বিশ্ব

ফিলিস্তিনিদের রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে জাতিসংঘ

Advertisement

বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী রাষ্ট্রনেতাদের একজন, ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভা বলেছেন— “গাজায় চলমান গণহত্যা থামাতে এবং নিরীহ ফিলিস্তিনিদের রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে জাতিসংঘ।”
তিনি জাতিসংঘ ও বৈশ্বিক সংস্থাগুলোর প্রতি গভীর হতাশা প্রকাশ করে বলেন, “যেসব বহুপাক্ষিক প্রতিষ্ঠান মানবাধিকার রক্ষা ও শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য তৈরি হয়েছিল, আজ তারা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে।”

গাজা উপত্যকায় চলমান মানবিক বিপর্যয়

গাজা এখন এক মৃতপ্রায় উপত্যকা। ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া যুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ ২০২৫ সালেও থামেনি। জাতিসংঘের সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা গেছে—

  • গাজায় এখন পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা ৭৮,০০০ ছাড়িয়েছে, যার মধ্যে ৪০ শতাংশই শিশু
  • আহতের সংখ্যা ১ লাখ ৫০ হাজারেরও বেশি
  • প্রায় দুই মিলিয়ন মানুষ গৃহহীন হয়ে আশ্রয় নিয়েছে জাতিসংঘের শিবিরে।

কিন্তু এসব শিবিরও আর নিরাপদ নয়। ইসরায়েলের বিমান হামলায় জাতিসংঘের স্কুল ও হাসপাতাল পর্যন্ত ধ্বংস হয়েছে।

লুলা দা সিলভা ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন,

“যখন শিশুদের দেহ খণ্ড খণ্ড হয়ে পড়ে থাকে, তখন জাতিসংঘের সভাকক্ষে শুধু আলোচনা চলে— কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নয়। এটা মানবতার চরম ব্যর্থতা।”

জাতিসংঘের অকার্যকারিতা: ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি

জাতিসংঘ গঠিত হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, মূল লক্ষ্য ছিল বিশ্বশান্তি রক্ষা এবং আগ্রাসন ঠেকানো। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এ প্রতিষ্ঠানটি ক্ষমতাশালী দেশগুলোর রাজনৈতিক প্রভাবের বলয়ে আটকে গেছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ভেটো ক্ষমতা এখন সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা।
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের মতো পশ্চিমা দেশগুলো ইসরায়েলের পক্ষে বারবার ভেটো প্রয়োগ করে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে প্রস্তাবগুলোকে বাতিল করেছে। ফলে গাজা এখন কার্যত আন্তর্জাতিক আইনের বাইরে এক “মৃত্যু উপত্যকা”।

ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট বলেন—

“যদি জাতিসংঘ কেবল শক্তিশালী রাষ্ট্রের হাতের পুতুল হয়ে থাকে, তবে তার অস্তিত্বের অর্থ কী? ফিলিস্তিনিরা এখন আন্তর্জাতিক অন্যায়ের সবচেয়ে বড় ভিকটিম।”

লুলা ও ব্রাজিলের নীতি: ফিলিস্তিনের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান

লুলা দা সিলভা বহুদিন ধরেই ফিলিস্তিনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে আসছেন।
তার প্রথম প্রেসিডেন্ট মেয়াদেই (২০০৩–২০১০) ব্রাজিল ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিয়েছিল।
২০২৫ সালের এই সময়েও তিনি সেই অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করে বলেন,

“আমরা কেবল নিরপেক্ষ থাকতে পারি না, যখন মানবতা হত্যার মুখে।”

ব্রাজিল সাম্প্রতিক মাসগুলোতে জাতিসংঘে গাজায় যুদ্ধবিরতি ও মানবিক সহায়তার প্রস্তাব উত্থাপন করেছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের ভেটোর কারণে পাস হয়নি।

লুলা বলেন,

“যখন কোনো দেশ নিজেকে আইনের ঊর্ধ্বে ভাবতে শুরু করে, তখন আন্তর্জাতিক শান্তি ভেঙে যায়। আমরা সেই ভয়ংকর সময়ের মধ্যে আছি।”

মালয়েশিয়ার সঙ্গে কূটনৈতিক একাত্মতা

শনিবার (২৫ অক্টোবর) মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের সঙ্গে বৈঠক শেষে লুলা সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন।
দু’দেশের নেতা ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা ও গাজায় যুদ্ধবিরতির দাবিতে একসঙ্গে “মানবতার জন্য ঐক্য” শীর্ষক যৌথ ঘোষণাপত্র স্বাক্ষর করেন।

মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমও বলেন,

“যারা আজ নীরব, তারা ইতিহাসে অপরাধী হিসেবে বিবেচিত হবে। ফিলিস্তিন কেবল আরবদের নয়, এটি মানবতার ইস্যু।”

দুই দেশ দক্ষিণ গোলার্ধের উন্নয়নশীল বিশ্বের পক্ষে এক নতুন কূটনৈতিক জোট গঠনের আহ্বান জানিয়েছে, যা জাতিসংঘে “দক্ষিণের কণ্ঠ” (Voice of the South) হিসেবে কাজ করবে।

মানবিক সংকটে ধ্বংসপ্রাপ্ত গাজা

জাতিসংঘের মানবিক সংস্থা (OCHA) জানিয়েছে—
গাজায় বর্তমানে ৯০ শতাংশ মানুষ পরিষ্কার পানি ও খাদ্যের সংকটে আছে।
বেশিরভাগ হাসপাতাল বিদ্যুৎবিহীন, ওষুধ শেষ।
শিশুদের অপুষ্টি ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে।

গাজা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়—

“প্রতিদিন গড়ে ২০০–৩০০ জন নিহত হচ্ছে। মৃতদেহগুলো রাখার জায়গা নেই। মানুষ মরছে ক্ষুধায়, তৃষ্ণায়, আর বোমার আগুনে।”

কিন্তু জাতিসংঘের পক্ষ থেকে এখনো কোনো কার্যকর নিরাপদ অঞ্চল ঘোষণা করা হয়নি।

বিশ্বব্যাপী নিন্দা, তবু নীরব পশ্চিমা পরাশক্তি

ব্রাজিল, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়া ও বাংলাদেশসহ অনেক দেশ ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দৃঢ় প্রতিবাদ জানিয়েছে।
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও জার্মানির মতো দেশগুলো ইসরায়েলের নিরাপত্তা যুক্তি তুলে বিমান হামলার ন্যায্যতা দিচ্ছে।

জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের সাবেক প্রধান নাভি পিল্লে বলেন,

“গাজায় যা ঘটছে, তা ‘স্পষ্টভাবে গণহত্যা’। এবং জাতিসংঘের নিষ্ক্রিয়তা এই অপরাধকে বৈধতা দিচ্ছে।”

আন্তর্জাতিক আদালত (ICJ)-এর রায়: ন্যায়বিচার কোথায়?

২০২৪ সালে আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (ICJ) দক্ষিণ আফ্রিকার করা মামলায় রায় দিয়েছিল—
ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডে “গণহত্যার আশঙ্কা” রয়েছে।
কিন্তু সেই রায়ের কোনো বাস্তব প্রয়োগ হয়নি।
কারণ, আদালতের রায় বাস্তবায়নের দায়িত্ব জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের, আর সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো-রাজনীতি সবকিছু থামিয়ে দেয়।

লুলা দা সিলভা বলেন,

“যদি আদালতের রায়ও কার্যকর না হয়, তবে ন্যায়বিচার কেবল কাগজে থেকে যায়।”

বিশ্বের নৈতিক সংকট: নীরবতার দায় কার?

আজকের পৃথিবীতে প্রযুক্তি, অর্থনীতি, ও যোগাযোগ যত উন্নত হয়েছে, মানবতা ততই পিছিয়ে পড়েছে—এমন মন্তব্য করছেন সমাজবিজ্ঞানীরা।
যখন এক দেশে গাজা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, তখন অন্য দেশে মানুষ ব্যস্ত বিশ্বকাপ, উৎসব বা রাজনীতির আলোচনায়।

মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের বক্তব্য—

“জাতিসংঘের ব্যর্থতা মানে কেবল প্রশাসনিক ত্রুটি নয়, এটি বিশ্ব মানবতার ব্যর্থতা।”

বিশ্লেষকদের দৃষ্টিতে: নতুন বৈশ্বিক ব্যবস্থার দাবি

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই সংকট জাতিসংঘের মৌলিক কাঠামো পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তাকে সামনে এনেছে।
তারা বলেন—

  • নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য সংখ্যা বাড়াতে হবে।
  • ভেটো ব্যবস্থার সংস্কার জরুরি।
  • উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়ায় যুক্ত করতে হবে।

প্রফেসর হোসে রামিরেজ (University of São Paulo) বলেন,

“জাতিসংঘ আজ একদল ধনী রাষ্ট্রের ক্লাব হয়ে গেছে। গাজা এই ক্লাবের মানবিক দেউলিয়াত্ব প্রকাশ করেছে।”

ফিলিস্তিনিদের পাশে বিশ্বজুড়ে সাধারণ মানুষ

যদিও রাষ্ট্রগুলো নীরব, বিশ্বজুড়ে সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমেছে।
লন্ডন, নিউইয়র্ক, ঢাকা, জাকার্তা, সাও পাওলো—সবখানেই লাখো মানুষ ফিলিস্তিনের পতাকা হাতে প্রতিবাদ করছে।
তাদের কণ্ঠে একটাই দাবি:

“Ceasefire Now — যুদ্ধ বন্ধ করো এখনই!”

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে #StandWithPalestine, #FreeGaza, #UNFailed হ্যাশট্যাগে লক্ষাধিক পোস্ট ছড়িয়ে পড়েছে।

মানবতার বিচার একদিন হবেই

লুলা দা সিলভা শেষ কথায় বলেন—

“আজ যদি আমরা ফিলিস্তিনের পক্ষে না দাঁড়াই, কাল যখন অন্য কোথাও একই অন্যায় ঘটবে, তখন কেউই আমাদের জন্য দাঁড়াবে না।”

তার এই সতর্কবাণী যেন গোটা বিশ্বের বিবেককে নাড়া দিচ্ছে।
গাজার ধ্বংসস্তূপের মাঝে জন্ম নিচ্ছে এক নতুন প্রশ্ন—
মানবতা কি কেবল শব্দে সীমাবদ্ধ, নাকি তার কোনো বাস্তব রূপ এখনো বাকি আছে?

MAH – 13472 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button