মুসলিম সম্প্রদায়ের সুরক্ষায় নতুন পদক্ষেপ, ইসলামবিদ্বেষী অপরাধ বেড়েছে ১৯ শতাংশ
যুক্তরাজ্যজুড়ে মুসলিম উপাসনালয় ও মসজিদগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্রিটিশ সরকার অতিরিক্ত ১০ মিলিয়ন পাউন্ড বরাদ্দ ঘোষণা করেছে। সাম্প্রতিক ইসলামবিদ্বেষমূলক অপরাধ বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে এই পদক্ষেপকে তাৎপর্যপূর্ণ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের ঘোষণা
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার পূর্ব সাসেক্সের পিসহেভেন মসজিদ পরিদর্শনের সময় বৃহস্পতিবার এই ঘোষণা দেন। মসজিদটিতে চলতি মাসের শুরুতে এক অগ্নিসংযোগ হামলার ঘটনা ঘটে, যা দেশজুড়ে ব্যাপক উদ্বেগ সৃষ্টি করে। স্টারমার বলেন, “ব্রিটেন একটি গর্বিত ও সহনশীল দেশ। যে কোনো সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণ আমাদের জাতি ও মূল্যবোধের ওপর আক্রমণ। এই তহবিল মুসলিম সম্প্রদায়কে তাদের প্রাপ্য সুরক্ষা প্রদান করবে।”
তিনি আরও জানান, সরকারের লক্ষ্য হলো এমন একটি ব্রিটেন গড়ে তোলা যেখানে প্রত্যেকে নিরাপদে উপাসনা করতে পারে, ধর্ম বা পরিচয়ের কারণে কেউ যেন ভয় না পায়। তার মতে, যারা ঘৃণা ও সহিংসতার মাধ্যমে সমাজকে বিভক্ত করতে চায়, তাদের প্রতিরোধ করতে হবে ঐক্য ও সহমর্মিতার মাধ্যমে।
পিসহেভেন মসজিদে আগুন ও তদন্তের অগ্রগতি
গত ৪ অক্টোবর পিসহেভেন মসজিদে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় মসজিদের মূল প্রবেশপথ ও পার্কিং এলাকায় থাকা একটি গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ঘটনাস্থলেই দুইজন সন্দেহভাজনকে আটক করে পুলিশ, তবে এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করা হয়নি। তদন্তকারীরা ঘটনাটিকে “ঘৃণামূলক অপরাধ” হিসেবে বিবেচনা করছেন।
স্থানীয় মুসলিম সম্প্রদায়ের সদস্যরা জানান, এই হামলার পর অনেকেই আতঙ্কে রয়েছেন। এক মুসল্লি বলেন, “আমাদের মসজিদটি শুধু নামাজের জায়গা নয়, এটি আমাদের সামাজিক জীবনের অংশ। এই হামলার পর আমরা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছি।”
ইসলামবিদ্বেষী অপরাধের উদ্বেগজনক বৃদ্ধি
সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত সময়ে যুক্তরাজ্যে ইসলামবিদ্বেষী অপরাধের হার ১৯ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশটির সব ধর্মীয় ঘৃণাজনিত অপরাধের মধ্যে ৪৪ শতাংশই মুসলিমদের লক্ষ্য করে সংঘটিত হয়েছে। এই পরিসংখ্যান ইসলামবিদ্বেষ মোকাবিলায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা আরও জোরালো করে তুলেছে।
বিশ্লেষকদের মতে, অনলাইন ঘৃণামূলক প্রচারণা ও কিছু মিডিয়ার নেতিবাচক প্রচার মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের সাম্প্রতিক সংঘাত ও সন্ত্রাসবিরোধী রাজনীতির কারণে ব্রিটেনে মুসলিমদের ওপর চাপ বাড়ছে।
বরাদ্দকৃত তহবিলের ব্যবহার ও পরিকল্পনা
নতুন ১০ মিলিয়ন পাউন্ডের তহবিলের মাধ্যমে মসজিদগুলোর নিরাপত্তা জোরদার করতে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হবে। এর আওতায় সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন, অ্যালার্ম সিস্টেম উন্নয়ন, নিরাপত্তা বেড়া নির্মাণ এবং প্রশিক্ষিত নিরাপত্তা প্রহরী নিয়োগের ব্যবস্থা করা হবে। বিশেষ করে যেসব মসজিদ অতীতে হামলার শিকার হয়েছে বা ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত, সেগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।
এই তহবিল যুক্তরাজ্যের বিদ্যমান “Protective Security for Mosques Scheme”-এর সম্প্রসারণ হিসেবেই দেখা হচ্ছে। এর আগে ২০২৫ সালের শুরুতে ব্রিটিশ সরকার এই প্রকল্পে ২৯.৪ মিলিয়ন পাউন্ড বরাদ্দ দিয়েছিল, যা ইতিমধ্যেই বিভিন্ন মুসলিম প্রতিষ্ঠানকে সহায়তা করছে।
সরকারের প্রতিক্রিয়া ও মন্ত্রীদের বক্তব্য
ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শাবানা মাহমুদ পিসহেভেন মসজিদে হামলার ঘটনাকে “ভয়াবহ অপরাধ” বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, “ধর্মীয় উপাসনার স্বাধীনতা প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার। কেউ যেন ভয় বা সহিংসতার আশঙ্কায় নামাজ পড়তে না হয়।”
তিনি আরও জানান, নতুন বরাদ্দকৃত অর্থ দেশের মুসলিম কমিউনিটি সেন্টার, ধর্মীয় স্কুল ও ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে আরও কার্যকর করবে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এই তহবিল কেবল নিরাপত্তা জোরদারের জন্য নয়, বরং সামাজিক সংহতি ও সহনশীলতার বার্তা ছড়িয়ে দিতেও ভূমিকা রাখবে।
ব্রিটিশ মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া
ব্রিটিশ মুসলিম ট্রাস্টের নির্বাহী পরিচালক আকিলা আহমেদ এই উদ্যোগকে “অত্যন্ত সময়োপযোগী ও প্রয়োজনীয়” হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, “দুঃখজনকভাবে আমাদের বহু মুসলিম পরিবার আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। তাদের উপাসনালয়গুলো বারবার হামলার লক্ষ্যবস্তু হচ্ছে। এই তহবিল তাদের মানসিক ও শারীরিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সহায়তা করবে।”
তিনি আরও বলেন, “প্রত্যেক নাগরিকেরই শান্তিপূর্ণভাবে ধর্মীয় অনুশীলন করার অধিকার রয়েছে। সমাজের যে অংশটি এখন আতঙ্কের মধ্যে বাস করছে, তাদের জন্য এই পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে আশার বার্তা।”
সহনশীল ব্রিটেনের পথে এক দৃঢ় পদক্ষেপ
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই বরাদ্দ কেবল একটি নিরাপত্তা ব্যবস্থা নয়, বরং সরকারের পক্ষ থেকে মুসলিমদের প্রতি একটি আস্থার বার্তা। যুক্তরাজ্য সবসময়ই বহুধর্মীয় ও বহুসাংস্কৃতিক সমাজ হিসেবে পরিচিত। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইসলামবিদ্বেষের উত্থান সেই সুনামকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছিল। তাই সরকারের এই পদক্ষেপ সেই চিত্র বদলাতে সহায়তা করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
তবে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন যে, শুধু অর্থ বরাদ্দ নয়, সমাজে সহনশীলতার চর্চা এবং শিক্ষার মাধ্যমেই প্রকৃত পরিবর্তন সম্ভব। তাদের মতে, ঘৃণামূলক অপরাধের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগের পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও মিডিয়ায় ইতিবাচক বার্তা প্রচার জরুরি।
যুক্তরাজ্যে মুসলিমদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগের প্রেক্ষাপটে সরকারের এই নতুন তহবিল এক ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এটি শুধু মসজিদ সুরক্ষার পদক্ষেপ নয়, বরং সামাজিক ঐক্য ও সহনশীলতার প্রতীক। আগামী দিনে এই উদ্যোগ কতটা কার্যকর হবে, তা নির্ভর করবে তহবিল বাস্তবায়ন ও স্থানীয় সম্প্রদায়ের সম্পৃক্ততার ওপর।
এম আর এম – ১৯৩২,Signalbd.com



