
রাশিয়ার বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান সের্গেই নারিশকিন সম্প্রতি সতর্কবার্তা দিয়েছেন যে পশ্চিম ইউরোপ এককেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থার অবসান মেনে নিতে পারছে না। এই বাস্তবতা তারা মোকাবিলা করতে না পারায় রাশিয়ার সঙ্গে সম্ভাব্য সামরিক সংঘাতের প্রস্তুতি শুরু করেছে। সোমবার উজবেকিস্তানের সমরকন্দে আয়োজিত একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে নারিশকিন এই মন্তব্য করেন।
নারিশকিনের মতে, ইউরোপের দেশগুলো বর্তমানে রাশিয়াকে প্রধান হুমকি হিসেবে দেখছে এবং এই হুমকির মোকাবিলায় সামরিক ব্যয় ও প্রস্তুতি বাড়াচ্ছে। মস্কো বারবার আক্রমণাত্মক উদ্দেশ্য নাকচ করলেও, প্রয়োজন হলে কঠোর প্রতিক্রিয়া জানানোর হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।
ইউরোপের সামরিক প্রস্তুতির বাস্তবতা
নারিশকিনের ভাষ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে ইউক্রেন-রাশিয়া সংঘাত শুরু হওয়ার পর থেকে পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলো প্রতিরক্ষা খাতে ব্যাপক অর্থ বরাদ্দ করেছে। বিশেষত ইইউ দেশগুলো ২০৩০ সালের মধ্যে সামরিক ব্যয়ে ৮০০ বিলিয়ন ইউরো (প্রায় ৯৩৭ বিলিয়ন ডলার) বরাদ্দ দেওয়ার পরিকল্পনা করছে।
ইউরোপজুড়ে সামরিক উৎপাদন বৃদ্ধি, ন্যাটো বাহিনীর পুনর্বিন্যাস, এবং রাশিয়াবিরোধী প্রচারণার মাধ্যমে তারা জনগণের মনোভাবকে প্রস্তুতির দিকে মেলাতে চেষ্টা করছে। তবে নারিশকিন দাবি করেন, এই পদক্ষেপগুলো পুরোপুরি সফল হচ্ছে না। বিশেষত তরুণদের মধ্যে উদাসীনতা এবং ক্ষমতাসীনদের প্রতি অনাস্থা সামরিক বাহিনীর জনবল সংগ্রহে সমস্যা তৈরি করছে।
ইউক্রেন সংঘাত ও পশ্চিমা প্রতিক্রিয়া
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে রাশিয়ার অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকেই ইউরোপীয় দেশগুলো তাদের সামরিক সক্ষমতা বাড়াতে শুরু করে। বিভিন্ন দেশ ইতিমধ্যেই নিজেদের প্রতিরক্ষা খাতে অর্থায়ন বৃদ্ধি করেছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যৌথ সামরিক মহড়া ও সরঞ্জাম বিতরণের উদ্যোগ নিয়েছে।
নারিশকিনের মতে, এই প্রস্তুতি শুধু প্রতিরক্ষা নয়, বরং সম্ভাব্য সংঘাতের জন্য পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে দেখা হচ্ছে। পশ্চিম ইউরোপের নেতারা ক্রমবর্ধমানভাবে রুশভীতি ছড়িয়ে দিয়ে জনগণকে মানসিকভাবে সামরিক প্রস্তুতির জন্য তৈরি করছেন।
রাশিয়ার দৃষ্টিকোণ এবং সতর্কবার্তা
রাশিয়ার গোয়েন্দা প্রধানের দাবি, মস্কো পশ্চিম ইউরোপের কর্মকাণ্ডকে যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে মূল্যায়ন করছে। ন্যাটো বাহিনীকে পুনরায় সাজানো, সামরিক উৎপাদন বৃদ্ধি এবং রাশিয়াবিরোধী প্রচারণা—এসব কার্যক্রম রাশিয়ার নিরাপত্তা নীতিতে সরাসরি প্রভাব ফেলছে।
নারিশকিন জোর দিয়ে বলেছেন,
“বহুমুখি বিশ্বব্যবস্থায় রূপান্তর নিশ্চিত করতে আমাদের সবকিছু করতে হবে, তবে তা যেন আগের যুগের বড় যুদ্ধের মতো রূপ না নেয়।”
এই বক্তব্যে স্পষ্ট যে মস্কো বড় সামরিক সংঘাত এড়িয়ে চলার আগ্রহ রাখলেও, ইউরোপের পদক্ষেপের দিকে সতর্ক নজর রাখছে।
প্রভাব এবং আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ইউরোপের এই পদক্ষেপে ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হতে পারে। বিশেষত পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো যা রাশিয়ার সীমান্তের কাছাকাছি, তারা সম্ভাব্য সংঘাতের জন্য ইতোমধ্যেই প্রস্তুতি শুরু করেছে।
রাশিয়া ও ইউরোপের মধ্যে এই মনস্তাত্ত্বিক উত্তেজনা কেবল সামরিক নয়, কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ককেও প্রভাবিত করতে পারে। নারিশকিনের মন্তব্য অনুযায়ী, পশ্চিম ইউরোপের রাজনৈতিক নেতারা রুশভীতি সৃষ্টি করে জনমতকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছেন, যা দীর্ঘমেয়াদে স্থিতিশীলতার জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
বিশেষজ্ঞ মতামত
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পশ্চিম ইউরোপের এই পদক্ষেপের পেছনে রাজনৈতিক চাপ ও নিরাপত্তা উদ্বেগের মিশ্রণ রয়েছে। যদিও রাশিয়া বারবার আক্রমণাত্মক উদ্দেশ্য অস্বীকার করেছে, তবে মস্কো-এর সতর্কবার্তা ইউরোপকে সজাগ রাখতে কার্যকর ভূমিকা রাখছে।
বিশ্লেষকদের মতে, সামরিক প্রস্তুতি বাড়ানো হলেও জনমতের সমর্থন, অর্থনৈতিক সক্ষমতা এবং কূটনৈতিক সমাধান অবলম্বন না করলে বড় সংঘাত এড়ানো কঠিন হতে পারে।
ভবিষ্যতের দিকে নজর
বিশ্ব ক্রমেই একটি বহুমুখি কাঠামোর দিকে এগোচ্ছে, যেখানে এককেন্দ্রিক শক্তি আর কার্যকরী নয়। রাশিয়ার গোয়েন্দা প্রধানের মন্তব্য ইউরোপকে সতর্ক করলেও, এই উত্তেজনা ভবিষ্যতের সংঘাতের মাত্রা নির্ধারণ করবে।
বিশ্লেষকরা প্রশ্ন তুলছেন, এই পরিস্থিতিতে ইউরোপ এবং রাশিয়ার কূটনৈতিক সমঝোতার সম্ভাবনা কতটা? বিশ্ব এখন যে পথে এগোচ্ছে, তা সামরিক সংঘাত এড়ানো সম্ভব কিনা, তা সময়ই দেখাবে।
এম আর এম – ১৮৮৩,Signalbd.com