাসের খোলা মনোভাব

অন্যদিকে, হামাসের মুখপাত্র হাজেম কাসেম সম্প্রতি আনাদোলুকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, গোষ্ঠীটি ফিলিস্তিনের সব দল ও গোষ্ঠীর সঙ্গে জাতীয় সংলাপে বসতে প্রস্তুত। তাঁর ভাষায়, “এখন সময় জাতীয় ঐক্যের। দলীয় স্বার্থ নয়, বরং ফিলিস্তিনি জনগণের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।”
তিনি জানান, মিশরের কায়রোতে বর্তমানে হামাস ও ফাতাহ প্রতিনিধিদলের মধ্যে বৈঠক চলছে। উভয় পক্ষই জাতীয় ঐক্য ও পুনর্গঠনের বিষয়ে আলোচনা করছে। হামাসের দাবি, এই সংলাপের মাধ্যমে একটি অন্তর্বর্তীকালীন ঐক্য সরকার গঠন করা সম্ভব হবে, যা পরবর্তীতে নির্বাচন আয়োজনের পথ সুগম করবে।

দীর্ঘ ১৯ বছর পর নির্বাচন প্রসঙ্গ কেন আলোচনায়

ফিলিস্তিনে সর্বশেষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০০৬ সালে। সেই নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে গাজা উপত্যকার নিয়ন্ত্রণ নেয় হামাস এবং ফাতাহকে উপত্যকা থেকে বিতাড়িত করে। এরপর থেকে পশ্চিম তীর নিয়ন্ত্রণ করে ফাতাহ নেতৃত্বাধীন প্যালেস্টাইনিয়ান অথরিটি (পিএ) এবং গাজা নিয়ন্ত্রণে থাকে হামাস।
গত প্রায় দুই দশক ধরে ফিলিস্তিনি রাজনীতিতে বিভক্তি বজায় থাকায় নতুন কোনো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। এই প্রেক্ষাপটে হামাসের নির্বাচন আয়োজনের আহ্বানকে বিশ্লেষকরা “ইতিবাচক কিন্তু জটিল” উদ্যোগ হিসেবে দেখছেন।

গাজার অস্ত্র ও প্রশাসন: হামাসের অবস্থান

সাক্ষাৎকারে খলিল আল-হায়াকে জিজ্ঞেস করা হয়, হামাস কি অস্ত্র সমর্পণ করবে? জবাবে তিনি বলেন, “হামাসের অস্ত্র ইসরাইলি দখলদারিত্ব ও আগ্রাসনের সঙ্গে সম্পর্কিত। যদি দখলদারিত্বের অবসান হয়, আমরা রাষ্ট্রীয় কাঠামোর অধীনে এসব অস্ত্র হস্তান্তরে রাজি।”
তিনি আরও বলেন, গাজার পুনর্গঠন জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে করা হলে হামাস তা সমর্থন করবে। “গাজাকে পরিচালনার জন্য একটি জাতীয় প্রতিনিধিত্বশীল সংস্থা থাকলে তাতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই,” বলেন তিনি।

এছাড়া, হায়া ত্রাণ সরবরাহে ইসরাইলের বাধার তীব্র সমালোচনা করেন। তিনি জানান, “গাজার জন্য প্রতিদিন ছয় হাজার ট্রাক ত্রাণ প্রয়োজন, অথচ আসছে মাত্র ছয়শ।” তিনি আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতাকারীদের প্রতি আহ্বান জানান, যেন তারা ইসরাইলের ওপর চাপ প্রয়োগ করে মানবিক সহায়তা নিশ্চিত করে।

ফাতাহ-হামাস সম্পর্ক: দীর্ঘ বৈরিতা থেকে সংলাপের পথে

২০০৬ সালের নির্বাচনের পর থেকেই হামাস ও ফাতাহর মধ্যে তীব্র রাজনৈতিক বিরোধ চলে আসছে। এর ফলে পশ্চিম তীর ও গাজা উপত্যকা আলাদা প্রশাসনে পরিচালিত হচ্ছে।
তবে সাম্প্রতিক যুদ্ধ ও গাজার ভয়াবহ মানবিক পরিস্থিতির পর উভয় পক্ষই সংলাপের পথে এগোচ্ছে। ২০২৪ সালে চীনের বেইজিংয়ে ফাতাহ ও হামাস নেতাদের বৈঠক হলেও তা থেকে কোনো ফলাফল আসেনি। কিন্তু এবার মিশরে শুরু হওয়া আলোচনাকে অনেকেই বাস্তব পরিবর্তনের সূচনা হিসেবে দেখছেন।

‘এই উদ্যোগ বাস্তবায়ন কঠিন হলেও জরুরি’

মধ্যপ্রাচ্য বিশ্লেষকরা বলছেন, হামাসের এই প্রস্তাব রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হলেও বাস্তবায়ন সহজ নয়। কারণ, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ ও হামাসের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস এখনো গভীর।
তবে তারা মনে করেন, যুদ্ধ-পরবর্তী পরিস্থিতিতে ঐক্য ও নির্বাচনের পথে অগ্রসর হওয়া ছাড়া টেকসই স্থিতিশীলতা অর্জন সম্ভব নয়।
জেরুজালেমভিত্তিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক ইউসুফ আবু নাসের বলেন, “হামাস যদি সত্যিই প্রশাসনিক দায়িত্ব একটি যৌথ সংস্থার কাছে হস্তান্তরে রাজি হয়, তাহলে এটি ফিলিস্তিন রাজনীতিতে বড় মোড় ঘোরানো ঘটনা হতে পারে।”

ফিলিস্তিনে হামাসের নির্বাচন আয়োজনের আহ্বান নতুন আশার সঞ্চার করেছে। যদিও বাস্তবতা জটিল, তবু সংলাপ ও ঐক্যের পথে এগোনোই শান্তিপূর্ণ সমাধানের একমাত্র উপায় বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা।
বর্তমানে গাজা ও পশ্চিম তীরের জনগণ একসঙ্গে নির্বাচন চায়—এই দাবির মধ্যেই লুকিয়ে আছে ফিলিস্তিনের ভবিষ্যতের নতুন সম্ভাবনা। এখন দেখার বিষয়, ফাতাহ, পিএ এবং আন্তর্জাতিক পক্ষগুলো এই উদ্যোগে কীভাবে সাড়া দেয়।

এম আর এম – ১৯৪৬,Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button