বিশ্ব

যুক্তরাষ্ট্রে সাতগুণ কমল ডিমের দাম, ডজন কত?

Advertisement

চলতি বছরের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রে আকাশছোঁয়া ছিল ডিমের দাম। এক ডজন ডিমের জন্য সাধারণ আমেরিকানদের পকেট থেকে গুনতে হচ্ছিল প্রায় ৮ ডলার পর্যন্ত। তবে সাত মাসের ব্যবধানে সেই দাম এখন নেমে এসেছে প্রায় সাতভাগের একভাগে। বর্তমানে মাত্র ১.১৫ ডলারেই (বাংলাদেশি মুদ্রায় আনুমানিক ১৪০ টাকা) মিলছে এক ডজন ডিম।

যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিপণন পরিষেবা (USDA Agricultural Marketing Service – AMS) জানিয়েছে, মার্চের তুলনায় এখন পাইকারি ডিমের দাম প্রায় ৮৬ শতাংশ কমেছে। এভাবে ডিমের বাজারে এমন পতন বিরল ঘটনা বলেই মনে করছেন বাজার বিশ্লেষকরা।

বার্ড ফ্লু ও মুরগি নিধনে তৈরি হয়েছিল সংকট

গত দুই বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রে ডিমের বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয় মূলত বার্ড ফ্লু বা এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জার প্রভাবে। ২০২২ সালে দেশটিতে শুরু হওয়া এই ভাইরাসের সংক্রমণে লাখ লাখ পোলট্রি মুরগি মারা যায় বা খামার কর্তৃপক্ষকে নিধন করতে হয়। সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী, কোনো খামারে যদি একটি মুরগিও আক্রান্ত হয়, তাহলে পুরো খামারের মুরগি নিধন করতে হয়।

এর ফলে ডিম উৎপাদন ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়, বাজারে সরবরাহ কমে যায়, আর চাহিদা অপরিবর্তিত থাকায় দাম বেড়ে যায়। ফেব্রুয়ারি-মার্চে এক ডজন ডিমের দাম গড়ে ৬ থেকে ৮ ডলার পর্যন্ত উঠেছিল। কিছু জায়গায় ৮.২০ ডলার পর্যন্ত গিয়েছিল — যা সাম্প্রতিক ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি।

মার্চের রেকর্ড ভাঙা দাম থেকে অক্টোবরের স্বস্তি

এপ্রিলে দাম কিছুটা কমলেও তা এখনকার মতো এতটা নেমে আসেনি। এপ্রিল মাসে এক ডজন ডিমের দাম ছিল গড়ে ৫.১২ ডলার। জুন-জুলাইয়ে তা আরও কিছুটা কমে ৩ ডলারের নিচে নামে।

তবে অক্টোবরের শুরু থেকে দাম আরও কমতে কমতে এসে দাঁড়িয়েছে ১.১৫ ডলারে। এটি ২০২৩ সালের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ডিমের সবচেয়ে কম দাম বলে জানিয়েছে USDA।

কৃষি বিপণন পরিষেবার (AMS) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ডিম উৎপাদন ও সরবরাহ স্বাভাবিক পর্যায়ে ফিরে এসেছে। পাশাপাশি ফিড খরচও আগের চেয়ে কম হওয়ায় উৎপাদকরা এখন আগের তুলনায় কম দামে বাজারে ডিম বিক্রি করতে পারছেন।

মূল্যস্ফীতির চাপে ক্লান্ত আমেরিকানদের জন্য স্বস্তির খবর

গত দুই বছর ধরে মূল্যস্ফীতির চাপ যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ মানুষের জীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। ডিম, দুধ, মাংস ও সবজির দাম বেড়ে যাওয়ায় গরিব ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর খাদ্য ব্যয় অনেক বেড়ে গিয়েছিল।

তবে এবার ডিমের দামে এই বড় পতন তাদের জন্য বিরল এক স্বস্তি এনে দিয়েছে। এক মার্কিন গৃহিণী স্থানীয় টেলিভিশন চ্যানেলকে বলেন, “গত মার্চে আমি ডিম কিনতে ভয় পেতাম, এখন আবার বাচ্চাদের সকালের নাশতায় ডিম দিতে পারছি।”

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এই দাম কমার পেছনে মূলত তিনটি কারণ কাজ করছে—
১. বার্ড ফ্লু নিয়ন্ত্রণে আসা,
২. খাদ্যশস্য ও পোলট্রি ফিডের দাম কমে যাওয়া,
৩. ডিম আমদানির উপর চাপ হ্রাস।

বার্ড ফ্লু পরিস্থিতি না বদলালে দাম স্থিতিশীল থাকবে

ইউএসডিএর ইকোনমিক রিসার্চ সার্ভিস (ERS) জানায়, নতুন করে এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা বা বার্ড ফ্লুর ঢেউ দেখা না দিলে আসন্ন শীতকালজুড়ে ডিমের দাম তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল থাকবে

তাদের মতে, বর্তমানে মুরগি উৎপাদন খাতে সরকারের সহায়তা, খামারিদের নতুন বায়োসিকিউরিটি নীতি, এবং টিকাদান কর্মসূচি দাম স্থিতিশীল রাখতে সহায়তা করছে।

একজন বাজার বিশ্লেষক বলেন, “যদি শীতকালে বার্ড ফ্লুর কোনো নতুন প্রাদুর্ভাব না ঘটে, তাহলে আগামী বছরের প্রথম প্রান্তিকেও এই দাম টিকবে বলে আশা করা যায়।”

২০২৩ সালের তুলনায় রেকর্ড পতন

২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রে গড়ে প্রতি ডজন ডিমের দাম ছিল ৪.২৫ ডলার। সেখানে ২০২৫ সালে তা নেমে এসেছে ১.১৫ ডলারে—মানে প্রায় ৭৩ শতাংশ কম।

এমনকি বিগত এক দশকে এত দ্রুত দাম কমার নজিরও নেই। ২০১৫ সালে বার্ড ফ্লুর প্রাদুর্ভাবে দাম কিছুটা বেড়েছিল, তবে তখনো এমন রেকর্ড পরিমাণ বৃদ্ধি দেখা যায়নি।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি প্রমাণ করে যে যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি খাত এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি স্থিতিশীল ও পুনরুদ্ধার সক্ষম

পোলট্রি খাতে পুনর্জাগরণ ও ভবিষ্যৎ আশাবাদ

যুক্তরাষ্ট্রের পোলট্রি ফার্মগুলোর মালিকরা এখন নতুন করে উৎপাদনে জোর দিচ্ছেন। অনেক খামার যেগুলো ২০২২–২৩ সালে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, সেগুলো আবার চালু হয়েছে।

নিউইয়র্কভিত্তিক একটি পোলট্রি সমিতির মুখপাত্র বলেন, “আমরা এখন পুরো ক্ষমতায় উৎপাদন করছি। সরকারের সহায়তা এবং বাজারের চাহিদা — দুই মিলিয়ে শিল্প আবার ঘুরে দাঁড়াচ্ছে।”

এর ফলে ভবিষ্যতে শুধু ডিম নয়, মুরগির মাংসের বাজারেও দাম কিছুটা স্থিতিশীল থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টিতে অর্থনৈতিক তাৎপর্য

অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, খাদ্যদ্রব্যের দামে এমন বড় পরিবর্তন যুক্তরাষ্ট্রের সামগ্রিক মূল্যস্ফীতির পরিসংখ্যানে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলবে।

বাজার বিশেষজ্ঞ জন রিচার্ডস বলেন, “ডিমের দাম শুধু একটি পণ্যের বিষয় নয়, এটি খাদ্য মূল্যস্ফীতির সূচক হিসেবেও কাজ করে। তাই ডিমের দাম কমা মানে হলো সাধারণ ভোক্তার খাদ্য খরচে একটি বড় রিলিফ।”

ভোক্তাদের জন্য বিরল এক সুখবর

বছরের শুরুতে যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের ডিমের দাম বিশ্বজুড়ে আলোচনার কেন্দ্র ছিল, সেখানে এখন সেটি নেমে এসেছে সবচেয়ে নিচের স্তরে। এই দাম কমায় যেমন সাধারণ মানুষ স্বস্তি পাচ্ছেন, তেমনি খামারিরাও নতুন উদ্যমে উৎপাদনে ফিরছেন।

অর্থনীতিবিদদের মতে, যদি কোনো নতুন স্বাস্থ্যঝুঁকি বা উৎপাদন ব্যাঘাত না ঘটে, তবে এই দাম আসন্ন শীতকালেও স্থিতিশীল থাকবে। আর তা হলে মূল্যস্ফীতির চাপে থাকা আমেরিকান জনগণের জন্য এটি হবে এক বিরল স্বস্তির সময়।

এম আর এম – ১৮৮১,Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button