বিশ্ব

হেলিকপ্টার দুর্ঘটনার কবলে ভারতের রাষ্ট্রপতি

Advertisement

ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য কেরালাতে ভয়াবহ এক হেলিকপ্টার দুর্ঘটনার কবলে পড়েন দেশটির রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু। বুধবার (২২ অক্টোবর) সকালে এই দুর্ঘটনা ঘটে পথানামথিট্টা জেলার প্রমাদম এলাকায়। সৌভাগ্যবশত, রাষ্ট্রপতি মুর্মু এবং তাঁর সফরসঙ্গীরা সম্পূর্ণ নিরাপদ রয়েছেন।

ঘটনার খবর নিশ্চিত করেছে ভারতের রাষ্ট্রপতির দপ্তর এবং স্থানীয় প্রশাসন। ঘটনাস্থলেই উপস্থিত ছিলেন নিরাপত্তা কর্মকর্তারা, পুলিশ ও দমকল বাহিনীর সদস্যরা।

অবতরণের সময় ভেঙে পড়ে হেলিপ্যাডের অংশ

সূত্রের বরাতে এনডিটিভি জানায়, রাষ্ট্রপতি মুর্মু শবরীমালা মন্দির দর্শনে যাচ্ছিলেন। নির্ধারিত হেলিপ্যাডে অবতরণের সময় হেলিকপ্টারটির নিচের অংশের ভারে নতুন তৈরি হেলিপ্যাডের একটি অংশ ধসে পড়ে। হেলিকপ্টারের একটি চাকাও তাতে আটকে যায়। কয়েক মুহূর্তের জন্য হেলিকপ্টারটি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় পড়ে যায়, যা দেখে উপস্থিতরা আতঙ্কিত হয়ে ওঠেন।

তবে পাইলটের দ্রুত সিদ্ধান্ত ও নিয়ন্ত্রণ দক্ষতার কারণে বড় কোনো বিপর্যয় ঘটেনি। রাষ্ট্রপতিকে নিরাপদে উদ্ধার করা সম্ভব হয়।

পুলিশ ও দমকলের দ্রুত তৎপরতা

দুর্ঘটনার পরপরই ঘটনাস্থলে উপস্থিত পুলিশ, দমকল ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা দ্রুত উদ্ধার তৎপরতা শুরু করেন।
ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা গেছে, হেলিকপ্টারের নিচের চাকা হাত দিয়ে ঠেলে সরিয়ে নিতে চেষ্টা করছেন কয়েকজন দমকলকর্মী ও পুলিশ সদস্য। কিছু সময়ের মধ্যেই তারা হেলিকপ্টারটি স্থিতিশীল অবস্থায় নিয়ে আসেন।

এরপর রাষ্ট্রপতি মুর্মুকে সতর্কতার সঙ্গে হেলিকপ্টার থেকে নামানো হয়। তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ আছেন বলে পরে জানানো হয় রাষ্ট্রপতির দপ্তর থেকে।

এরপর সড়কপথে শবরীমালার উদ্দেশে যাত্রা

হেলিকপ্টার দুর্ঘটনার পর বাতিল করা হয় আকাশপথের পরবর্তী যাত্রা।
রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু এরপর সড়কপথে শবরীমালা মন্দিরের উদ্দেশ্যে রওনা হন।
এই সফরটি কেরালায় তাঁর চার দিনের সরকারি সফরের অংশ ছিল।

রাষ্ট্রপতির সঙ্গে ছিলেন রাজ্যপাল আরিফ মোহাম্মদ খান এবং কেরালার মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়নও। তারা পরে ঘটনাস্থলের নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার করার নির্দেশ দেন।

শবরীমালা সফরের উদ্দেশ্য কী ছিল

দ্রৌপদী মুর্মু এই সফরে শবরীমালা মন্দিরে পূজা দিতে এবং স্থানীয় উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধন করতে গিয়েছিলেন।
এছাড়াও কেরালার কয়েকটি জেলায় নারী উন্নয়ন, শিক্ষাব্যবস্থা ও সংস্কৃতি বিনিময় প্রকল্পে অংশ নেওয়ার কথা ছিল তাঁর।

রাষ্ট্রপতির এই সফরকে কেন্দ্র করে রাজ্যজুড়ে ব্যাপক প্রস্তুতি নেওয়া হয়। তবে প্রমাদমে হেলিপ্যাডটি মাত্র একদিন আগে তৈরি করা হয়েছিল।

পুলিশ জানায়, “হেলিপ্যাডটি তৈরি করা হয়েছিল দ্রুততার সঙ্গে, কিন্তু কংক্রিট এখনো পুরোপুরি শক্ত হয়নি। অবতরণের সময় ভারসাম্য হারিয়ে ওই অংশটি ভেঙে পড়ে।”

শেষ মুহূর্তে হেলিপ্যাড পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত

প্রথমে রাষ্ট্রপতির হেলিকপ্টারটি নীলাক্কল হেলিপ্যাডে নামার কথা ছিল। কিন্তু সেখানে আবহাওয়া খারাপ থাকায় শেষ মুহূর্তে অবতরণের স্থান পরিবর্তন করা হয় প্রমাদম এলাকায়।
এই সিদ্ধান্তই পরোক্ষভাবে দুর্ঘটনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়, কারণ নতুন জায়গাটি প্রস্তুত ছিল না সম্পূর্ণভাবে।

কেরালা পুলিশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, “আমরা জানতাম এটি অস্থায়ীভাবে তৈরি করা হেলিপ্যাড। তবে রাষ্ট্রপতির সফরের সময়সূচি অনুযায়ী এটিই ছিল একমাত্র বিকল্প। এখন তদন্ত চলছে ঠিক কী কারণে ধসটি ঘটেছে।”

সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল ভিডিও ও প্রতিক্রিয়া

ঘটনার ভিডিওটি সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে।
ভিডিওতে দেখা যায়, হেলিকপ্টারের চাকায় কাদা জমে গেছে এবং কয়েকজন কর্মকর্তা হাত দিয়ে ঠেলে সেটি মুক্ত করার চেষ্টা করছেন।

অনেকেই টুইটার (এক্স) ও ইনস্টাগ্রামে মন্তব্য করেন, রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তা ব্যবস্থায় “অবহেলা ও তড়িঘড়ি সিদ্ধান্তের” কারণে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে।
অন্যদিকে কিছু নাগরিক দমকল ও পুলিশের তৎপরতা ও সাহসিকতার প্রশংসা করেছেন।

রাষ্ট্রপতির দপ্তরের প্রতিক্রিয়া

ভারতের রাষ্ট্রপতির দপ্তর এক বিবৃতিতে জানিয়েছে,

“মাননীয়া রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু নিরাপদ আছেন। অবতরণের সময় একটি ক্ষুদ্র প্রযুক্তিগত সমস্যা ঘটেছিল, যা দ্রুত সমাধান করা হয়েছে। তার পরবর্তী কর্মসূচি যথারীতি অনুষ্ঠিত হচ্ছে।”

রাষ্ট্রপতির কার্যালয় আরও জানায়, হেলিপ্যাডের নির্মাণ ও অনুমোদন প্রক্রিয়া সম্পর্কেও তদন্ত চলছে। নিরাপত্তা প্রটোকল ভবিষ্যতে আরও কঠোর করা হবে।

হেলিকপ্টার পরিচালনায় নিযুক্ত সংস্থা

রাষ্ট্রপতির ব্যবহৃত হেলিকপ্টারটি ছিল ভারতীয় বিমানবাহিনীর MI-17 V5 মডেলের, যা সাধারণত উচ্চ পর্যায়ের ভিআইপি পরিবহনে ব্যবহৃত হয়।
এই হেলিকপ্টারগুলো শক্তিশালী ও নিরাপদ বলে পরিচিত। তবে কংক্রিটের অস্থির ভূমিতে অবতরণের সময় ভারসাম্য হারানোর আশঙ্কা থাকে।

বিমানবাহিনী জানিয়েছে, পাইলটের উপস্থিত বুদ্ধি ও দ্রুত প্রতিক্রিয়া না থাকলে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারত।

তদন্ত শুরু করেছে কেরালা প্রশাসন

কেরালা সরকারের পক্ষ থেকে ইতিমধ্যে একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
তদন্তে দেখা হবে—

  • হেলিপ্যাড তৈরির মান ও নিরাপত্তা যাচাই প্রক্রিয়া
  • শেষ মুহূর্তে স্থান পরিবর্তনের যৌক্তিকতা
  • বিমানবাহিনী ও স্থানীয় প্রশাসনের সমন্বয় কতটা কার্যকর ছিল

কেরালার মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন জানিয়েছেন, “রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। ভবিষ্যতে এমন ঘটনা এড়াতে প্রটোকল পুনর্বিবেচনা করা হবে।”

ভারতের বিভিন্ন মহলের প্রতিক্রিয়া

এই ঘটনার পর ভারতের বিভিন্ন রাজনীতিক ও নাগরিক সমাজ থেকে প্রতিক্রিয়া এসেছে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এক্স-এ পোস্ট করে লেখেন—

“রাষ্ট্রপতি মহোদয়া নিরাপদ আছেন, এটাই সবচেয়ে বড় স্বস্তি। নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর তৎপরতার জন্য ধন্যবাদ।”

কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীও উদ্বেগ প্রকাশ করে জানান, “রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তা নিয়ে এ ধরনের অব্যবস্থাপনা মেনে নেওয়া যায় না। বিষয়টির স্বচ্ছ তদন্ত হওয়া উচিত।”

দ্রৌপদী মুর্মু—ভারতের প্রথম আদিবাসী নারী রাষ্ট্রপতি

দ্রৌপদী মুর্মু ভারতের ইতিহাসে এক অনন্য ব্যক্তিত্ব।
২০২২ সালে তিনি ভারতের ১৫তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব নেন এবং দেশের প্রথম আদিবাসী নারী রাষ্ট্রপতি হিসেবে ইতিহাস গড়েন।
ওড়িশার ময়ূরভঞ্জ জেলার এক সাধারণ পরিবার থেকে উঠে আসা মুর্মুর জীবন সংগ্রাম এবং সাফল্য কোটি ভারতীয়কে অনুপ্রাণিত করেছে।

তাঁর এই সফরের উদ্দেশ্যও ছিল মূলত দক্ষিণ ভারতের জনগণের সঙ্গে সংযোগ জোরদার করা এবং উন্নয়নমূলক প্রকল্প পরিদর্শন।

অল্পের জন্য বড় বিপর্যয় এড়ানো গেল

বিমান চলাচল বিশেষজ্ঞদের মতে, এই দুর্ঘটনাটি “অল্পের জন্য বড় বিপর্যয় থেকে রক্ষা” পাওয়া একটি ঘটনা।
যদি হেলিকপ্টারটি ভারসাম্য হারিয়ে পুরোপুরি কাত হয়ে পড়ত, তাহলে মারাত্মক পরিণতি ঘটতে পারত।

একজন সাবেক বিমানবাহিনীর কর্মকর্তা বলেন,

“হেলিকপ্টারের অবতরণের সময় ভূমির গঠন ও দৃঢ়তা যাচাই করা অত্যন্ত জরুরি। এখানে হয়তো সেই যাচাই যথাযথভাবে হয়নি।”

সংক্ষিপ্ত সারসংক্ষেপ

বিষয়তথ্য
ঘটনারাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর হেলিকপ্টার দুর্ঘটনা
স্থানপ্রমাদম, পথানামথিট্টা, কেরালা
সময়বুধবার সকাল, ২২ অক্টোবর ২০২৫
কারণনতুন হেলিপ্যাডের কংক্রিট দুর্বল হওয়ায় ধস
ক্ষয়ক্ষতিকোনো হতাহতের ঘটনা নেই
উদ্ধার অভিযানপুলিশ ও দমকল বাহিনীর দ্রুত তৎপরতা
বর্তমান অবস্থারাষ্ট্রপতি নিরাপদ, সফর চলমান
তদন্তকেরালা সরকার গঠন করেছে তদন্ত কমিটি

এই ঘটনাটি আবারও মনে করিয়ে দিলো—রাষ্ট্রপতি বা ভিআইপি পর্যায়ের সফর হলেও নিরাপত্তা ও পরিকাঠামোগত প্রস্তুতি নিশ্চিত করা কতটা জরুরি।
দ্রৌপদী মুর্মু অল্পের জন্য বড় দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পেলেও, প্রশাসনের উচিত ভবিষ্যতে এমন অস্থায়ী হেলিপ্যাডের নিরাপত্তা মানদণ্ড কঠোরভাবে পর্যালোচনা করা।

বর্তমানে রাষ্ট্রপতি সুস্থ আছেন এবং তাঁর কেরালা সফর চলমান রয়েছে। দেশজুড়ে নাগরিকরা কৃতজ্ঞ যে ভারতের রাষ্ট্রপতি নিরাপদে আছেন—একটি বিপর্যয় এড়িয়ে গিয়েছে।

MAH – 13427 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button