বিশ্ব

গাজায় একদিনে ১৫৩ টন বোমা ফেলেছে ইসরাইল: নেতানিয়াহু

Advertisement

ভয়াবহ রাত: গাজায় ধ্বংসস্তূপের শহর

গাজা উপত্যকা আবারও আগুনে পুড়ছে। গত রোববার মাত্র একদিনে ইসরাইলি বিমান বাহিনী গাজায় ১৫৩ টন বোমা ফেলেছে। এ তথ্য নিজেই সংসদে (নেসেট) জানিয়েছেন ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম মিডল ইস্ট আই জানায়, তিনি সংসদে বক্তব্য দেওয়ার সময় বলেন,

“আমাদের এক হাতে অস্ত্র আছে, অন্য হাতে শান্তির আহ্বান। কিন্তু শান্তি দুর্বলদের সঙ্গে নয়, শক্তিশালীদের সঙ্গে হয়।”

তার এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে ইসরাইলের সামরিক অবস্থান এবং রাজনৈতিক বার্তা—দু’টোই স্পষ্ট হয়েছে।

যুদ্ধবিরতির পরও অব্যাহত হামলা

যুদ্ধবিরতি চুক্তি কার্যকর হওয়ার মাত্র তিন দিন পরই ফের নতুন করে হামলা শুরু করেছে ইসরাইলি বাহিনী। গাজার গণমাধ্যম দপ্তরের তথ্যে জানা গেছে, যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর থেকে ইসরাইল ৮০ বার চুক্তি লঙ্ঘন করেছে। এসব হামলায় অন্তত ৯৭ জন ফিলিস্তিনি নিহত এবং ২৩০ জনের বেশি আহত হয়েছেন।

একজন স্থানীয় সাংবাদিক বলেন,

“আমরা যুদ্ধবিরতির স্বপ্ন দেখছিলাম। কিন্তু গাজার আকাশে প্রতিদিনই ধোঁয়া আর আগুনের মিশ্র গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে।”

নিহতদের মধ্যে নারী ও শিশুর সংখ্যাই বেশি

গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান ভয়াবহ বাস্তবতা তুলে ধরেছে। ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া এই সংঘাতে এখন পর্যন্ত ৬৮ হাজার ১৫৯ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ১ লাখ ৭০ হাজার ২০৩ জনেরও বেশি

নিহতদের মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশ নারী ও শিশু। হাসপাতালগুলোতে জায়গা না থাকায় আহতদের অনেককে স্কুল ভবন, এমনকি মসজিদে পর্যন্ত চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

হামাসের হামলা ও ইসরাইলের প্রতিক্রিয়া

ইসরাইল জানিয়েছে, রবিবার হামাসের একটি আক্রমণে তাদের দুই সেনা নিহত হয়েছে। এর প্রতিশোধেই তারা ওইদিন ভয়াবহ বিমান হামলা চালায়। ইসরাইলি সেনাবাহিনী দাবি করেছে, তারা হামাসের বেশ কয়েকটি অস্ত্রগুদাম ও টানেল ধ্বংস করেছে।

তবে গাজার স্থানীয় সূত্র বলছে, বোমাগুলোর বেশিরভাগই পড়েছে আবাসিক এলাকা, স্কুল ও হাসপাতালের কাছাকাছি। এর ফলে অসংখ্য সাধারণ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে।

গাজার মানবিক সংকট: খাবার, পানি ও বিদ্যুতের অভাব

জাতিসংঘের মানবিক সংস্থা (OCHA) বলছে, গাজার অর্ধেকের বেশি জনগণ এখন খাবার, পানি ও ওষুধের তীব্র সংকটে ভুগছে। অনেক এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। হাসপাতালগুলো জেনারেটরের উপর নির্ভর করছে, কিন্তু জ্বালানির অভাবে সেগুলোও বন্ধ হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।

ইউনিসেফ জানায়, গাজার অন্তত ৮ লাখ শিশু মানসিক ট্রমায় ভুগছে। তাদের অনেকেই পরিবার হারিয়েছে, কেউ বা এখনও ধ্বংসস্তূপের নিচে প্রিয়জনের দেহ খুঁজছে।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া: নিন্দা ও আহ্বান

জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলো ইসরাইলের এই বোমাবর্ষণকে “অমানবিক ও আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী” বলে উল্লেখ করেছে।

জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্টোনিও গুতেরেস এক বিবৃতিতে বলেন,

“গাজায় যা ঘটছে, তা শুধুমাত্র যুদ্ধ নয়, এটি মানবিক বিপর্যয়। এখনই অস্ত্রবিরতি না হলে গোটা অঞ্চলই আগুনে জ্বলবে।”

তবে ইসরাইল যুক্তি দিয়েছে, তারা আত্মরক্ষার জন্যই এই অভিযান চালাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু বলেন,

“আমরা আমাদের জনগণকে রক্ষা করছি। হামাসের কোনো অস্তিত্ব থাকবে না।”

মধ্যপ্রাচ্যের উত্তেজনা আরও বেড়েছে

বিশ্লেষকরা বলছেন, এই হামলার ফলে মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তা পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে। লেবাননের হিজবুল্লাহ, সিরিয়া এবং ইরান—সবাই এখন ইসরাইলের বিরুদ্ধে অবস্থান শক্ত করছে।

আল জাজিরা-র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরাইলের সীমান্তে এখন প্রতিদিন ছোট ছোট সংঘর্ষ ঘটছে, যা যেকোনো সময় পূর্ণাঙ্গ আঞ্চলিক যুদ্ধে রূপ নিতে পারে।

নাগরিকদের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা

গাজার উত্তরাঞ্চলের বাসিন্দা রীম আল-খালেদ বলেন,

“আমার তিন বছরের মেয়ে এখনও রাতে ঘুমাতে ভয় পায়। আমরা যখন আকাশে ড্রোনের শব্দ শুনি, সবাই নিচে নেমে দৌড়াতে শুরু করি। এটা আর জীবন নয়, এটা এক অনন্ত আতঙ্ক।”

অন্যদিকে দক্ষিণ গাজার খান ইউনুস এলাকার এক চিকিৎসক জানান,

“আমরা প্রতিদিন মৃতদেহ গুনছি। হাসপাতাল এখন কবরস্থানের মতো হয়ে গেছে।”

ইসরাইলের রাজনৈতিক বার্তা

নেতানিয়াহুর বক্তব্যে স্পষ্ট, তিনি এখন শক্তির রাজনীতি দেখাতে চান। তিনি সংসদে বলেন,

“শান্তি কেবল তখনই সম্ভব, যখন শত্রু জানবে—আমরা অজেয়।”

বিশ্লেষকদের মতে, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক চাপ ও আন্তর্জাতিক সমালোচনা থেকে মনোযোগ সরাতেই নেতানিয়াহু আবারও যুদ্ধকে সামনে এনেছেন।

ইসরাইলি সংবাদমাধ্যম হারেৎজ জানিয়েছে, দেশটির সংসদে অনেকেই এখন প্রশ্ন তুলছেন—অবিরাম বোমাবর্ষণ আসলে শান্তি আনবে, নাকি আরও বিদ্বেষ বাড়াবে?

বিশ্বের চোখ এখন গাজায়

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপের বড় শহরগুলোতে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ বাড়ছে। “Stop Bombing Gaza”, “Free Palestine” — এমন স্লোগান এখন রাস্তায় রাস্তায় শোনা যাচ্ছে।

একই সঙ্গে সোশ্যাল মিডিয়ায় #StopTheWar এবং #PrayForGaza হ্যাশট্যাগে লক্ষ লক্ষ পোস্ট ছড়িয়ে পড়েছে।

যুদ্ধবিরতির ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, বর্তমানে ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে কোনো টেকসই যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনা নেই। গাজায় প্রতিদিনের হামলা, অবরোধ ও মানবিক সংকট এই সংঘাতকে আরও গভীরে ঠেলে দিচ্ছে।

জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় নতুন আলোচনার প্রস্তাব দেওয়া হলেও, দুই পক্ষই এখনো তাতে সাড়া দেয়নি।

গাজায় একদিনে ১৫৩ টন বোমা — এটি কেবল একটি সংখ্যা নয়, এটি এ

ক জাতির বেদনা, ভয় এবং প্রতিদিনের মৃত্যুর প্রতিচ্ছবি। ইসরাইল বলছে তারা হামাসের বিরুদ্ধে লড়ছে, কিন্তু বাস্তবে সবচেয়ে বড় মূল্য দিচ্ছে সাধারণ মানুষ—নারী, শিশু ও বৃদ্ধরা।

বিশ্ব সম্প্রদায়ের উচিত এখনই এই যুদ্ধ থামানোর জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া। না হলে গাজার মানচিত্র হয়তো থাকবে, কিন্তু তার ভেতরে “জীবন” নামের কোনো শব্দই আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।

MAH – 13408 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button