ধ্বংসস্তূপের নিচে হাজার হাজার ফিলিস্তিনি আমেরিকানরা চিন্তিত শুধু ১৫ ইসরাইলির জন্য

মধ্যপ্রাচ্যের রক্তক্ষয়ী সংঘাতের এই সময়ে গাজার আকাশে আবারও ধোঁয়া, ধ্বংস আর মৃত্যু।
কিন্তু আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক আলোচনায় যেন একপাশে পড়ে আছে ফিলিস্তিনের আর্তনাদ।
ইসরাইলি হামলায় যখন হাজার হাজার ফিলিস্তিনি প্রাণ হারাচ্ছে, তখন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভান্স ইসরাইল সফরে গিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন—শুধু গাজায় আটক বা নিহত ১৫ জন ইসরাইলি নাগরিককে নিয়ে।
ইসরাইল সফরে মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভান্স
২১ অক্টোবর (মঙ্গলবার) সকালে ইসরাইলের তেলআবিবে পৌঁছে প্রেস কনফারেন্স করেন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভান্স।
সেখানে তিনি বলেন, “আমরা আশা করি ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে বর্তমান যুদ্ধবিরতি বজায় থাকবে। গাজায় যে ইসরাইলিদের মরদেহ এখনও উদ্ধার হয়নি, তাদের পরিবার যেন ন্যায়বিচার পায়—আমরা সে জন্য কাজ করছি।”
পুরো সংবাদ সম্মেলনে ভান্স একবারও উচ্চারণ করেননি ‘ফিলিস্তিনি’ শব্দটি।
ইসরাইলি বন্দিদের কথা, তাদের মরদেহ উদ্ধারের বিষয়, এবং ইসরাইলের নিরাপত্তা নিয়েই ছিল তার বক্তব্যের মূল সুর।
ধ্বংসস্তূপের নিচে হাজারো ফিলিস্তিনির লাশ
গাজার হাসপাতালগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে। জাতিসংঘের তথ্যমতে, গত তিন মাসে ১৭,০০০-এর বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে প্রায় অর্ধেকই নারী ও শিশু।
হাজার হাজার মানুষ এখনও ধ্বংসস্তূপের নিচে নিখোঁজ। উদ্ধারকর্মীরা অক্লান্ত পরিশ্রম করেও সবার দেহ উদ্ধার করতে পারছেন না।
বাড়িঘর, স্কুল, হাসপাতাল—সবই ধুলায় মিশে গেছে।
গাজার দক্ষিণাঞ্চলীয় খান ইউনুসের বাসিন্দা ২৯ বছর বয়সী আইমান আল-খাতিব বলেন,
“আমার স্ত্রী ও দুই সন্তান ধ্বংসস্তূপের নিচে। আমি জানি না ওরা বেঁচে আছে নাকি নেই। কেউ এসে খোঁজও নেয় না।”
এমন হাজার হাজার গল্প আজ গাজার প্রতিটি অলিতে গলিতে।
ভান্সের সম্মেলনে ফিলিস্তিনি সাংবাদিকদের অনুপস্থিতি
আল-জাজিরার অভিজ্ঞ সাংবাদিক নূর ওদেহ জানান,
ইসরাইল সফরে ভান্সের যে সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, সেখানে কোনো ফিলিস্তিনি সাংবাদিককে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়নি।
ওদেহ বলেন,
“যারা প্রতিদিন নিজেদের প্রিয়জনের মরদেহ উদ্ধার করছে, তাদের কথা আমেরিকার একজন শীর্ষ নেতার মুখে আমরা একবারও শুনিনি। তাদের বেদনা যেন অদৃশ্য।”
শুধু ১৫ ইসরাইলির জন্য সহানুভূতি?
গাজার ১৫ ইসরাইলি নাগরিকের বন্দি বা নিহত হওয়া নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ভান্স।
তিনি বলেন, “আমরা তাদের মরদেহ উদ্ধার ও পরিবারকে সহায়তার বিষয়টি সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিচ্ছি।”
কিন্তু সেই একই সময়ে, ইসরাইলি বোমা হামলায় যে হাজারো ফিলিস্তিনি ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়েছে, তাদের জন্য একটিও শব্দ নেই মার্কিন প্রশাসনের মুখে।
এই অবস্থান আন্তর্জাতিকভাবে তীব্র সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচ—সবাই বলছে,
“মানবাধিকার কখনও একপাক্ষিক হতে পারে না। একজন ইসরাইলির জীবন যেমন মূল্যবান, তেমনি একজন ফিলিস্তিনির জীবনও সমান মূল্যবান।”
ইসরাইলের নিরাপত্তা নিয়ে আমেরিকার একচেটিয়া উদ্বেগ
সংবাদ সম্মেলনে ভান্স ইসরাইলের নিরাপত্তাকে আমেরিকার “অবিচল অগ্রাধিকার” হিসেবে উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, “আমরা ইসরাইলের পাশে আছি। হামাস বা অন্য কোনো গোষ্ঠী যদি আবার হামলা করে, আমরা ইসরাইলকে পূর্ণ সহায়তা দেব।”
কিন্তু এই বক্তব্যে গাজার মানবিক সংকটের কোনো প্রতিফলন নেই।
গাজায় বর্তমানে প্রায় ২২ লাখ মানুষ খাদ্য ও পানির তীব্র সংকটে ভুগছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, ৭০% চিকিৎসা কেন্দ্র অচল হয়ে গেছে।
মানুষ বাধ্য হয়ে দূষিত পানি পান করছে, আর শিশুদের পুষ্টিহীনতায় মৃত্যু বাড়ছে।
গাজায় আন্তর্জাতিক বাহিনী পাঠানোর আলোচনা
ভান্স বলেন, গাজায় যুদ্ধবিরতির পর একটি “আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষা বাহিনী” গঠনের প্রস্তাব উঠেছে।
তবে তিনি স্পষ্ট করে জানান, ইসরাইল চায় না সেখানে তুরস্কের সেনারা অংশ নিক।
ভান্স বলেন, “আমরা বিষয়টি ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করছি। ইসরাইলের উদ্বেগকে আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি।”
তবে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, এই আন্তর্জাতিক বাহিনী যদি গাজায় প্রবেশ করে, তা ফিলিস্তিনিদের জন্য নয়—বরং ইসরাইলের নিরাপত্তার বলয় শক্তিশালী করার উদ্দেশ্যে।
যুক্তরাষ্ট্রের দ্বৈত নীতি নিয়ে প্রশ্ন
বিশ্বজুড়ে মানবাধিকার সংগঠনগুলো প্রশ্ন তুলছে—
যখন ইউক্রেন বা অন্য কোনো দেশে বেসামরিক মানুষ মারা যায়, তখন আমেরিকা তাদের পাশে দাঁড়ায়।
কিন্তু গাজার মানুষ যখন প্রতিদিন মরছে, তখন তারা কেবল ইসরাইলের “নিরাপত্তা” নিয়ে কথা বলে কেন?
মার্কিন ইতিহাসবিদ নোয়াম চমস্কি একবার বলেছিলেন,
“যুদ্ধের সময় আমেরিকার মানবিকতার সংজ্ঞা নির্ভর করে—ভুক্তভোগী কারা।”
আজ গাজার পরিস্থিতি যেন তার কথাকেই বাস্তবে প্রমাণ করছে।
গাজার মানবিক সংকট নতুন পর্যায়ে
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, গাজায় এখন চিকিৎসা, পানি ও খাদ্য সংকট চরমে।
৮০% মানুষ গৃহহীন।
প্রায় ১.২ কোটি মানুষ সহায়তার ওপর নির্ভরশীল।
জাতিসংঘ বলছে, এটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়গুলোর একটি।
অন্যদিকে, ইসরাইলি সেনারা বলছে, তারা এখনও “হামাসের অবশিষ্ট ঘাঁটি ধ্বংস” করতে অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে।
তাদের দাবি, “গাজার সাধারণ মানুষের ক্ষতি অনিচ্ছাকৃত।”
কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বলছে, এই হামলা সুপরিকল্পিতভাবে বেসামরিক অবকাঠামোর ওপর পরিচালিত হচ্ছে—যা যুদ্ধাপরাধের আওতায় পড়ে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া: নীরবতা ভাঙছে কিছু দেশ
তুরস্ক, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, আয়ারল্যান্ডসহ কয়েকটি দেশ গাজায় ইসরাইলের হামলাকে “রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস” বলে অভিহিত করেছে।
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান বলেন,
“মানবতা আজ গাজায় পরীক্ষা দিচ্ছে। যারা নীরব, তারাই অপরাধী।”
তবে যুক্তরাষ্ট্র ও কিছু ইউরোপীয় দেশ এখনও ইসরাইলের প্রতি তাদের সমর্থন অব্যাহত রেখেছে।
এ অবস্থায় বিশ্বব্যাপী শান্তিপ্রিয় মানুষরা বলছেন,
“যতদিন পর্যন্ত বিশ্বের ক্ষমতাবানরা মানবতাকে ধর্ম বা রাজনীতির চশমায় দেখবে, ততদিন ফিলিস্তিনের শিশুরা মরবে।”
গাজার মানুষের একটাই দাবি—“আমাদের মানুষ হিসেবে দেখুন”
গাজায় আজ যে শিশুরা বেঁচে আছে, তাদের অনেকেই অনাথ।
কেউ বাবা-মা হারিয়েছে, কেউ হারিয়েছে পুরো পরিবার।
একটি ১০ বছর বয়সী মেয়ে, মারিয়াম, আল-জাজিরার ক্যামেরায় বলেছে,
“আমার স্কুল আর বাড়ি নেই। কিন্তু আমি চাই দুনিয়া জানুক, আমরা মানুষ।”
এই শিশুর কথাই হয়তো আজ ফিলিস্তিনের প্রতিটি মানুষের হৃদয়ের ভাষা।
যেখানে বিশ্বরাজনীতি ঠান্ডা হিসাব করছে, সেখানে গাজার শিশুরা চায়—কেবল একটু মানবতা।
মানবতার এই পরীক্ষায় কে পাশ করবে?
ইসরাইলের নিরাপত্তা নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ফিলিস্তিনের জীবন, তাদের ভবিষ্যৎও কি ততটাই গুরুত্বপূর্ণ নয়?
যদি একজন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট কেবল ১৫ ইসরাইলির জন্য কান্না দেখান, কিন্তু হাজার হাজার ফিলিস্তিনির মৃত্যুতে নীরব থাকেন—তাহলে বিশ্ব রাজনীতি আসলে কোন মানবতার কথা বলে?
গাজায় এখনো ধোঁয়া উঠছে।
ধ্বংসস্তূপের নিচে কেবল দেহ নয়, চাপা পড়ছে পৃথিবীর বিবেকও।
MAH – 13423 I Signalbd.com