ইতালিতে ক্যাথলিক যাজকদের হাতে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন প্রায় ৪ হাজার ৪০০ মানুষ—এমনই ভয়াবহ অভিযোগ তুলেছে ভুক্তভোগীদের সংগঠন ‘রেতে ল’আবুসো’। এই রিপোর্ট প্রকাশের পর দেশজুড়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে, এবং আবারও প্রশ্ন উঠেছে গির্জার নীরবতা ও দায়বদ্ধতা নিয়ে।
ক্যাথলিক যাজকদের বিরুদ্ধে ভয়াবহ যৌন নির্যাতনের অভিযোগ
ইতালির ক্যাথলিক যাজকদের বিরুদ্ধে নতুন করে ভয়াবহ অভিযোগ তুলেছে দেশটির অন্যতম বৃহত্তম ভুক্তভোগী সংগঠন ‘রেতে ল’আবুসো’। সংগঠনটির প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, গত কয়েক বছরে প্রায় ৪ হাজার ৪০০ মানুষ যাজকদের হাতে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা ফ্রানসেসকো জানার্দি জানিয়েছেন, এ পরিসংখ্যান তৈরি করা হয়েছে ভুক্তভোগীদের বর্ণনা, আদালতের নথি এবং গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে। তিনি বলেন, “এই রিপোর্ট কেবল সংখ্যা নয়, এটি ইতালির ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের এক অন্ধকার অধ্যায়ের প্রতিফলন।”
নির্যাতনের ঘটনার সময়কাল ও তথ্যসূত্র
রেতে ল’আবুসোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের পর থেকে নথিভুক্ত হওয়া ঘটনাগুলোর ভিত্তিতে এই অভিযোগ প্রকাশ করা হয়েছে। তবে নির্যাতনের ঘটনাগুলো কোন সময় থেকে শুরু হয়েছিল, সে বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য এখনো পাওয়া যায়নি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মোট ১ হাজার ২৫০টি সন্দেহভাজন নির্যাতনের ঘটনা চিহ্নিত করা হয়েছে, যার মধ্যে ১ হাজার ১০৬টি ঘটনায় যাজকরা সরাসরি জড়িত। বাকি ঘটনাগুলোতে সন্ন্যাসিনী, ধর্মীয় শিক্ষক, স্বেচ্ছাসেবক, শিক্ষাবিদ ও স্কাউট সদস্যদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে।
সব মিলিয়ে ৪ হাজার ৬২৫ জন ভুক্তভোগীর তথ্য সংগঠনটির হাতে এসেছে, যার মধ্যে ৪ হাজার ৩৯৫ জনই যাজকদের হাতে নির্যাতিত হয়েছেন বলে দাবি করা হয়।
গির্জার নীরবতা এবং ভ্যাটিকানের সমালোচনা
রয়টার্স জানিয়েছে, ইতালির বিসপস কনফারেন্স (CEI) এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি। গির্জার এই নীরবতা নতুন করে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
গত সপ্তাহেই ভ্যাটিকানের শিশু সুরক্ষা কমিশন ইতালির গির্জার কঠোর সমালোচনা করে জানিয়েছিল, দেশটির ২২৬টি ডায়োসিসের মধ্যে মাত্র ৮১টি শিশু সুরক্ষা বিষয়ক প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে।
কমিশনের সদস্যদের ভাষায়, “এটি গির্জার অভ্যন্তরে স্বচ্ছতার চরম অভাবের প্রমাণ। ভুক্তভোগীরা ন্যায়বিচারের জন্য লড়ছে, আর গির্জা চুপ করে আছে।”
পোপ লিওর প্রতিক্রিয়া: ‘গোপন নয়, সত্য প্রকাশ করতে হবে’
নতুন পোপ লিও দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথমবারের মতো যৌন নির্যাতনের শিকারদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন এই সপ্তাহে। তিনি চার্চের নতুন বিশপদের উদ্দেশে বলেন, “যৌন নির্যাতনের অভিযোগ কখনো গোপন করা যাবে না। সত্যকে আড়াল করা গির্জার ধর্মীয় দায়িত্বের পরিপন্থী।”
এর আগে প্রয়াত পোপ ফ্রান্সিসও বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। তিনি যাজকদের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে একাধিক সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। তবে আন্তর্জাতিক মহল মনে করে, গির্জার ভেতরের গভীর প্রভাব ও রক্ষণশীলতা অনেক সময় এসব উদ্যোগকে ব্যাহত করেছে।
বিশ্বজুড়ে একই অভিযোগের পুনরাবৃত্তি
শুধু ইতালি নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ক্যাথলিক যাজকদের বিরুদ্ধে একই ধরনের যৌন নির্যাতনের অভিযোগ বহুবার উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, আয়ারল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া—প্রতিটি দেশেই ভয়াবহ কেলেঙ্কারি প্রকাশ পেয়েছে, যা গির্জার ভাবমূর্তি গভীরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
ফ্রান্সে ২০২১ সালে প্রকাশিত এক রিপোর্টে দেখা যায়, ১৯৫০ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে প্রায় ৩ লাখ শিশু গির্জা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের হাতে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ইতালিতেও একই বাস্তবতা ধীরে ধীরে সামনে আসছে। পার্থক্য শুধু এতদিন পর্যন্ত ঘটনাগুলো নীরবে চাপা ছিল।
‘গির্জার সংস্কার ছাড়া সমাধান অসম্ভব’
ধর্ম সমাজবিজ্ঞানী ড. আলেসান্দ্রো রোসিনি বলেন, “এই অভিযোগগুলো শুধু যাজকদের নয়, পুরো ধর্মীয় কাঠামোর ওপর আস্থা নষ্ট করছে। গির্জা যদি অভ্যন্তরীণ তদন্তে স্বচ্ছতা না আনে, তাহলে এই সংকট থেকে বের হওয়া অসম্ভব।”
তিনি আরও বলেন, “ভুক্তভোগীদের প্রতি সহমর্মিতা দেখিয়ে গির্জা যদি দায়িত্ব নেয়, তবে এই দীর্ঘদিনের নীরবতা ভাঙা সম্ভব। নইলে এই অভিযোগগুলো ভবিষ্যতেও গির্জার ভাবমূর্তি নষ্ট করতে থাকবে।”
ভুক্তভোগীদের দাবি: ‘ন্যায়বিচার চাই, দয়া নয়’
ভুক্তভোগীদের সংগঠন রেতে ল’আবুসোর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তারা গির্জার কাছে কোনো দান বা ক্ষতিপূরণ চান না—তারা চান ন্যায়বিচার ও স্বীকৃতি।
সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা ফ্রানসেসকো জানার্দি বলেন, “আমরা শুধু চাই গির্জা স্বীকার করুক, এই অপরাধ তাদের ভেতর থেকেই ঘটেছে। দোষীদের আইনের মুখোমুখি করতে হবে। দয়া নয়, আমরা চাই ন্যায়।”
আন্তর্জাতিক মহলের প্রতিক্রিয়া
রিপোর্টটি প্রকাশের পর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো গভীর উদ্বেগ জানিয়েছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানিয়েছে, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ কেবল ধর্মের নয়, মানবাধিকারেরও প্রশ্ন।
তারা ইতালির বিচার বিভাগের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে যেন নিরপেক্ষ তদন্ত নিশ্চিত করা হয় এবং অভিযুক্তদের বিচারের মুখোমুখি আনা হয়।
ইতালির ক্যাথলিক যাজকদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ কেবল একটি দেশের সংকট নয়—এটি গোটা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ব্যবস্থার বিশ্বাসযোগ্যতার প্রশ্ন। গির্জার অভ্যন্তরে সংস্কার, স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহি না বাড়ালে এমন অভিযোগ ভবিষ্যতেও বাড়বে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
প্রশ্ন থেকে যায়—গির্জা কি সত্যিই তার নীরবতা ভাঙবে, নাকি এই নীরবতাই হবে তার দীর্ঘদিনের সংকটের কারণ?
এম আর এম – ১৯৩০,Signalbd.com



