
ভয়াবহ সেই সকাল: মুহূর্তেই মৃত্যু ৩৮ জনের
নাইজেরিয়ার দক্ষিণাঞ্চলে এক ভয়াবহ দুর্ঘটনায় মুহূর্তেই প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ৩৮ জন নিরীহ মানুষ। মঙ্গলবার সকালে নাইজার রাজ্যের এজ্জা গ্রামে কাচা-আগাই সড়কে একটি জ্বালানিবাহী ট্যাঙ্কার উল্টে যায়, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই তা ভয়াবহ বিস্ফোরণে রূপ নেয়। আগুনে পুড়ে যায় আশপাশের মানুষ, মোটরসাইকেল, ঘরবাড়ি—সবকিছু।
স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে আটটার দিকে ঘটে এই দুর্ঘটনা। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, রাস্তার ক্ষতিগ্রস্ত একটি অংশ দিয়ে যেতে গিয়ে ট্যাঙ্কারটি ভারসাম্য হারায়। মুহূর্তের মধ্যে তেল ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে। স্থানীয় কিছু মানুষ প্লাস্টিক বোতল ও বালতি নিয়ে তেল সংগ্রহ করতে এগিয়ে যান। ঠিক তখনই ঘটে ভয়াবহ বিস্ফোরণ।
এক মুহূর্তে চারপাশ অগ্নিগোলকে পরিণত হয়। আগুনের লেলিহান শিখা আকাশ ছুঁয়ে যায়। পুড়ে যায় অন্তত ৩৮ জন মানুষ, আহত হয় আরও ২০ জনেরও বেশি।
স্থানীয় কর্তৃপক্ষের হতবাক প্রতিক্রিয়া
নাইজার রাজ্যের স্থানীয় প্রশাসন জানিয়েছে, ঘটনাস্থলেই ৩৮ জনের মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়। অনেকের দেহ এমনভাবে পুড়ে গেছে যে শনাক্ত করাও কঠিন হয়ে পড়েছে। আহতদের স্থানীয় হাসপাতাল ও বিশেষায়িত বার্ন ইউনিটে পাঠানো হয়েছে।
রাজ্যের গভর্নর মুহাম্মাদ বেল্লো সাংবাদিকদের বলেন,
“এটি এক ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়। যারা মারা গেছেন, তাদের বেশিরভাগই দরিদ্র মানুষ—যারা জীবিকার তাগিদে তেল সংগ্রহ করতে গিয়েছিলেন। আমরা নিহতদের পরিবারের পাশে আছি।”
তিনি আরও বলেন, নাইজেরিয়ায় সড়ক নিরাপত্তা এখন এক বড় সংকটে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে তেলবাহী ট্রাক ও ট্যাঙ্কারগুলো অধিকাংশই পুরনো ও ঝুঁকিপূর্ণ।
প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনায় বিভীষিকাময় দৃশ্য
স্থানীয় এক দোকানদার আবদুল করিম জানান,
“ট্যাঙ্কারটি রাস্তার পাশে উল্টে যাওয়ার পর আমরা শুধু ধোঁয়া আর তেলের গন্ধ পাচ্ছিলাম। কয়েক মিনিটের মধ্যেই বহু মানুষ দৌড়ে এল, তেল নেওয়ার জন্য। হঠাৎ একটা বড় আওয়াজ—তারপর আগুন চারদিকে ছড়িয়ে গেল। সবাই চিৎকার করতে লাগল…।”
আশপাশের ঘরবাড়িও আগুনে পুড়ে যায়। অন্তত ১২টি মোটরসাইকেল ও কয়েকটি ছোট গাড়ি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়।
উদ্ধার অভিযান ও যানজট
নাইজেরিয়া ফেডারেল রোড সেফটি কর্পস (FRSC)-এর সেক্টর কমান্ডার হাজিয়া আইশাতু সা’আদু জানান, দুর্ঘটনার খবর পেয়ে দ্রুত উদ্ধারকর্মীরা ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে দমকলের প্রায় চার ঘণ্টা লেগে যায়।
তিনি বলেন,
“আমরা রাতভর উদ্ধারকাজ চালিয়েছি। অনেক মৃতদেহ সম্পূর্ণ পুড়ে অচেনা হয়ে গেছে। এই দুর্ঘটনার কারণে ব্যস্ততম এক্সপ্রেসওয়েতে দীর্ঘ যানজট সৃষ্টি হয়েছে।”
দুর্ঘটনার মূল কারণ কী?
প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে, কাচা-আগাই সড়কের একটি বড় গর্তের কারণে ট্যাঙ্কারটি ভারসাম্য হারায়। নাইজেরিয়ার অনেক সড়কই এমনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত যে ভারী যানবাহন চলাচলে ঝুঁকি থাকে।
এছাড়া, অনেক ট্যাঙ্কার ও ট্রাক পুরনো এবং রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অকার্যকর হয়ে পড়েছে। নাইজেরিয়ার তেল পরিবহন ব্যবস্থা মূলত ট্রাকের ওপর নির্ভরশীল, যা দুর্ঘটনার ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে তোলে।
নাইজেরিয়ায় এমন দুর্ঘটনা নতুন নয়
নাইজেরিয়ায় প্রায়ই এমন মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে। দেশটির ইতিহাসে ২০১৯ সালে অনামব্রা রাজ্যে একই ধরনের একটি জ্বালানি ট্যাঙ্কার বিস্ফোরণে অন্তত ৬০ জন মারা গিয়েছিলেন। ২০২১ সালে বেনু রাজ্যে তেলের ট্যাঙ্কার বিস্ফোরণে নিহত হয় ৪৫ জন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব দুর্ঘটনার মূল কারণ—
- রাস্তাঘাটের বেহাল অবস্থা
- যানবাহনের দুর্বল রক্ষণাবেক্ষণ
- অপর্যাপ্ত ট্রাফিক আইন প্রয়োগ
- তেল চুরি ও কালোবাজারি
অনেক সময় স্থানীয় লোকজন ট্যাঙ্কার থেকে তেল সংগ্রহের চেষ্টা করেন, যা আগুন লাগার প্রধান কারণ হয়ে ওঠে।
সরকার ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
নাইজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট বলেছেন, এই দুর্ঘটনা পুরো জাতির জন্য এক বেদনাদায়ক ঘটনা। নিহতদের পরিবারকে সহায়তা ও আহতদের চিকিৎসায় বিশেষ তহবিল ঘোষণা করা হয়েছে।
জাতিসংঘ আফ্রিকায় এমন দুর্ঘটনা রোধে “নিরাপদ পরিবহন উদ্যোগ” চালুর আহ্বান জানিয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে,
“নাইজেরিয়ায় প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় প্রায় ৪০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়, যার মধ্যে এক-চতুর্থাংশ জ্বালানিবাহী ট্যাঙ্কার দুর্ঘটনার শিকার।”
স্থানীয় জীবনের কঠিন বাস্তবতা
নাইজেরিয়া আফ্রিকার অন্যতম তেলসমৃদ্ধ দেশ হলেও জনগণের বৃহৎ অংশ এখনো দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। তেলজাত দ্রব্যের দাম তুলনামূলক বেশি হওয়ায় সাধারণ মানুষ সুযোগ পেলেই তেল সংগ্রহের চেষ্টা করেন।
স্থানীয় সমাজকর্মী গ্রেস ওনিয়েমা বলেন,
“দারিদ্র্যই এই মৃত্যুর বড় কারণ। মানুষ জানে এটা ঝুঁকিপূর্ণ, তবুও তারা এগিয়ে যায়—কারণ তাদের কাছে অন্য কোনো পথ নেই।”
ভবিষ্যতের করণীয়
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এমন দুর্ঘটনা ঠেকাতে অবিলম্বে তিনটি পদক্ষেপ নিতে হবে—
- দেশের সড়ক অবকাঠামো উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিত করা।
- পুরনো ও ঝুঁকিপূর্ণ ট্যাঙ্কার যানবাহন নিষিদ্ধ করা।
- জনগণকে সচেতন করতে জাতীয় পর্যায়ে প্রচারণা চালানো।
এছাড়া, স্থানীয় প্রশাসন ও নিরাপত্তা বাহিনীর সমন্বয়ে তেল চুরি বা অবৈধ তেল সংগ্রহ রোধে কঠোর পদক্ষেপের আহ্বান জানানো হয়েছে।
মানবিক আবেদন
এজ্জা গ্রামের মানুষ আজও শোকাহত। নিহতদের স্মরণে স্থানীয় মসজিদে দোয়া অনুষ্ঠিত হয়েছে। গ্রামের এক ইমাম বলেন,
“আমরা শুধু প্রার্থনা করি, এমন দুর্ঘটনা আর যেন না ঘটে। এই মানুষগুলো জীবিকার জন্য বের হয়েছিল, মৃত্যু নয়।”
নাইজেরিয়ার এই দুর্ঘটনা আবারও প্রমাণ করল—অবহেলা, দারিদ্র্য ও অবকাঠামোগত দুর্বলতার মাশুল দিতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকেই।
যে দেশে তেল সম্পদই জাতীয় গর্ব, সেখানেই তেলের আগুনে পুড়ছে নিরীহ জনগণ।
নিহতদের প্রতি গভীর শোক ও সহানুভূতি জানিয়ে স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, “এই মৃত্যু শুধু এক গ্রাম বা এক রাজ্যের নয়—এটি গোটা আফ্রিকার সতর্কবার্তা।”
MAH – 13426 I Signalbd.com