বিশ্ব

দীর্ঘ বিরতির পর একাধিক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ল কিমের কোরিয়া

Advertisement

কয়েক মাস নীরব থাকার পর ফের উত্তেজনা

দীর্ঘ কয়েক মাসের নীরবতার পর আবারও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছে উত্তর কোরিয়া। বুধবার সকালে দেশটির পূর্ব উপকূল থেকে একাধিক স্বল্পপাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে পিয়ংইয়ং। দক্ষিণ কোরিয়ার সামরিক বাহিনী জানায়, ক্ষেপণাস্ত্রগুলো পূর্ব সাগর (জাপান সাগর) অভিমুখে ছোড়া হয়, যা প্রায় ৩৫০ কিলোমিটার (২১৭ মাইল) পথ অতিক্রম করে সাগরে পতিত হয়।

দক্ষিণ কোরিয়ার যৌথ বাহিনী কমান্ড (JCS) জানায়, এটি গত কয়েক মাসের মধ্যে উত্তর কোরিয়ার প্রথম ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ, যা এক অর্থে দেশের সামরিক কর্মকাণ্ডে নতুন করে আগ্রাসনের ইঙ্গিত বহন করছে।

আন্তর্জাতিক সম্মেলনের ঠিক আগে এই উসকানি

এই ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ এমন এক সময়ে ঘটল, যখন মাত্র এক সপ্তাহ পরেই দক্ষিণ কোরিয়ার গিয়োংজু শহরে শুরু হতে যাচ্ছে এশিয়া-প্যাসিফিক ইকোনমিক কো-অপারেশন (APEC) সম্মেলন।
এই সম্মেলনে যোগ দেওয়ার কথা রয়েছে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, জাপানের প্রধানমন্ত্রী, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ইন্দোনেশিয়াসহ বিশ্বের শীর্ষ অর্থনীতির প্রতিনিধিদের।

বিশ্লেষকরা বলছেন, উত্তর কোরিয়া ইচ্ছাকৃতভাবেই এ সময় ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে, যাতে সম্মেলনের আগে রাজনৈতিক বার্তা দেওয়া যায়—বিশ্ব শক্তিগুলো যেন জানে, পিয়ংইয়ং এখনো “গুরুত্বপূর্ণ সামরিক শক্তি” হিসেবে বিদ্যমান এবং কেউ যেন তাদের উপেক্ষা না করে।

দক্ষিণ কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া

দক্ষিণ কোরিয়ার সেনাবাহিনী এক বিবৃতিতে বলেছে,

“অতিরিক্ত ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের সম্ভাবনা মাথায় রেখে নজরদারি জোরদার করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে তথ্য আদান-প্রদান চলছে, এবং সেনাবাহিনী সম্পূর্ণ প্রস্তুত রয়েছে।”

ওয়াশিংটনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা দপ্তর পেন্টাগন জানায়, তারা ঘটনাটি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে এবং এটি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের রেজুলেশন লঙ্ঘন বলেও মন্তব্য করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের মতে, এই ধরনের উসকানি শুধু আঞ্চলিক নয়, বৈশ্বিক নিরাপত্তার জন্যও হুমকি।

লি জে মিয়ং সরকারের জন্য প্রথম বড় পরীক্ষা

দক্ষিণ কোরিয়ার নতুন প্রেসিডেন্ট লি জে মিয়ং জুন মাসে দায়িত্ব নেওয়ার পর এটিই তার সময়কালের প্রথম ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা। তার প্রশাসনের জন্য এটি এক বড় কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, পিয়ংইয়ংয়ের এই পদক্ষেপের মাধ্যমে লি জে মিয়ংয়ের নেতৃত্ব পরীক্ষা করা হচ্ছে—তিনি যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের সঙ্গে কতটা ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে পারেন এবং উত্তর কোরিয়ার হুমকির জবাবে কেমন অবস্থান নেন।

মে মাসের পর প্রথম ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা

দক্ষিণ কোরিয়ার সংবাদমাধ্যম ইয়োনহাপ নিউজ এজেন্সি জানিয়েছে, এর আগে উত্তর কোরিয়া ২০২৫ সালের ৮ মে ও ২২ মে ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালিয়েছিল।
এর পর থেকে প্রায় পাঁচ মাস কোনো বড় সামরিক নিক্ষেপ দেখা যায়নি। ফলে অক্টোবরের এই নিক্ষেপ উত্তর কোরিয়ার নতুন পর্যায়ের সামরিক সক্রিয়তার ইঙ্গিত দিচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

কিমের নতুন ‘হোয়াসং-২০’ ও সামরিক শক্তি প্রদর্শন

চলতি মাসের শুরুতে পিয়ংইয়ংয়ে অনুষ্ঠিত এক বিশাল সামরিক কুচকাওয়াজে উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং-উন প্রকাশ্যে প্রদর্শন করেন তাদের নতুন আন্তমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র (ICBM) — “হোয়াসং-২০”
বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি এখন পর্যন্ত উত্তর কোরিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী ও দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র, যা যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ড পর্যন্ত পৌঁছাতে সক্ষম।

এই কুচকাওয়াজটি ছিল ওয়ার্কার্স পার্টির ৮০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত, যেখানে উপস্থিত ছিলেন চীন, রাশিয়া ও ইরানের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিরা।
এটি শুধু সামরিক প্রদর্শনী নয়—বরং কিমের বৈশ্বিক প্রভাব বাড়ানোর এক কূটনৈতিক কৌশল হিসেবেও দেখা হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করেই উন্নয়ন

জাতিসংঘের একাধিক নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও পিয়ংইয়ং অস্ত্র উন্নয়ন অব্যাহত রেখেছে। উত্তর কোরিয়া সবসময়ই দাবি করে আসছে—এই অস্ত্রগুলো “রক্ষার উদ্দেশ্যে”, অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ কোরিয়ার সম্ভাব্য হামলা ঠেকানোর জন্য।
তাদের বক্তব্য,

“আমরা আমাদের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় কখনোই আপস করব না।”

পাশাপাশি দেশটি কয়েক বছর ধরে পারমাণবিক অস্ত্র ও ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তিতে ব্যাপক বিনিয়োগ করছে।
বিবিসি জানিয়েছে, ২০২৫ সালের শুরু থেকে কিম প্রশাসন নতুন প্রজন্মের সলিড-ফুয়েল ব্যালিস্টিক মিসাইল পরীক্ষায় মনোযোগ দিচ্ছে, যা দ্রুত মোতায়েনযোগ্য এবং শনাক্ত করা কঠিন।

কিম-ট্রাম্প সম্পর্ক ও ভবিষ্যৎ বৈঠকের ইঙ্গিত

উত্তর কোরিয়ার এই ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা এমন সময় এলো, যখন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি মন্তব্য করেছেন—

“আমি আবারও কিম জং-উনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আগ্রহী।”

ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে দুই দেশের মধ্যে তিন দফা বৈঠক হয়েছিল—সিঙ্গাপুর, হ্যানয় ও উত্তর-দক্ষিণ কোরিয়ার সীমান্তে। তবে সে আলোচনাগুলো পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের কোনো অগ্রগতি আনতে পারেনি।
পিয়ংইয়ং পরবর্তীতে ঘোষণা দেয়—তারা কখনোই পারমাণবিক অস্ত্র ত্যাগ করবে না, কারণ সেটিই তাদের “রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার গ্যারান্টি।”

এবারের ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ সেই বার্তাকেই আরও জোরালো করে তুলছে—যে, কিম প্রশাসন আন্তর্জাতিক চাপের কাছে নত হতে প্রস্তুত নয়।

বিশ্লেষকদের মতামত: ‘রাজনৈতিক বার্তা’ই মূল লক্ষ্য

আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করছেন, উত্তর কোরিয়ার এই ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা মূলত রাজনৈতিক বার্তা প্রেরণের একটি কৌশল
ওয়াশিংটনভিত্তিক বিশ্লেষক ব্রুস ক্লিংনার বলেন,

“এটি উত্তর কোরিয়ার পুরনো ধাঁচের কৌশল—বড় সম্মেলনের আগে কোনো উসকানিমূলক পদক্ষেপ নিয়ে নিজেদের উপস্থিতি জানান দেওয়া।”

সিউল ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক লি উন-চোল বলেন,

“কিম জং-উন অভ্যন্তরীণভাবে নিজের জনগণকে দেখাতে চান যে দেশটি শক্তিশালী, আবার বাইরেও বার্তা দিতে চান যে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা তাদের অগ্রগতি থামাতে পারেনি।”

জাপানের নিরাপত্তা উদ্বেগ বাড়ছে

জাপান সরকার জানিয়েছে, ক্ষেপণাস্ত্রগুলো তাদের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের বাইরে পড়লেও, এটি আকাশপথে ঝুঁকি তৈরি করতে পারত।
জাপানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেছেন,

“এই ধরনের পদক্ষেপ আমাদের দেশের নিরাপত্তার জন্য সরাসরি হুমকি। আমরা যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে সমন্বয় বাড়াচ্ছি।”

টোকিও ইতিমধ্যেই তার মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম হালনাগাদ করছে, যাতে ভবিষ্যতে উত্তর কোরিয়ার যে কোনো হামলা প্রতিহত করা যায়।

চীন ও রাশিয়ার নীরব সমর্থন?

চীন ও রাশিয়া উত্তর কোরিয়ার এই পদক্ষেপে প্রকাশ্যে কোনো নিন্দা না জানালেও, তাদের নীরবতা অনেক কিছুই ইঙ্গিত করে।
চীন উত্তর কোরিয়ার সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মিত্র, আর রাশিয়া সম্প্রতি পিয়ংইয়ংয়ের সঙ্গে অস্ত্র সহযোগিতা ও প্রযুক্তি বিনিময় চুক্তির ইঙ্গিত দিয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ইউক্রেন যুদ্ধের পর রাশিয়া পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে যেভাবে অবস্থান নিয়েছে, তাতে পিয়ংইয়ংয়ের সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠতা আরও বাড়ছে।

বিশ্বের উদ্বেগ: নতুন উত্তেজনার ইঙ্গিত

জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্টোনিও গুতেরেস গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন,

“উত্তর কোরিয়ার এই পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য বড় হুমকি। আমরা তাদের সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানাই।”

বিশ্বজুড়ে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, আগামী কয়েক মাসে পিয়ংইয়ং নতুন অস্ত্র পরীক্ষা চালাতে পারে, যা অঞ্চলের স্থিতিশীলতা আরও নাজুক করে তুলবে।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র, দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান যৌথ সামরিক মহড়া বাড়াতে পারে, যার ফলে কোরীয় উপদ্বীপে উত্তেজনা আবারও চরমে উঠবে।

কিমের বার্তা স্পষ্ট

কিম জং-উন যেন আবারও মনে করিয়ে দিলেন—

“বিশ্ব আমাকে ভুলে যেও না।”

এই ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ কেবল সামরিক পদক্ষেপ নয়; এটি এক রাজনৈতিক ঘোষণা, যা বলে দেয়, উত্তর কোরিয়া এখনো বিশ্ব রাজনীতির এক অপ্রত্যাশিত কিন্তু প্রভাবশালী খেলোয়াড়।
এখন দেখার বিষয়, এপেক সম্মেলনের আগে ও পরে আন্তর্জাতিক কূটনীতির মঞ্চে কিম জং-উন কী নতুন পদক্ষেপ নেন এবং বিশ্বনেতারা তার প্রতিক্রিয়ায় কতটা ঐক্যবদ্ধ হতে পারেন।

MAH – 13420 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button